ডায়াবিটিস যে আমার আছে তা বুঝতাম অনেক আগে থেকেই, কারণ আমার গুষ্ঠিতে তো আছেই আমার ইনল’ গুষ্টিতেও আছে যদিও কার কার আছে সেটা সংগত কারনে গোপন রাখতে হবে, নইলে আমার শ্বশুর সাহেব গত হওয়ার পর যেটুকু খাতির যত্ন এখনো অবশিষ্ট আছে তা আর থাকবে না। যাই হোক আগের কথায় আসি; আমার ডায়াবিটিস এর পুরা লক্ষণ দেখা দেয়া সত্ত্বেও কখনো ডাক্তারের কাছে যাই নাই ধরা খাবার ভয়ে। একবার যদি ডায়াগনোস করে ফেলে তাহলে তো সব মজার খাবারই হারাম হয়ে যাবে, কিন্তু বিধি বাম, বৌ কিভাবে কিভাবে জানি ষড়যন্ত্র করে ফ্যামিলি ডাক্তার কে গোপনে বলে দিলো সে যেন আমাকে সুগার পরীক্ষা করতে বলে। তাই হ’ল; ল্যাব রিপোর্ট দেখে ডাক্তার চিৎকার দিয়ে উঠলো (ড্রামা কুইন), “তোমার ব্লাড সুগার এত হাই যে এই পর্যায়ে গেলে মোটামুটি জানাজা পড়তে হয়”,মনে মনে বলি আরে ধ্যাৎ, এত ঢঙের কি আছে, যত্তসব!
আরো কিছুক্ষন ধানাই পানাই করে এক গাদা ওষুধ আর রেস্ট্রিকশন সহ আমাকে একটা আতংকময় জিবনের অশনী সংকেত দিয়ে ভাবলো একদম দুনিয়া জয় করে ফেলেছে। প্রতিদিন আঙ্গুল ছিদ্র করে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে, প্রতি ৩ মাস পর পর ব্লাড ওয়ার্ক (ল্যাব এ গিয়ে রক্ত পরীক্ষা) করতে হবে, হসপিটালে গিয়ে কাউন্সিলিং সেশনে বসতে হবে ইত্যাদি এক গাদা ফ্যাকড়া ধরিয়ে দিল। বেশ কয়েকদিন ঝিম মেরে ছিলাম যে জীবনটা বোধহয় শেষই হয়ে গেলো কারণ মদ খাই না, জুয়া খেলি না, সিগারেট পর্যন্ত খাই না, একমাত্র শখ একটু মজার মজার খাবার খাওয়া, তাও যদি না খেতে পারি তাহলে আর এই ঘোড়ার ডিমের দুনিয়ায় আছে কি। দাওয়াতী ফ্রেন্ডরা তো মনে মনে মহা খুশি যে একটা খাদকের কবল থেকে বোধহয় এবার বাঁচা গেছে!
নিমন্ত্রণগুলিতে হোস্টরা বেশ কিছুদিন ডায়াবেটিক রুগীরা খেতে পারে সেরকম করে একটা দুইটা আইটেম রাখলেন মেনুতে। বেশ আয়োজন করে সেসব মেনুর ছবি তুলে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া হ’ল। এক বাসায় ইফতারির আগে একটা ছবি তুলল এরকম, টেবিলে সাজানো ১০/১২ গ্লাস শরবতের মধ্যে একটা গ্লাসে কাগজ প্যাচানো (পার্কে বিয়ার খাবার সময় এদেশের লোকজন যেভাবে কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে নেয়) যাতে লেখা “মুন্না ভাইর ডায়াবেটিক শরবত”। সেই গ্লাস সামনে নিয়ে আমি লাজুক মুখে গায়ে হলুদের বরের মতো বসে আছি আর আমার পিছনে ১০/১২ জন ভাবি হাতে ভি চিহ্ন নিয়ে পোজ দিয়ে দাঁড়ানো যেন ডায়াবেটিক শরবত না, আমার সামনে ওটা মৃত সঞ্জীবনী সূরা – যা পান করা মাত্রই আমি নব জীবন লাভ করতে যাচ্ছি এবং এর পর আর ওনাদের চিনবো না তাই এই শুভ মুহূর্তটা ফ্রেমে ধরে রাখা।
উপরের বর্ণনাগুলো ছিল আমার ডায়াবিটিসের স্বর্ণ যুগের। সেই অবস্থা এখন আর নেই । ডায়াবেটিক শরবত বা ডায়াবেটিক মিষ্টি এখন আর কেউ তৈরি করেন না। ওনারা এখন ফতোয়া বের করেছেন, যেহেতু আর্টিফিশিয়াল সুগার বেশি খারাপ তাই অরিজিনাল সুগার দিয়ে বানানো জিনিসই অল্প করে খাওয়া মংগল জনক। ইভেন আমার এক হুলুস্থুল টাইপ বড়োলোক বন্ধু (তাকে বড়োলোক বললে সে মহা খুশি হয় এবং ‘আরেকটু’ বেশি ফুলে গিয়ে গাঢ় বেগুনি রংএর বেশ লাজুক একটা হাসি দিয়ে চোখ পিট পিট করে তাকায় ) যে কিনা তুড়ি মারলেই সব দোকান পাট একদম মালিক সহ তার দরোজায় হাজির হয়ে যায় (অন্তত সেইরকম গল্পই শুনি) সেও আজকাল আমার জন্য স্পার্কলিং ওয়াটার রাখতে কেমন জানি ইচ্ছা করেই ভুলে যায়।
অতি প্রিয় কেউ মারা গেলেও নাকি ৩ দিন মাত্র শোক থাকে। কাছের মানুষ গুলিও তারপর নাকি ব্যাস্ত হয়ে যায় চলতে থাকা দুনিয়ার সাথে গতির প্রতিযোগিতায়। আসলেই কি তাই ? আমার বিশ্বাস হয় না। তাহলে সবাই ভুলে গেলেও আমার বেগম সাহেব কেন এখনো আমাকে মিষ্টি জাতীয় কিছু খেতে দেখলেই ব্লাড সুগার কবে মেপেছি জিজ্ঞেস করতে ভুল করে না! সে অবশ্য সাথে সাথে কিছু বলে না, যদি সকালে একটার বদলে ২টা সুগার দিতে দেখে কফিতে তাহলে রাত্রে তার কমেডি শো দেখার প্রিপারেশন নিতে নিতে যখন বোঝে যে আমিও ঐদিনের টক্ শো গুলো দেখার জন্য কানে বিট সোলো লাগাতে যাচ্ছি একদম ঠিক তখন বলবে কথাটা। ফলে টক্ শোর বেশ কিছুটা সময় কান শুধু ঝা ঝা করতে থাকে – জেনারেল ইব্রাহিম, নবনীতা চৌধুরী অথবা ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাকে মনে হয়ে মূকাভিনয় করছেন।
বিয়ে করবোনা বলে মোটামুটি ফর্মাল ঘোষনা দিয়ে রাখলেও বড় বোন এক সময় ঘাঁড় ধরে বিয়ে দিয়ে দিলো অজানা অচেনা এক মেয়ের সাথে। সেই মেয়েই কিনা দেখি এখন আমার সুখ দুঃখের মহা কাব্য। অবাক হয়ে দেখি এতগুলি বছর ধরে সে আমার যত খামখেয়ালির সাথে, সংসার নামের একটা অদ্ভুত ব্যাপারের সাথে কিভাবে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে! সে সকাল সন্ধ্যা অফিস করে, খায় দায়, ঘোরে ফেরে, আতিথেয়তা করে, দুনিয়ার সব আত্মীয় স্বজনের এনিভার্সারি মনে রাখে, মাঝে মাঝে চমৎকার সব ফানি আইডিয়া দেয়। অন্যদিকে, খেতে বসে মাঝে মাঝে নিজের কাপড়ে খাবার ফেলে ভেজা বিড়ালের মতো এক্সপ্রেশন দেয়া ছাড়া খুব একটা সমস্যা টমস্যায় নিজেও কখনো পড়েনি আমাকেও ফেলেনি আমাকে, বরন্চ আমার বহুত সমস্যা আল্লাহ তা’র মাধ্যমে সমাধান করিয়ে দিয়েছেন। আমার অসুখ বিসুখ করলে দেখি অনেক রাত্রে উঠে কুটুস কুটুস করে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে। তাতে আবার আমি ভালোও হয়ে যাই! মাঝে মাঝে আমার যখন মন টন খারাপ থাকে তখন দেখি অনেক যত্ন করে রান্নাবাটি করে কাছের কিছু লোকজনকে ডেকে খাওয়ায় কারণ জানে আমি লোকজন পছন্দ করি, আরো অনেক ব্যাপার স্যাপার আছে যেগুলো এই ওপেন ফোরামে বলাটা মনে হয় শোভন হবে না।
আমার ড্যাটাবেটিস ধরা পড়ার পর সে ইন্টারনেট ফেট ঘেটে ঘুটে ক্যাকটাস গেলার মতো একটা মেনু তৈরী করলো। তো সেই মেনু অনুযায়ী খাওয়া দাওয়া করে এক সপ্তাহে আমার ডায়াবিটিস বলতে গেলে নাই এর পর্যায়ে চলে আসলো। ব্যাস, আর যায় কৈ, সব রেস্ট্রিকশন উধাও, যা ইচ্ছা তাই মোটামুটি খাওয়া শুরু করলাম, শুধু ত্রৈমাসিক রক্ত পরীক্ষার কয়েকদিন আগে থেকে সেই মেনুতে চলে যাই, ব্লাড রিপোর্ট গুড আমার ডাক্তারের মুডও গুড। আমার মতো ছা পোষা ডায়াবেটিক হাসব্যান্ডদের প্রত্যেকের জীবনেই এরকম একজন সঙ্গিনী থাকা অবস্যই জরুরি।
ভ্যালেন্টাইন্স ডে যেহেতু কোনো সরকারি ছুটির দিন না এবং বাংলাদেশের মতো এই দিনটি নিয়ে এখানে এত আস্ফালন ও হয় না, তবুও ঐদিনটা আসলে কেমন জানি একটু রঙিন রঙিন ভাব হয়। ইচ্ছা করে একটু গোলাপ টোলাপ কিনে টিনে বাসায় যাই কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। আর এবারের ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে তো থাকতে হবে হসপিটালে আজাইরা এক টেস্টের জন্য। এই দেশের ডাক্তারদের এতো কিসের টেনশান কে জানে! ওদের কারণে বিভিন্ন টেস্ট ফেস্ট করাতে হয় প্রায় প্রতিনিয়ত। মেমোরিটা আগের মতো কাজ করে না। দেরি হলে আবার না ভুলে যাই, তাই একটু আগেই লেখাটা পোস্ট করলাম সদ্য ক্যান্সারের শঙ্কামুক্ত হওয়া আমার একমাত্র বৌয়ের জন্য – আমার কখনোই বলতে বাধেনি, “প্রতিটা দিনই আমাদের ভালোবাসা দিবস”। আমার প্রীয়জনদের, বন্ধুদের, যারা এই লেখাটা ধৈর্য্য নিয়ে পড়েছেন, তাদের সবার ভালবাসা সারাজীবন অটুট থাক। দোয়া করি, প্রতিদিনই হোক আপনাদের ভালবাসা দিবস।