আফরোজার তেমন ভাল ঘুম হলো না রাতের বেশিরভাগ সময়েই এপাশ ওপাশ করে রাত কাটিয়েছে। ভোরের দিকে মুয়াজ্জেন সাহেবের আজান শুনে ঘুম ভেঙে যায়। এমন সময় ফোন বেজে উঠে ।
আপা, আমি কি তোর ঘুম ভাঙ্গালাম?
-“না, কি খবর বল ?” চোখ রগড়াতে রগড়াতে আড়মোড় ভেঙ্গে আফরোজা বলে :
-“রাতে তোর দুলাভাই বাসায় ফেরেনি, বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে অনেক রাতে শুয়েছি, কি ব্যাপার , এত সকালে ফোন ?”
-“তোরাতো এখন সেলিব্রেটি হয়ে গেলি রে আপা. কিছুটা তামাশাচ্ছলে নয়ন তার মেঝো আপাকে বলে।”
-“হেয়ালি না করে খুলে বল কি হয়েছে।”
-“আমাকে না বলে অনলাইনে আজকের খবরের কাগজ খোল বা ফেস বুক খোল. বস্তা বস্তা চুরি করা ত্রানের চাল সহ দুলাভাইয়ের ছবি। এ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়াতে দুলাভাইয়ের হাত করা পরা ছবি তো রীতিমতো ভাইরাল” !
এ পর্যায়ে আফরোজা বাচ্চা মেয়েদের মতো টেলিফোনে হাউ মাউ করে কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। নয়ন আপাকে সান্তনা দেয়।
-“আপা , এখন কান্না কাটি করে আর কি হবে , হাত মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে থাকে, সাংবাদিকরা বাসায় এলোবলে। সাংবাদিকরা তোর ইন্টারভিউ নিবে, তো কে জিজ্ঞাসা করবে , আচ্ছা আপনার স্বামীতো দুই টার্ম ধরে মেম্বার , এ ছাড়া আপনার শুশুর মশায় চেয়ারম্যান, আপনাদেরতো অভাব থাকার কথা না , তার পরেও আপনার স্বামী দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে ত্রানের চাল চুরি করার মতো জঘন্য অপরাধ করলেন কিভাবে ?”
ছোট ভাইয়ের মুখে এসব শুনে আফরোজার কান্নার গতি আরো বেড়ে যায়। বিলাপ করতে থাকে, “হে আল্লাহ এখন কি হবে? আমার বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন সবার কাছে মুখ দেখাবো কিভাবে ?” আফরোজার কান্নার শব্দে দুই বছরের মেয়ে তুলি ও পাঁচ বছরের মেয়ে তিথি চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। আফরোজা ফোন রেখে , কান্না থামিয়ে ফজর নামাজ শেষ করে স্বামীর জন্য বিশেষ মোনাজাত করে।
আজকে থেকে প্রায় বছর সাতেক আগে আফরোজার সাথে নাবিল চৌধুরীর বিয়ে হয়েছিল পারিবারিক সম্মন্ধের মাধমে। নাবিল চৌধুরীর বিয়ের প্রধান যোগ্যতা ছিল পাত্র চেয়ারম্যানের ছেলে, আর বাকি যোগ্যতা হলো, পাত্র প্রভাবশালী রাজনীতির সাথে জড়িত, থানা পর্যায়ের নেতা, দফতর সম্পাদক, ইসলামিক হিস্ট্রিতে অনার্স সহ বি এ পাশ করে সদর থানার ৫ নং ওয়ার্ডের মেম্বার। বাবা সরাফত চৌধুরী সদর উপজেলার চেয়ারম্যান। বাংলাদেশের একজন টিপিক্যাল চেয়ারম্যানের যত গুণাবলী থাকে তার প্রায় সবই এই সরাফত সাহেবের আছে; অর্থাৎ, পরোপকারী, অতিরিক্ত ধর্ম পরায়ণ, এলাকার বেশ কিছু স্কুল মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষক, স্থানীয় মসজিদের মুয়াজ্জিন সাহেবের দিনে তিনবার খাওয়াদাওয়া উনার বাসায়ই হয়ে থাকে। এমনকি, এলাকার দরিদ্র মানুষেরা যারা বিভিন্ন এনজিও -র কাছ থেকে নানাবিধ প্রকল্পের নামে সুদে টাকা নিয়ে সময়মতো না দিতে পেরে বিশেষ ঝামেলায় পরেছেন এমন মানুষদের টাকা ধার দিয়ে সাময়িক বিপদ থেকে উদ্ধার করার ক্ষেত্রে এলাকাতে সরাফত সাহেবের বিশেষ সুনাম আছে। এসব কারণে, শরাফত সাহেব অনেক বছর ধরে এলাকাতে ফিবছর সফলতার সাথে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এহেন ফেরেস্তার মতো সরাফত চৌধুরীর সয়সম্পত্তির পরিমান বছরের পর বছর কিভাবে ফুলে ফেঁপে উঠেছে সে এক বিরাট রহস্য।
নাবিল চৌধুরীর সাথে বাবা সরাফত চৌধুরীর অকাশ পাতাল পার্থক্য। নাবিল চৌধুরী বাবার মতো ধর্ম পরায়ণ নয়, মাথায় অতো ক্ষুরধার বুদ্ধি রাখেনা। তবে মূল যে পার্থক্য সেটা হচ্ছে সরাফত সাহেব যেমন ধীর স্থির, পাছায় সজোরে লাত্থি খেলেও হাসি মুখে হজম করবেন , নাবিল চৌধুর যেন ঠিক তার উল্টা স্বভাবের। একেবারে রগচটা, অতিরিক্ত বদ রাগী। বি এ পরীক্ষার সময় এক বন্ধুকে নকল ধরার অপরাধে পরীক্ষার পরিদর্শককে একেবারে বিব্রস্ত করে নাকানি চুবানি খাইয়েছিল। তার পরেও, বিস্ময়কর ভাবে নাবিল চৌধুরী দ্বিতীয় বিভাগে বি এ পাস্ করলেন । একটি বিষয়ে বাবার সাথে নাবিল চৌধুরীর অসম্বব মিল । বাবা ও ছেলে দুই জন্যেই রেকর্ড পরিমান ব্যাবধানে ওপর পক্ষকে হারিয়ে ইলেকশনে জয়লাভ করেন। বাবা চেয়ারম্যান ও ছেলে মেম্বার।
অথচ, বিয়ের আগে আফরোজার সাথে বান্ধবী শিখা-র বড় ভাই শাকিল নামে একটি অত্যন্ত মেধাবী ছেলের গভীর প্রেম ছিল। প্রেমের গভীরতা এতটাই ছিল যে স্কুলের সেরা ছাত্র শাকিল উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় টেনেটুনে একেবারে সেকেন্ড ডিভিশনে পাস্ করলেন। আফরোজার বাবা যখন প্রতিভাবান ও উদীয়মান রাজনীতিবিদ নাবিলচৌধুরীর সাথে মেয়ের বিয়ে প্রায় ঠিক করে ফেলছেন শাকিল তখন আদা জল খেয়ে বি সি এস পরীক্ষা নিয়ে ব্যাস্ত। আফরোজা বান্ধবীর মাধ্যমে বইয়ের মাঝে গোপন চিঠি দিয়ে শাকিলকে জানায়, শাকিল যেন শুক্রুবারে বন্ধ স্কুলের মাঠের ডান দিকটায় কাঁঠাল গাছের নিচে সকাল সাড়ে দশটার সময় ওর জন্য অপেক্ষা করে। শাকিল যথারীতি বাংলা সিনেমার স্টাইলে তুমুল উত্তেজনা নিয়ে সময়মতো কাঁঠাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলো। শাকিলের ধারণা ছিল , আফরোজা হয়তো ওকে নিয়ে বাহিরে কোথাও ঘোরাঘুরি করবে, ভালো কোনো রেসুরেন্টে খাবে ইত্যাদি । আফরোজা ছোট্ট একটি সুটকেসে নিয়ে হাপাতে হাপাতে হাজির হয়ে শাকিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “চলো এখনই বিয়ে করবো ” । বেচারা শাকিলের তো একেবারে হতবম্ব অবস্থা। এমনিই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হয়েছে, সামনে বি সি এস পরীক্ষায় ভালো করার একটি সুযোগ, রিটার্ড বাবা এজমার রুগী, বাবার পেনশনের টাকা ও বুবুর টিউশনের টাকা দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে মা কোনোরকমে জাদু মন্তর করে সংসার চালাচ্ছেন । বুবুর বিয়ের ভালো কিছু সমন্দ এসেছিলো, পাছে, বুবুর টাকাগুলি হাত ছাড়া হয়ে যায় এই ভেবে মা কায়দা করে সংসারের কথা ভেবে সেসব ফিরিয়ে দিয়েছেন । বি সি এস পরীক্ষার প্রিপারেশনের জন্য শাকিলকে রাত জেগে পড়তে হয়। ব্যাথায় কাতর মায়ের গোঙ্গানি, শ্বাস কষ্টের রুগী বাবার শুকনা কাশের শব্দ ছাপিয়ে পাশের ঘড় থেকে বুবুর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শাকিলকে বেশ আহত করে, ভালো করে পড়াশুনা করার প্রেরণা যোগায়। সেই শাকিল কে এখনই বিয়ে করতে হবে ! দিশেহারা শাকিল অবুঝ আফরোজার বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।
আজ এতদিন পর ছোটভাই নয়নের ফোন এর পরে আফরোজার কেন যেন স্বামী নাবিল চৌধুরীর জায়গায় শাকিলকে বসিয়ে ভাবতে থাকে , সাকিল হলে এই জঘন্য কাজটি কখনোই করতে পারতো না । নাবিলের চুরির কথা ভাবতেই আফরোজার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠে। ছিঃ তাই বলে চোরের বৌ!!ছোটবেলা থেকেই আফরোজার বেশ টনটনে মোরাল ভ্যালু ছিল। একবার গার্লস স্কুলের কমন রুমের সামনে কড়কড়ে একটি একশত টাকার নোট পেয়ে আফরোজা সোজা হেড মিস্ট্রেসের কাছে জমা দিতে গেলো । যে রাগী হেড মিস্ট্রেসের চোখের দিকি তাকিয়ে কথা বলার সাহস কারো নেই , সেই হেড মিস্ট্রেস আফরোজাকে বুকে গড়িয়ে ধরলেন। শুধু তাই না, হেড মিস্ট্রেস পরের দিন সকালে এসেম্বিলিতে আফরোজাকে সকলের সামনে ডেকে এনে ঘটনাটি বলে আফরোজাকে বাহবা দিলেন । অথচ,আজ সেই আফরোজাকে এখন রাস্তায় বেরুলে সবাই বলবে ” এই দেখ দেখ চাল চোরের বৌ যাচ্ছে!!” ভয়ে, লজ্জায় আফরোজা এখনো ফেস বুক ওপেন করেনি। হয়তো ফেস বুক খুললেই দেখা যাবে বস্তা বস্তা ত্রানের চালের পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তারই স্বামী, কমেন্টস বক্সে পরিচিত , অপরিচিত মানুষেরা অজস্র গালি গালাজ দিয়েকুৎসিত ভাষায় মুখরোচক বাহারি কমেন্টস! ওদিকে ছোট ভাই নয়ন এর স্ত্রী রসিয়ে রসিয়ে সব কমেন্টস গুলি হয়তো নয়নকে কে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়ছে, আর খোটা দিয়ে বলছে ,”এই যে চোরের শ্যালক এই দিকে একটু দেখে যাও তোমার দুলা ভাই এর কীর্তি কারখানা !!
আফরোজার আর কিছু ভাবতে ইচ্ছা হচ্ছে না। স্বামীর উপর রাগে , ঘৃনায় আফরোজার কেমন যেন বমি বমি লাগছে। বাথরুমে যেয়ে মুখে আঙ্গুল দিয়ে আফরোজা হর হর করে খানিকটা বমি করে ফেললো । চোখে মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপ্টা দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে আফরোজ। মাথার মধ্যে রাজ্যের চিন্তা ঘুরে পাক খাচ্ছে। এমনিতেই করোনা ভাইরাস নিয়ে সারা দুনিয়াতে যখন তোলপাড় অবস্থা, আমাদের এই হতদরিদ্র দেশ দুর্বল অবকাঠামোর মধ্যে দিয়ে তবুও ত্রানের ব্যবস্থা করেছে , সেটাকেও আবার চুরি করতে হবে! !!
বাথরুম থেকে বেরিয়ে আফরোজা তাকিয়ে দেখে ছোট মেয়েটি মা মা করে কাঁদছে , বড় মেয়েটি এটা ওটা দিয়ে বোনকে বুঝিয়ে রাখার চেষ্টা করছে । বাচ্চাগুলির দিকে তাকিয়ে আফরোজার ভীষণ খারাপ লাগে। কেমন যেন মায়া মায়া লাগে। এই অবুঝ বচ্চার জানেনা ওদের শরীরে যে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে তা একজন পাপী চোরের রক্ত । আফরোজা ভাবতে থাকে, অনেক অনেক দিন পরে এই বাচ্চাগুলি একদিন বড় হবে। স্কুল কলেজে ওদের সহপাঠীরা যখন ক্লাসের ফাঁকে আড্ডায় মেতে উঠবে তখন এই মেয়েদেরকে ‘চোরের মাইয়া’ বলে টিটকারি দিয়ে শব্দ করে হাসা হাসি করবে তারই সহপাঠীরা । অথচ এদের কোনো দোষ নেই । দোষ হচ্ছে এই পচনশীল সমাজের ভ্রান্ত রাজনীতির অবকাঠামো , যেখানে সরাফত চৌধুরী, নাবিল চৌধুরীরা ভোট ডাকাতি করে চেয়ারম্যান হন, মেম্বার হন , চুরি করা সম্পদের পাহাড় বানিয়ে সভা, সমিতিতে ফুলের মালা পরে প্রধান অতিথি সেজে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান। ফেস বুকের পাতায় পাতায় শেষ সব ছবির বিশাল পোষ্ট দেয়া হয় হয়। চামচের দলেরা তোষামোদ করে হরেক রকম কমেন্টস দিয়ে সেসব ছবির স্তুবিকীর্তন করেন!! কি সেলুকাস এ দেশ !!
আফরোজা বাচ্চাদেরকে সকালের নাস্তা খাইয়ে চেয়ারম্যান শশুর মশাইকে ফোন দেয়।
-“বাবা !
– “মা , আমি সব শুনেছি, তুমি মোটেই চিন্তা করোনা। আমি এরই মধ্যে থানায় ফোন করেছি, পরিচিত উকিলের সাথে কথা বলেছি। ইন শাল্লাহ ওর জামিনমের ব্যাবস্থা হয়ে যাবে। তুমি যে কাজটি করবে সেটা হলো দুপুর তিন টার দিকে আমাদের বাসায় চলে আসবে। আমি তোমাকে নিয়ে থানায় যেয়ে ওকে ছাড়িয়ে আনবো। আর মন দিয়ে শোন, এর মধ্যে সাংবাদিকরা এলে মোটেই ঘরের দরজা খুলবে না।”
বেলা আড়াইটা নাগাদ আফরোজা ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে বড়টির হাত ধরে বাড়ির সামনের ফটক পেরিয়ে বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে যায়। আফরোজাদের বাড়ি থেকে শশুর বাড়ি খুব বেশি দূরে না। রাস্তায় বেরিয়ে আফরোজা ভাবতে থাকে ইতমধ্যে শহরের অর্ধেক লোকের মাঝে স্বামীর কুকীর্তির কথা হয়তো রোটে গিয়েছে । রাস্তা ঘাট বেশ ফাঁকা ফাঁকা। অল্প কিছু লোক মুখে মাস্ক পরে হাঁটা হাঁটি করছে। একটি উৎসাহী যুবক সালাম দিয়ে এগিয়ে এসে বললো:
“ভাবি রিক্সা লাগবে, একটু দাঁড়ান” বলে বিদ্যুৎ বেগে যেয়ে একটি মাঝ বয়সী রিক্সা ওয়ালাকে ডেকে আনলো। রিকশা ওয়ালা বিরাট একটি হাই তুলে বলে:
-“আপা চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে যামু ?”
আফরোজা মাথা হা বোধক নেড়ে বাচ্চা দুটিকে নিয়ে তাড়াতাড়ি রিকশায় উঠে হুট্ তুলে দেয়। পথ চলতে চলতে রিক্সা ওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে হটাৎ করে বলে :
-” আপা , মনে কিছু না নিলে এক খান কথা কইতাম।”
– “জী বলেন” । আফরোজার ধারণা , লোকটি হয়তো কোনো গল্প ফেঁদে টাকা পয়সা চাইবে । আফরোজাকে সম্পূর্ণ অবাক করে রিকশা ওয়ালা বললো :
-“আপা, গরিবের ত্রানের চাল চুরি করে মেম্বার সাবের কাজটা কিন্তু ঠিক করে নাই। মানুষ জনের পেটে খিদা আপা। আফনেরা হেইডা বুঝবেন না । খাওনের চাল নাই। দোকান পাট বেমাক বন্ধ। সরকারের হুকুম। এই আমি কয়ডা চিড়া লবন পানি দিয়া খাইয়া দু দিন পর রিক্সা লইয়া বাড়াইছি , পুলিশ দেখলে আবার দাবড়ানি দিবো , কি করমু কোন , ক্ষিদার জ্বালায় আজ বাড়াইছি আপা। এখন, আপ্নেই কোন , মেম্বার সাবের কাজটা কি ঠিক হইছে? গরিবের এই চাল চুরি করা কইলাম মস্ত বড় পাপ আপা, বিরাট অন্যায়!!রিকশা ওয়ালার কথায় আফরোজার লজ্জায় , অপমানে মাথা ঝিম ধরে আছে। আফরোজার কাছে একজন অশিক্ষিত দরিদ্র রিকশা ওয়ালা র ন্যায় /অন্যায় বোধ তাঁর বি এ পাস্ স্বামীর চেয়ে অনেক অনেক উন্নত মনে হয়।
বৈশাখ মাসের প্রায় মাঝা মাঝি। উত্তর দিক থেকে মেঘ কালো করে এসেছে । কিন্তু এ মুহূর্তে আফরোজার মুখে যে কালিমা লেপন হয়েছে সেই কালিমা হয়তো বৈশাখী আকাশের মতো দৃষ্টিগোচর হয় না, তবে সেই কালিমার প্রলেপে আফরোজার সাধ হয় থানার দিকে না যেয়ে বাড়িতে ফিড়ে যেতে । পারলে শশুর মশায় ক্ষমতা দেখিয়ে ছেড়ে আনুক তার নষ্ট ছেলে কে। বেশ দোটানায় পরে যায় আফরোজা। নিজের বিবিক কিছুতেই এই পাপী স্বামীকে ফিরিয়ে আনার পক্ষে সায় দেয় না । অবশেষে , আফরোজা শশুর মশায়কে ফোন করে একটি অজুহাত দেখিয়ে রিকশা ঘোরাতে বলে। রিকশা ওয়ালা রিকশা ঘুরাতেই হঠাৎ করে পাশেই স্কুল মাঠের দিকে আফরোজার চোখ আটকে যায়।
বিশেষ ধরণের সাদা পোশাক পরে চোখে গগজ, মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লাভস পরে ৩/৪ জন মানুষ ফাঁকা ফাঁকা ভাবে দাঁড়িয়ে জানাজা নামাজ পড়ছে । আফরোজার চিনতে একেবারে অসুবিধা হয় না , পিছনের সারিতে মাস্ক পরা লোকটিই শাকিল, আফরোজার প্রথম প্রেম। আফরোজা রিকশা ওয়ালাকে একটু থামাতে বলে। মফস্সল শহরের এই এক সুবিধা। অধিকাংশ মানুষই একে অপরের খবর রাখে। রিকশাওয়ালা দার্শনিকের মতো বলে উঠে:
“বুজলাইন আপা, আমাগো পাপ উপচায়ে পড়ছে । তাই আল্লাহ এই ব্যারাম দিছে। ভালো পোলাডার বাপ্ টা তিন দিন আগেও ভাল আছিলো । এই দুইদিনের মধ্যেই একেবারে কাৎ। সবই উপর আলার খেলা রে আপা । আফরোজার দ্রুত মনে হয় শাকিলের বাবার আগে থেকে এজমা রোগ ছিল। তাই করোনা ভাইরাস হয়তো উনাকে সহজেই কাবু করে ফেলেছিলো। অনেক দূরে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে । কিছুটা হালকা বাতাস ছেড়েছে। হয়তো কিছুক্ষনের মধ্যেই ঝড় বৃষ্টি শুরু হবে । বলতে না বলতেই দমকা বাতাস সহ ঝড় শুরু হয়েছে । জানাজা নামাজ শেষ করে তরি ঘড়ি করে লাস এম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে । শাকিল শূন্য দৃষ্টিতে এম্বুলেন্সের দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে আছে । সারা শরীর বৃষ্টির পানিতে ভিজে যুবথুবা অবস্থা । আফরোজার প্রচন্ড ইচ্ছা হচ্ছে শাকিলের দুই হাত ধরে বৃষ্টির পানিতে ভিজতে । একেকটি বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর মেঘের গর্জনের শব্দে বাচ্চা মেয়ে দুটি মায়ের গায়ের সাথে সেটে ধরে আছে । রিকশা ওয়ালা সম্পূর্ণ ভিজে একাকার। বাচ্চাদুটির হাত শক্ত করে ধরে আফরোজা রিক্সা ওয়ালাকে কে বলে:
“ভাই, আপনার অসুবিধা না হলে যেখান থেকে এসেছেন চলেন সেখানেই যাই, আপনাকে ভাড়া বাড়িয়ে দিবো। বাড়ি যেয়ে আপনাকে শুকনা কাপড় দিবো , খানিকটা জিরিয়ে বৃষ্টি থামলে বাসায় যাবেন। রিকশা ওয়ালা অবাক হয়ে ভাবতে থাকে যে লোক ত্রানের চাল চুরির মতো এতো জঘন্য কাজ করতে পারে তার বৌ এতো ভালো হয় কি করে ! আসলেই কত বিচিত্র এই দুনিয়া !!রিক্সা ওয়ালা মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রাথ না করে , “” হে আল্লাহ দেশের যত চোর আছে ওদের বউরা যেন এই আপার মতো ভালো হয়।”