ফ্লোরিডা থেকে:-
বাড়ীর পূব দিকে ছিল আমাদের মস্তবড় পুকুর , তারপরে রথখোলার পুকুর । শুকনোর সময়ে দুই পুকুরের সীমা নির্ধারণ কারী ছোট আলটি জেগে উঠতো, কিন্তু বরষায় দুই পুকুর মিলে হত এক মস্ত দীঘি । বাম দিকে আমাদের বাগান বাড়ী , গাছ গাছালীতে ভরা। সেই বাগান বাড়ীর পূর্ব সীমান্তে বিশাল বাঁশঝার , তার পরে একটু নীচু জায়গা দশ পনর গজ প্রশস্ত , যা বর্ষায় হত আমাদের দুই পুকুরের সাথে আমাদের বাড়ী ও বাগান বাড়ীর উত্তর দিকের বড় দিঘলী- কনকসার খালটির সংযোগ কারী ছোট খাল। পূর্ব উত্তর কোনায় একটা বিশাল গাব গাছ আর তার নীচে লেট্রিন। তখন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিলনা। রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকার বাসা বাঁধতো এই গাব গাছে , গ্রামের সমস্তগুলো ভুত থাকতো এই গাছের ডালে ডালে, পাতায় পাতায়। রাতে কখন ও যদি এর কাছাকাছি যেতে হোত আয়াতুল কুরসী পড়ে বুকে ফু দিতে দিতে যেতাম।এই সুরার ছিল অসামান্য শক্তি , কোন ভুত প্রেত আমাদের স্পর্শ করেনি কোনদিন। কোণায় যে বাড়ীটি ছিল রথখোলা সন্নিহিত লেট্রিনটি ছিল সে বাড়ীর। ওরা মুসলমান ছিলনা। আয়াতুল কুরসী ওরা পড়েনি তবে ওদের কাউকে ও ভুতে ধরেনি কখনও। ধারনা করি তাদের ও হয়তো কোন শক্তিশালী মন্ত্র ছিল। এছাড়া পুকুরের পূব পারে ছিল বেশ ক’টি বাড়ী । একটা মস্ত ঝাকরানো হিজল গাছ ছিল পূব পারে , বর্ষায় পাতা গুলো ও হিজল ফুল জল ছুয়ে থাকতো। জলের স্রোতে সেই পাতাগুলো নড়তো আর জলের বুকে আঁচড় কেটে অগভীর ক্ষতের সৃষ্টি করতো। পূব দক্ষিন কোণায় অনেক গুলো হিজল গাছের মধ্যদিয়ে তৈরী হত আর একটি খাল শুধু মাত্র বর্ষাকালে যা সংযোগ করতো ব্রাহ্মণগাঁও হাই স্কুল ও পাইকারাকে । নৌকা দিঘলী- কনকসার খাল থেকে পূব উত্তর কোণা দিয়ে ঢুকতো আমাদের পুকুরে, তারপর পূব দক্ষিণ কোণা দিয়ে বেড়িয়ে যেত। ওই কোণায় আধডোবা হিজল গুলোর ফাঁকে ফাঁকে ছিল অসম্ভব স্রোত ও ঘুর্নিজল। এখানে বড় নৌকা চলার মত প্রশস্ততা ছিলনা কিন্ত কোসা নৌকা বা ছোট “কেরাইয়া” নৌকা চলতো। আর ছোট এই নৌকা গুলো কখনও কখনও ডুবে যেত সেখানে ।
একবার আমাদের গ্রামের গৌরাঙ্গ দা নৌকা বাইতে ছিল। সে নৌকায় ছিল খুব সুন্দরী ও যৌবনবতী এক নারী, গ্রামেরই এক বৌদী, তার কপালে লাল সিঁদুর আর চোখে কাজল, চুল ছিল কোমর পর্যন্ত, যাকে বলা হত মেঘ কালো চুল । আর তার দেহে ছিল বর্ষা হিজল যৌবন। আমি ছিলাম সেই নৌকায় ছোট আর সেই বৌদির ছোট্ট ফুট ফুটে মেয়ে আড়াই কি তিন বছরের ।
গৌরাঙ্গদা ছিলেন ভালো ছেলে, ভালো ছাত্র এবং বেশ ছিল তার সুনাম । সেই দিন তার কি মনে হল , তিনি নৌকায় একটি দুলুনী দিয়ে বললেন , “বৌদী দেই নৌকা ডুবাইয়া” ? নৌকার দুলুনিতে বৌদী সন্ত্রস্ত , বললেন , “না লক্ষ্ণী ভাই, না”
বাচ্চা মেয়েটি কেঁদে উঠল। দাদা লজ্জিত হলেন।
এরই মধ্যেই নৌকা এসে গেল পূব দক্ষিণের সেই দুর্দান্ত স্রোতের জায়গাটিতে । কোন অশুভ শক্তি যেন প্রচন্ড গতিতে নৌকাটিকে টেনে নিতে লাগলো, গৌরাঙ্গ দা নৌকার কন্ট্রোল হারালেন , ঘুর্ণির মধ্যে যেয়ে প্রচন্ড ঝাঁকুনি খেয়ে নৌকা উল্টে গেল।
গৌরাঙ্গ দা, বৌদী, আমি সাঁতরে রেহাই পেলাম, বৌদির ছোট্ট মেয়েটি নিঁখোজ হয়ে গেল, জলস্রোত তাকে কোথায় নিয়ে গেল কোন হদিসই করা গেলনা। দুদিন পরে তার মৃতদেহ ভেসে উঠলো হিজল গাছের ঝোপের মধ্যে জলে ডুবানো ডাল পালার মাঝে।
সারা গ্রামে শোক নামলো, কেউ কেউ গৌরাঙ্গদাকে তিরস্কার ও দোষারূপ করলো যে সেই ইচ্ছে করে এই দুর্ঘটনাটি ঘটিয়েছে , যদিও তার কোন মোটিভ খুঁজে পাওয়া গেলনা।
আমি সেই বৌদিকে কাঁদতে দেখেছিলাম পাগলীনির মত আলু ঝালু চুলে, আমি গৌরাঙ্গদাকে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে খালি হাসতে দেখেছিলাম । তারপরে আমাদের গ্রামে এল যুদ্ধ । সেই দেশ আর সেই দেশ রইলোনা । অপ্রকৃতিস্থ গৌরাঙ্গদার হাব ভাব চাল চলন দেখে মিলিটারীদের তাকে মুক্তিযোদ্ধা বলে সন্দেহ হল, তারা তাকে ধরে নিয়ে গেল। অথচ বৌদী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না , তিনি ছিলেন একজন অতি সুন্দরী বাংগালী নারী।
সেই বৌদী, সেই গৌরাঙ্গদা কোথায় হারিয়ে গেলেন । না তাদের কোন চিহ্ন বা স্মৃতি সেই গ্রামে আর নেই । সেই গ্রাম , সেই পুকুর, সেই উন্মত্ত কাটালের হিজল বীথিও ধুয়ে মুছে গেছে পদ্মায়। সেই ছোট্ট মেয়েটির কথা কেউ মনে রাখেনি এবং আমি যখন চলে যাবো সে মুছে যাবে চিরতরে , মানব সমাজের স্মৃতি হতে।