ড্যানিয়েল রোজারিও।
কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের সংস্পর্শে থাকতে এক রকম ভালো লাগা কাজ করে। এটা হয়ত সবার ক্ষেত্রেই হয়। ছোট, বড়, মাঝারি সবার বেলায় হয়। ভালো লাগা কেউ বলে হঠাৎ করে হয়, আবার কেউ বলে সময়েই কাছে থাকার কারনে এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করে। আমি নিজেও জানি না তাই এ বিষয়ে বেশি দূর না যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের লক্ষ্মণ।
বড়ই চুপচাপ গোছের মানুষ। শান্ত স্থীর চোখের চাহনি। মূলত ওটাতেই আমাকে আকৃষ্ট করেছে। নাহ্ করেছিলো। না না আমি বলবো করেছে। কারন আমি চাই তো আজও বর্তমান হয়েই থাকুক। প্রথম দেখাটা প্রায় পাঁচ বছর আগের। লিফটের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। অশান্ত মন লিফট আসতে দেরী হচ্ছিল বলেও বিরক্ত। এই বিষয়টি কখনও লুকাইতে পারলাম না। বিরক্ত হলেও চোখে মুখে প্রকাশ আবার আনন্দ হলেও প্রকাশ। মুখোশ পড়ার এতো চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে আজ আর চেষ্টার কিঞ্চিৎ চেষ্টা ও করি না। পিছন থেকে হুইলচেয়ার নিয়ে আমার পাশে দাঁড়াল হালকা আকাশি রংয়ের এপ্রোন পড়া একজন। তখনও না তাকিয়েই এক প্রকার বিরক্ত নিয়েই দাঁড়িয়ে। ভাবছিলাম অনেক আগের বারডেম এ একবার যথেষ্ট তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল লিফট নিয়ে। এবারও কি তাই হবে? কিন্তু এটা তো উন্নত জায়গা। তাও ভালো লিফটের ভিতরে না। অবশেষে যখন লিফটের দরজাটা খুললো আমিও ভিতরে যে দাড়াতেই সেই প্রথম চোখে চোখ পড়া। শান্ত চোখে কি মায়ায় আমাকে টেনেছিলো আজও বলতে পারবো না তবে আমি ঐ চোখজোড়া খুঁজে পাবো না জেনেও খুঁজি। ২৭ তলার ০৫ কক্ষ টিতে সে ছাড়া আর কেউ থাকতো না। ড্যানিয়েল একটু চুপচাপ থাকতেই ভালোবাসে। সার্বক্ষনিক তত্বাবধানে যে মেয়েটি ছিলেন তার কাছে একদিন জানতে চাইলাম ওর কেউ আসে না। অবাক হয়েছিলাম, সাতটি ছেলেমেয়ে প্রতি সানডে ( রবিবার প্রার্থনা শেষে ১৫/২০ মিনিটের জন্য দেখা করে চলে যায়।ভালোবাসা বলতে এতোটুকুই, আসে, ফুল দেয়, মিস করে, জড়ায় ধরে তারপর চলে যায়।শেষ। বাকি দিন গুলি ভদ্রমহিলা একা।
—-জানার আগ্রহটা বাড়তে থাকে। হয়ত ঐ প্রথম দেখার ভালো লাগায়। রোজ একবার আমার যেতেই হবে। একদিন আমি যেতেই একজন নার্স আমাকে ভেতরে যেতে বললো। আমিও কেমন জেনো হয়ত ভয়ে নয়ত ভালো লাগায় পায়ের জোরটা কমে অসার হয়ে আসছিলো।সবটুকু সাহস জুগিয়ে সামনে দাঁড়াতেই কিছু হয়ত বললো, কিন্তু আমার মাথার ভিতর কিছুই ঢুকলো না আমি তাকিয়ে থাকলাম। মজার বিষয় হলো, বেশিরভাগ সময় আমি ভাষায় আর সে তার ভাষায় কথা বলতাম। অথচ কিভাবে কি বুজতাম জানি না, আর ড্যানিয়েল ও কি বুজতো বলতে পারবো না। কেমন একটা বন্ধু হয়ে গেলাম ৭৩ বছরের বৃদ্ধা মহিলার। যার একটা সময় সব ছিলো। যে রুজভ্যালি হসপিটালে নিজ কর্মে দাপুটে সাইকোলজিস্ট ছিলেন। তার কাছেই নানান গল্পের, নানান কাহিনী জানার সৌভাগ্য হয়। বাংলায় যাকে বলে পাগলের ডাক্তার। আশ্চর্য নিজেই কেমন পাগল হয়ে গিয়েছিল। সবার ধারনা অতিরিক্ত নিজের ব্রেনে চাপ দেওয়ার ফলেই এমনটা। কিন্তুু আসলে সে তার ছোটবেলায় কিছু স্মৃতি ভুলতে পারেনি। বয়সটা এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তার ঐ স্মৃতি গুলো ভিড় করে তাড়াতে থাকে।পারিবারিক জটিলতায় তার চোখের সামনে মাকে অপমান করে হত্যা আর বাবাকেও পরে হত্যা করে তারই পরিচিত লোক।সে আজও জানে না তাকে কেন বাচিয়ে রেখেছিলো..
—- শেষের দিনগুলো ড্যানিয়েল কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলো। আমাকেও চিনতে পারত না। তবুও যেতাম হয়ত ভালোবাসায়। আমি জানি সব হত্যার একটা কারন যেমন থাকে তেমনি পাগল বা মানসিক ভারসাম্যহীন হবারও কোন না কোন কারন থাকে। অশান্ত কে শিকলে বাঁধতে হয় আর শান্তকে ভালোবাসায় বাধতে হয়। কে জানে হয়ত ভালো হয়েও যায়। কম বেশি তো থাকেই। —— আজ এক প্রকারের একাকিনী, তুমি ভালো আছো হয়ত ঘুমিয়ে। কিন্তু আমি জানি তুমি ছিলে সুস্থ, সুস্থ মানুষেরা তোমায় করেছিলো অসুস্থ। ®
নীলিকা নীলাচল ***