নরওয়ে থেকে:-
গেদু চাচা আর রফিক চাচার বন্ধুত্বের সম্পর্ক বিগত ৩৯ বছরের হলেও গত কয়েকদিন যাবৎ ওনাদের সম্পর্ক বড়ো বেশি নিরস হয়ে পড়েছে। এই রোজা রমজানে উনাদের মাঝখানটায় বসে ওনাদের কর্কশ সুরে জগড়া শুনতে আর ভালো লাগেনা। উনারা দুজনই ডায়বেটিসের রোগী তাই নির্দিষ্ট সময় করে করে উনাদের খাবার খেতে হয়, ইন্সুলিন নিতে হয় তারপরও এই রোজা মাসে সব কিছু বাদ দিয়ে উনারা সব কটি রোজা রাখছেন। এই বৃদ্ধ বয়সে এসেও ধর্ম কর্মের নিয়ম নীতি অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেষ্টা করছেন দেখে উনাদের প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে যায়। ওনাদের শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করে মাঝে মাঝে উনাদেরকে রোজা ছাড়ার উপদেশ দেই কিন্তু এ ব্যাপারে ওনারা নিজেদের ছেলেমেয়েদের কথাই শুনেন না আমার কথা শুনবেন তাতো কল্পনা মাত্র ।
ঐদিন দুপুর ২টার মতো বাজে, আমরা তিনজন সমুদ্রের পাড়ে বেঞ্চিতে বসে আছি, মৃদু মৃদু বাতাস বইছে, সমুদ্রের নীল জল, রৌদ্রের মিহিন উত্তাপ, সব কিছু মিলে কেমন জানি সপ্নীল একটা পরিবেশ। আশেপাশে নানা রঙের গ্রীষ্মকালীন পোশাক পরে লোকজন হেটে যাচ্ছে, কেউ কেউ নৌকা নিয়ে সমুদ্রে বেড়াবার প্ল্যান করছে, কেউ কেউ সমুদ্রের পাড়ে বড়শি দিয়ে স্যামন মাছ মারার চেষ্টা করছে আবার কেউ কেউ প্রেমিকা বা বৌ বাচ্চা নিয়ে আইসক্রিম খাওয়াতে মগ্ন। হটাৎ করে দীর্গ নিঃস্বাশ ফেলে রফিক চাচা বললেন,_ বুঝছো শরীফ: দেশের অবস্থা বড়ো খারাপ, আমি বললাম এ আর নতুন কি রফিক চাচা।
এতো ছোটো একটা দেশ, এতো বেশি মানুষজন , সাথে করে কভিড -১৯ এর প্রাদুর্ভাব সমস্যা তো হবেই। রফিক চাচা একটু উষ্মার স্মরে বললেন বেশি বুঝার চেষ্টা করিওনা শরীফ, তুমিও তোমার গেদু চাচার মতো আওয়ামীলীগার, আমি সব বুঝি, আমার সামনে অন্তত চালাকি করিওনা, আমার সামনে সব সময় দেশের মানুষের দোষ খুজিওনা। আমি বললাম না চাচা, আমি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলিনি যা সত্যি তাই বললাম আরকি !
রফিক চাচা, জিম ধরে কি জানি চিন্তা করলেন কিছুটা সময়, তারপর বললেন, জানো দেশে এ মুহূর্তে প্রায় দেড় কোটি শিক্ষিত ছেলে মেয়ে বেকার ! পড়ালেখা করেও এরা কাজ খুঁজে পাচ্ছেনা। কাজ নাই , তার উপর ঘোষ আর ঘোষ। আর যার মামা চাচা নাই তাদেরতো ঘোষ দিয়েও কাজ হয়না। দুঃখের স্মরে বললেন , জানো শরীফ : দেশে এতো বেশি বেকার ছেলে মেয়ে আর ইন্ডিয়ান রা আমাদের দেশের প্রতিষ্টানগুলোতে কাজ করছে, ডলার লুটে নিচ্ছে !
রফিক চাচার মস্তিস্ক একটু গরম, আজকে ভাব সাব বেশি সুবিধার না,, হয়তোবা আজকে রোজার পার্শ প্রতিক্রিয়া একটু বেশি হচ্ছে। আমি খুবই মৃদু স্বরে বললাম;_ চাচা পৃথিবীটা এখন আর আগের মতো নাই , এখন সব কিছু ইন্টার কানেক্টেড। এইযে আমি আপনি গেদু চাচা সহ আরো অনেক বাংলাদেশী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর, মার্কেটিং কনসালট্যান্ট, ব্যবসায়ী নরওয়েতে আছি কাজ করছি, আমাদের মতো ধর্যশীল মানুষ নরওয়ের জব মার্কেটে দরকার বলেই এখানে আমরা কাজ করতে পারছি, হাজার হাজার নরওয়েজিয়ান ক্রোনার দেশে পাঠাতে পারছি। নরওয়েতে তাদের নিজেদের অনেকই বেকার তারপরও নরওয়েজিয়ান সরকার আমাদেরকে বের করে দিচ্ছেনা এবং নরওয়েজিয়ান জব মার্কেটে আমাদের যে ডিমান্ড, সেটা আছে বলেই আমরা কাজ করতে পারছি, ওদের প্রয়োজন না হলে আমরা কাজ পেতাম না। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের জব মার্কেটে বিভিন্ন সেক্টরে পারদর্শী ইন্ডিয়ান এবং চাইনিজ কর্মীর দরকার বলেই আমরা ওদেরকে জব দিয়ে নিয়ে আসছি কাজ দিচ্ছি এবং ওরা ওদের মেধা এবং কাজ দিয়েই বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর কুটি কুটি ডলার কামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
রফিক চাচা আমার কথায় কোনো মতেই খুশি হলেন বলে মনে হলোনা। দেশে থাকতে বি এন পি দলের নেতা হিসাবে মাঠে ময়দানে ঘুরে বেড়ানো রফিক চাচা কোনো মতেই মানতে পারছেন না যে দেশে আওয়ামীলীগ সরকার বিগত ১৫ বছর ধরে এতো উন্নয়নের গল্প শুনালেও বেকার মানুষের সংখ্যা এবং বেকারত্ব কেন কমছেনা এবং এ নিয়ে উনি শেখ হাসিনার উপর অত্যন্ত নাখোশ।
হটাৎ করে অন্য পাশে বসা আওয়ামীলীগ পন্থী গেদু চাচা রেগে উঠে বললেন ,, –
ও রফিক মিয়া,, ১৮ কোটি জনসংখ্যার এতো ছোটো একটা দেশের এতো বড়ো বড়ো সমস্যার এতো সরল সরল সমাধান যদি তোমার কাছে থাকে তাইলে এক কাজ করো চলো আগামী মাসে তোমাকে দেশে পাঠাই দেই, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানাই দেই, দেশের সব সমস্যার সমাধান নিমিষেই মিটে যাবে।
রফিক চাচা বিরক্তি ভরা চোখে গেদু চাচার দিকে তাকালেন, কি যেন উত্তর দেবো দেবো করেও নিজেকে থামিয়ে নিলেন। রোজার মাস তাই হয়তোবা সংযম দেখালেন। আমাকে বললেন , আচ্ছা শরীফ ভাল থাকিও। আমি বাসায় গেলাম। আজকে যাবার সময় কেনজানি গেদু চাচাকে কিছু না বলেই চলে গেলেন।
প্রতি ঈদে গেদু চাচা এবং রফিক চাচা দুজনের বাসায়ই আমার দাওয়াত থাকে। ঈদ মানে আমার কাছে ডাবল মাস্তি। দু চাচার কাছ থেকেই ঈদের বকশিশ সহ ভালোই খানাপিনা হয়।
সামনেই ঈদ, এবারে ঈদে কি হয় কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা। ভয়ে আছি গেদু চাচা আর রফিক চাচার জগড়া শেষ পর্যন্তনা আমার ঈদের সেলামি এবং দাওয়াত দুটুকেই নষ্ট করে ফেলে। ঈদ যত এগিয়ে আসছে চিন্তায় চিন্তায় আমার ঘুম ততটাই কমে আসছে। নিজের বাসায় বউও নাই যে ঈদের দিন ঘরে ভালো মন্ধ একটু খামু। গেদু চাচা আর রফিক চাচার জগড়ায় এবারের ঈদে সেলামির সাথে সাথে যদি খাবারটাও যায় তাইলে কিন্তু আমি এক্কেবারেই শেষ।
শরীফ সাদর
১১/০৫/২০২০
ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড, নরওয়ে।