ফ্লোরিডা থেকে::-
আজ আমি যখন সমুদ্র তীরে হাঁটছিলাম , সূর্য্য ডুবি ডুবি করছিল, অনেক গুলো গাঙচিল উড়ে উড়ে ক্লান্তির তন্দ্রীমায় বসেছিল বালুর উপর আর সামুদ্রীক হাওয়া বিলি করছিল ওদের নোনা গন্ধের পালক ।
দেখলাম একটা কুকুর খুব দ্রুত ঢেউ সরিয়ে সরিয়ে সাঁতরে যাচ্ছে সমুদ্রের বুকের দিকে। আসলে তার যে কর্ত্রী সে একটা কিছু ছুড়ে দিয়েছে দূরে এবং সে যাচ্ছে তা আনতে। কুকুর মানুষকে বড় বেশী ভালোবাসে ।
ওই ভালোবাসা দেখে আমার চোখ জল টলটল করে ওঠে। আমার তখন মেলের কথা মনে পড়ে । মেল ছিল আমার প্রিয় কুকুর । মেল মরে গেছে। আমি মেলকে ভালোবাসতাম । কিন্তু জীবন আমাকে সে বেঁচে থাকতেই তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। আমাকে এরকম মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করা হয়েছে আরও একাধিক বার। আমি সে দু:খ গুলো বুকে বহন করে হেঁটেছি বহু সমুদ্র তীরে । আমার এই জীবন যাযাবর জীপসির জীবন, যার প্রতিটি তাকে তাকে কত হাসি, বেদনা ও বিক্ষিপ্ততার ধুলো কণা। আমার এই জীবনে এত বেশী ভালোবাসার প্লাবন আমাকে বিধ্বস্ত করেছে তার হিসেব নেই ,আমি যখন এক প্লাবনের ধ্বংসস্তুপ পরিস্কার করে ভাবি এবার স্বস্তি হবে তখনই অন্য প্লাবন এগিয়ে আসে তার সরীসৃপের জিভ বাড়িয়ে ।
গোর্কী একটা কবিতা পড়ে কেঁদেছিলেন । কবিতাটি লিখেছিলেন ১৯১৫ সালে ২০ বছর বয়সের তখনও অপরিচিত সের্গেই ইয়েসিনিন । আসলে সেই কবিতাটি পড়তে যেয়ে ইয়েসিনিনেরও চোখ বেয়ে ঝরেছিল বিন্দু বিন্দু অশ্রু । সেই কবিতায় ছিল একটি কুকুরের করুন কাহিনী, যার গল্পটা মোটামুটি এমন: একবার এক স্যাঁত স্যাতে শীতল কুঠুরীতে কতগুলো জং ধরা ন্যাকড়ায় এক কুক্কুরী জন্ম দিল ৭টি শিশুর। মা তাদের যত্ন করে ,সারাদিন ধরে গা চেটে চেটে ভরে দেয় ভালোবাসায়, নিজের পেটের নীচে নিজস্ব তাপ দিয়ে উষ্ণ করে রাখে ওদের, কেননা চারিদিক থেকে হু হু করে তীরের ফলার মত , বৈরী সন্ত্রাস ও ক্ষুধার মত , আসে কনকনে শীতের বাতাস । তারপরেও আদিম অকৃত্রিম পৃথিবীর সুখ ছেয়ে থাকে সামান্য সেই কুক্কুরীর জীবন।
দিন শেষে বাড়ীর মালিক আসে মেঘের মত মুখ করে , বিরক্ত হয় এই কুকুরের দঙল দেখে । এক মস্ত বড় ছালা এনে ভরে ফেলে দেব শিশুর মত এই শিশুদের , তারপর কাঁধে নিয়ে হাঁটা শুরু করে। মা কুকুর আগে পাছে পাশে দৌড়ায়, করুন ঘেউ ঘেউ করে মিনতি করে বাচ্চাদের ফিরিয়ে দিতে, কিন্ত মানুষের বুক কি কুকুরের বুক?
সে মুখে শিস দিতে দিতে এগিয়ে চলে গন্তব্যের দিকে, রাস্তা ঘাট সাদা সাদা তুষারে ঢাকতে শুরু করেছে। সেই অবিকল মানুষের মত মানুষটি একটা মস্ত বড় দীঘির তীরে এসে চড়ে বসে নৌকায়, দীঘির জল তখন বরফ শীতল, যে কোন সময় জমে যাবার অপেক্ষায়। সে মধ্য দীঘিতে এসে পাথর বেঁধে ছালাটি ছুড়ে দেয় জলে , অনেক গুলো বুদবুদ তুলে ডুবে যায় নিরীহ কতগুলো প্রান।
তীরে মা কুকুর কেঁদেই চলেছে , তার বুক ফাটা চিৎকারের প্রতিধ্বনি খান খান করে দিচ্ছে দিনের নির্জনতা , ধীর বাতাস দীঘির জলে তুলছে মৃদু তরঙ্গ । অনস্ফুট এই কতগুলো প্রানের মৃত্যু আর তাদের মায়ের কান্না ইথারে যে কম্পন তোলে তাতে কেঁপে ওঠে দীঘির বুক কিন্তু ওই মানুষটি ? ওই মানুষটি হাত ধুয়ে বিড়ি ধরায়, আকাশ চেয়ে থাকে তার দিকে যেমন ভাবে সে চাইতে শিখেছে মানুষের দিকে লক্ষ কোটি বছর ধরে।
রাতে যখন চাঁদ ওঠে মার সেই চাঁদকে দেখে মনে হয় তার একটি শিশু। মানুষ যখন পাথর ছুড়ে মারে নেড়ী কুকুরের গায়ে এবং সেই পাথর যেমন তীব্র যন্ত্রনায় বিধ্বস্ত করে যায় ,তেমনি ওই চাঁদ বেদনা বিধুর করে তোলে সেই কুক্কুরী মায়ের মন , তার চোখ বেয়ে ঝরে পড়ে ফোটায় ফোটায় ।
না গল্পটা আমি যে ভাবে বললাম ইয়েসিনিন ঠিক সেভাবে লিখেননি আম তার কাছ থেকে ধারণাটা নিয়েছি, কবিতায় অত বরননার প্রয়োজন হয়না , কবি শুরুটা লেখেন পাঠক বাকীটা শেষ করেন , এই হল সার্থক কবিতার ধর্ম , কিন্তু চাঁদকে দেখে মা কুক্কুরীর যে তার একটি শাবক মনে হয় এবং তার চোখ বেয়ে ঝরে পড়ে চাঁদনী অশ্রু এটা ইয়েসিনিনের ।
ওই ছালায় বাঁধা ডুবন্ত শিশুগুলোর জলে পড়ে যাবার মুহূর্ত থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়টুকুতে ওরা কেমন বোধ করছিল? যখন ওদের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল এবং ওরা পাগলের মত চেষ্টা করছিল সে বন্ধ , নিস্ক্রান্তিহীন একটি থলের সমান পৃথিবীটি থেকে বেরিয়ে আসার , ওরা কি ওদের মাকে খুঁজছিল আশ্বাসের জন্য? বা ওরা কি ওদের মাকে দোষী করছিল সেই মুহূর্তে উপস্থিত না থাকার জন্য? বা ওরা কি বুঝতে পেরেছিল যে মা এই পৃথিবীর চক্রে খুবই সামান্য একটি অস্তিত্ব মাত্র এবং তার কোন সাধ্যই নেই তার এই অস্তিত্বে কোন রকমের প্রভাব ফেলার । এবং এই যে তারা এই পৃথিবীতে এসেছিল এবং পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছে তা একটি কাকতালীয় ঘটনা মাত্র ।
ইয়েসিনিনের এই কুকুর ছানাদের শেষ মুহূর্তগুলোতে যে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে সে কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ওই আকাশের চোখ আমার চোখে এসে ভর করল । সাদা কালো মেঘের মত আমার দৃষ্টির সামনে উড়ে যেতে লাগল আর একজন মানব, সত্যিকার অর্থে একজন উপমানবের গল্প, যা তীব্র চাবুকের মত মনে করিয়ে দেয় সমাজে একজন মানুষ ও তার নগন্য অবস্থানের কথা ,যা ওই কুক্কুরী মা বা তার সন্তানদের চেয়ে কোন মতেই ভিন্ন নয় ।
আলবার্ট কামুর “অপরিচিত ” (Stranger বা Outsider) উপন্যাসের নায়ক মার্শালের দিন কাটছে জেল খানায়, জনসমক্ষে গিলোটিনে মৃত্যুদন্ড কার্যকর হবার অপেক্ষায় ।
ধর্ম যাজক এসেছে তার শেষ স্বীকারাক্তি এবং ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা সম্পন্ন করতে। মার্শাল বলে তার স্বীকারোক্তি করার বা ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাইবার কিছু নেই ।
কারণ জিজ্ঞেস করা হলে সে বলে যে তার ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই,তাকে আবার প্রশ্ন করা হয় সে এ ব্যাপারে নিশ্চিত কিনা , সে বলে সে কখনও নিজেকে এ প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করেনি কারণ তার কাছে পুরো বিষয়টি মনে হয়েছে খুবই গুরুত্বহীন ।
“কখনও কখনও আমরা কোন কোন ব্যাপারে নিশ্চিত বোধ করি যদিও আমরা আসলে নিশ্চিত নই , তুমি এ ব্যাপারে কি মনে কর?” তাকে জিজ্ঞেস করা হয়।
মার্সেল বলে যে সেটা সম্ভব ; তবে কি তার পছন্দের বিষয় সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত না হলেও কি তার পছন্দ নয় সে ব্যাপারে সে খুবই নিশ্চিত । এবং দুর্ভাগ্যবশত যাজক সে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক তা এমনই একটি অপছন্দের বিষয়।
যাজক সর্বাত্মক চেষ্টা করে মৃত্যুর আগে মার্শালের আত্মাকে ঈশ্বরহীনতা বা ( আরও সঠিকভাবে ) অনুভূতিহীনতার পথ থেকে উদ্ধার করতে । এক পর্যায়ে মার্শাল প্রচন্ড রেগে যায় । সে তাকে আঘাত করতে উদ্যত হয়ে চিৎকার করে ওঠে যে কারো কোন অধিকার নেই তার বা তার কর্মকান্ডের বিচার বা দোষারূপ করার । কোন মানুষেরই আসলে অন্য মানুষকে দোষারূপ করার অধিকার নেই।
শেষ পর্যন্ত সে অনুভব করতে পারে এই বিশ্ব সংসারের নির্বিকারত্ব ও একজন মানুষের অসহায় অস্তিত্বকে ; সে তার অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে মেনে নিতে বাধ্য হয় : “I had only to wish that there be a large crowd of spectators the day of my execution and that they greet me with cries of hate .”
২য় পর্বে লেখাটি শেষ হয়েছে
শাহাব আহমেদ
জুন ৬,২০১৬