কানাডা আসার পর লুনা-খুরশিদের পরিবারের বাইরে বেশি সময় কেটেছে মাসুদের সাথে। মাসুদের বিষয়ে ইতোপূর্বে বলেছি। তার প্রসঙ্গ এসেছে বিভিন্ন জায়গায়।
আমি ছাত্র ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এসে ঐতিহাসিক কারনেই বাংলাদেশ ছাত্র সমিতি নামে একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করি। সেই ছাত্র সমিতির অন্যতম সংগঠক ও নেতা ছিল এই মাসুদ।
প্রথমে দীর্ঘদিন ছাত্রসমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সেক্রেটারি ও পরে সভাপতি পদে থেকে মাসুদ সংগঠনটিকে একটি উন্নত মানের সংগঠনে পৌঁছাতে চেষ্টা করে।
তার সময়ে অনেক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনেও ছাত্রসমিতি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সামর্থ্য হয়েছে। আমার স্ত্রী নুর-ই আকতার (স্বপ্না)ও ঐসময়ে কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে।
মাসুদ একসময়ে লেখা পড়া করতে রাশিয়া যায়। প্রথমে লেখাপড়া ও পরে ব্যবসায়িক কাজে জড়িয়ে মস্কোতেই থেকে যায়। এরপর কী মনে করে এখন স্ত্রী ও দুই ছেলেসহ কানাডায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে!
মাসুদ আমার ছোট ভাইয়ের মতো। তার প্রাধান্যও আমার নিকট বেশি। মাসুদের সাথে ড্যানফোর্থে আড্ডা হয়েছে বেশি। টিম হর্টনে কফিও খাওয়া হয়েছে বেশি। মেসেঞ্জারে ও ফোনে কথা হয়েছে সবচে বেশি।
মাসুদের সাথে যতটা ঘুরাঘুরি করার কথা ছিল ততটা হয়ে উঠেনি। ইচ্ছে ছিল উভয়েরই। সময় সুযোগ হয়নি। আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে তার বাসা অনেক দুর।
লুনা-খুরশিদের বাসা লরেন্স -মেন্স ইন্টার সেকসনের হেরনপার্ক প্লেস (যেখানে আমরা থাকি) আর মাসুদের বাসা ডাউন টাউনে। ওর বাসা কানাডার টরন্টোর কেন্দ্রস্হলে, বিখ্যাত সিএন টাউয়ার সংলগ্ন। তার বাসা থেকেই সি এন টাওয়ারের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় এবং নৈশকালীন নৈসর্গিক দৃশ্যও অবলোকন করা যায়।
এবছরের ২০ অক্টোবর কানাডার টরন্টোতে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের একটি স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। স্মরণসভাটি অনেকটা এককভাবেই দায়িত্ব নিয়ে সম্পন্ন করে মাসুদ। কবি আসাদ চৌধুরী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। অনেকের সাথে, আমিও সে অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখি।
কথা ছিল, এ অনুস্ঠানের পরপরই মাসুদ ও আমরা এদিক-সেদিক ঘুরতে বের হবো। অটোয়া যাবারও পরিকল্পনা ছিল আমাদের।
মাসুদ ও তার স্ত্রী নাহার একসপ্তাহ যাবত বলে বলে ৪ নভেম্বর একটা দিন ধার্য্য করলো। আমরাও রাজী হলাম। মাসুদ আমাদের জন্যে কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে। ঘুরিয়ে দেখাবে কানাডার অনেক কিছু।
নভেম্বরের ০৪ তারিখ সোমবার। প্রচন্ড ঠান্ডা। অফিস খোলা, কাজের দিন বিধায় লুনা ও খুরশিদ অফিসে চলে গেছে। আমি ও আমার স্ত্রী টিটিসি সাবওয়ে ধরে লরেন্স থেকে ব্রডভিউ স্টেশনে পৌঁছি।সেখানে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল মাসুদ।
মোবাইলে যোগাযোগ হলো। আমরা মাসুদের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। সে বললো, আজ সারাদিন ঘুরবো, বেড়াবো আর খাবো। রাতে আমাদের বাসায় থাকবেন। আর না হয় রাত ১১/১২টার দিকে আমরা আপনাদের লরেন্সের হেরনপার্কের বাসায় দিয়ে আসবো।
মাসুদের গাড়িতে তখন বাজছিল একটি পরিচিত নজরুল সংগীতের সুর। আমাকে সামনে বসতে বলে তার ভাবীর জন্যে দরজা খুলে পেছনের সীটে বসার ব্যবস্হা করে দিল। গাড়িতে আমরা সর্বসাকুল্যে যাত্রী ০৩ জন।
মাসুদ গাড়ি ড্রাইভ করছিল। ফাঁকা রাস্তা। দেখেশুনে গাড়ি চালিয়ে ইউটার্ন নিচ্ছিল। হঠাত পিছনের দিক থেকে দ্রুত গতিতে একটি গাড়ি এসে মাসুদের গাড়িটিকে প্রচন্ড ধাক্কা দেয়। বিরাটকায় এক শব্দ হলো। তারপর শুধু বিস্ময়ের পালা। অচিন্তনীয় ব্যাপার। গাড়িটি চালাচ্ছিল এক ভদ্র মহিলা।
মাসুদের গাড়ির সামনের অংশ দুমড়ে-মুচড়ে যায়। মাসুদ পায়ে এবং হাটুতে ব্যাথা পায়। গাড়ি একেবারে অচল হয়ে গেলেও আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা প্রাণে বেঁচে যাই। যে ধরনের দুর্ঘটনা তাতে আরও অনেক বড় কিছুই হতে পারতো।
মাসুদ নার্ভাস হবার পাত্র নয়। তবু এত বড় ঘটনা! সে তার স্ত্রীকে (নাহার ভাবিকে) ফোন করে ঘটনা জানিয়ে স্পটে আসতে বললো। নাহার ভাবি তখন বাসায় আমাদের জন্য রান্নাবান্না করছিল।
নাহার ভাবি আসার পর মাসুদকে বেশ হাল্কা মনে হলো। পুলিশ ও এম্বুলেন্স আগেই এসে কাজ শুরু করছে যে যার মতো। এম্বুলেন্সের ভেতর মাসুদকে উঠিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাও প্রদান করা হয়েছে।
পুলিশকর্মকর্তারা একটু পর পর মাসুদ আর ধাক্কা দেয়া গাড়ির মহিলা, যিনি ঐ গাড়ি ড্রাইভ করছিলেন, তাকে ডাকছেন। লেখালেখি করছেন। পথচারীদের মধ্য থেকেও স্বাক্ষ্য নিচ্ছেন।
এখানকার কাজ শেষে গাড়িটি ক্রাইসিস সেন্টারে নেবার পালা। ইনসুরেন্স কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করা। ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যে সকল কিছুই করতে হলো।
আমরা ৪ জনই ক্রাইসিস সেন্টারে গেলাম। গাড়িও ক্রেনে করে টেনে আনা হলো এখানে। কেস লেখানো হলো। দীর্ঘ সময়ের কাজ।
এরমধ্যে মাসুদ ইন্সুরেন্স কোম্পানীর সাথে কথা বলে অন্য একটি গাড়ির ব্যবস্হা করলো। কেস ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত প্রাপ্ত গাড়িটি চালাবে মাসুদ। আরও কত ফর্মালিটিজ!
এতো কিছুর পরও আমাদের ছাড়লোনা মাসুদ ও মাসুদের স্ত্রী নাহার । যা করার সবই করলো। ওদের বাসায় থাকার জন্যে আন্তরিকভাবেই বলছিল। মাসুদের মতো নাহার ভাবির আন্তরিকতাও মনে রাখা মতো।
মাসুদের বাসায় অনেক পদের খাবারের আয়োজন ছিল। মাসুদ ও নাহার ভাবি অতি যত্নের সাথে খাবার খাওয়ালো। এদের আতিথিয়েতা ও আন্তরিকতা মনে রাখার মতো।
খাবারের পর রাত ১১ টারও বেশি। কোন ক্লান্তি নেই। কোনো দুঃখ নেই। এত বড় ঘটনা ও ক্ষতির পরও ওরা দুজন আমাদেরকে গাড়ি করে নামিয়ে দিয়ে এলো হেরনপার্ক প্লেসের বাসায়। এই গভীর রাতেও মাসুদই যথারীতি গাড়ি ড্রাইভ করছিল।
কী হবার কথা ছিল, কী হয়ে গেলো? আলহামদুলিল্লাহ। কেটেগেলো একটি আনন্দ ও দুর্ঘটনার দিন। স্মৃতিময় ও ঘটনাবহুল একটি অনন্য দিন।