কানাডা শীত প্রধান দেশ। এ দেশে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত কোনো গাছ গাছালি দেখা যায় না। মরার মতো ঠুন্ডা গাছ পাতাবিহীন এমনিভাবে দাঁড়িয়ে থাকে মনেই হবে না যে এ সব মরা ঠুন্ডা গাছ(পাতাবিহীন) কোনোদিন সতেজ হয়ে উঠতে পারে। মার্চের শেষের দিকে আস্তে আস্তে গাছে পাতা এবং কোনো কোনো গাছে ফুল দেখা যায়। কোনো কোনো বাড়ির সামনে কিছু ফুলের গাছ মার্চের শেষের দিকে ঝলমলে সাদা ফুল, অতি সুন্দর শোভা যা দেখলে প্রাণ ভরে যায়; কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে পাপড়িগুলি ঝরে যায়, দ্বিতীয়বার আর কোন ফুল ফুটতে দেখা যায় না এবং আকর্ষণীয় ধূসর-সবুজ পাতা বের হয় । এগুলি বসন্তের প্রথম দিকের সুন্দর দেশীয় ফুল। এপ্রিল থেকে গাছে ও লতা পাতা গজিয়ে উঠে । মে থেকে অক্টোবর মাসের প্রথম দিক পর্যন্ত মনে হবে কানাডা ফুল ও সবুজে সাজানো এক অপূর্ব দেশ , প্রতিটি বাড়ির সামনে,সড়ক,পার্ক এবং বনজঙ্গল সবুজ ফুলে ফলে ভোরে উঠে। এই সময় সবাই যার যেই পরিকল্পনা অনুযায়ী বনভোজন,মাছ ধরা এবং ভ্রমণে বের হয় যায়।
এখানকার প্রতিটি পরিবার মার্চ মাসের শেষের দিক থেকেই বাড়ির আঙ্গিনায় বাগান করার পরিকল্পনা করে। যে সব লোকেরা এপার্টমেন্টে থাকে, তাদের বাগান করার জন্য কতৃপক্ষ ছোট্ট ছোট্ট প্লট দিয়ে থাকে যাতে প্রতিটি সৌখিন পরিবার শখের সবজি বাগান করতে পারে। এমন কি এলাকার চার্চ কতৃপক্ষ(Church Authority) লোকদের জন্য বাগানের সুযোগ করে ছোট্ট ছোট্ট প্লট বরাদ্ধ এবং বিনামূল্যে সব ধরণের যন্ত্রপাতি ও সার,পানি সরবরাহ করে। সামারে লোকজন কাজ থেকে এসে এবং শনি-রবি বা ছুটির দিনে নিজেদের সবজি বাগানে ব্যস্ত এবং অনেকেই ঘরের আঙিনায় টবে ফুলের গাছ লাগিয়ে সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে।
এ দেশে গার্ডেনিং করার জন্য বাজার থেকে বিভিন্ন ধরণের, ফুল ও সবজির চারা, মাটি, যেমন টপ সয়েল(Top soil) ,পোটিং সয়েল(Potting soil),বিভিন্ন ধরণের সার যথা গোবর,মিরাকেল গ্রও(Miracle gro) কিনতে পাওয়া যায়। বাহিরের সবজি বাগান সিজনাল(seasonal ) ছাড়া ও অনেকে সারা বৎসর ঘরে ও মরিচ,পুঁই শাক,আরও অনেক ধরণের গাছ লাগিয়ে থাকে।
আমার প্রতিবেশী ইতালিয়ান এঞ্জেলো, জিনো,মারিয়া ও ফ্রাঙ্কা প্রতি সামারে বাড়ির পেছনে সবজি বাগান করার অভ্যাস ছিল । জিনো ছিল আমার নিকটতম প্রতিবেশী, কয়েক বৎসর হয় ক্যান্সারে মারা গিয়েছে, তার মা ও কিছুদিন হয় ক্যান্সারে ভুগে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছে। আমার আর এক প্রতিবেশী এঞ্জেলো যে প্রতি সামারে আমাকে বাগান সম্পর্কে উপদেশ দিতো, অসুস্থ্য অবস্থায় সিনিয়র হোমে চলে রয়েছে । ফ্রাঙ্ক প্রতি বৎসর আমার জন্য লাউয়ের এবং টমোটো চারা দিয়ে সাহায্য করে। এরা সবাই ইতালিয়ান, ১৯৪৫ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে বিভিন্ন ভাবে এ দেশে এসে কষ্ট করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে এদের ইমিগ্রেশন কাহিনী শুনতে অভ্যস্ত; যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এ সব লোক ইউরোপ থেকে খালি হাতে এ দেশে এসে যেখানে যা পেয়েছে কাজ করে নিজেদের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ সব লোকদের ছেলেমেয়েরা আজ এ দেশে বড় বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ এবং আমাদের দেশীয় অভিবাসী, রেফিউজি বা ছাত্র -ছাত্রী হিসাবে এসে ওদের প্রতিষ্ঠান যথা,টিমহর্টন্স,মেসিডোনাল্ডস, কান্ট্রি স্টাইল বা শিল্প কারখানায় কাজ করে। এদের পরিশ্রমের কাহিনী শুনে অবাক হতে হয় ; এই শীতের দেশে এ সব লোক কত পরিশ্রম করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে ।
কানাডায় ৪ ক্যাটেগরির লোক এসে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার সুবিধা পেয়ে থাকে :
১) সারা দুনিয়ার যেখানেই যুদ্ধ শুরু , মানবতার খাতিরে কানাডা ত্রাণসামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হয় এবং দুঃস্থ লোকদের ইমিগ্রেশন দিয়ে এনে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে- ১৯৭১ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফলে অনাথ শিশুদের নিয়ে এসে এ দেশে লালনপালন ও স্থাতিভাবে থাকার ব্যবস্থা করেছে। এ ছাড়া আফগানিস্তান,ইরাক,সিরিয়া,লিবিয়া, ইউক্রেন ও অনেক দেশ থেকে মানবতার খাতিরে স্বরণার্থী এনে আশ্রয় ও নাগরিত্ব দিয়েছে। কানাডা মূলতঃ রেফিউজি দেশ।
২) এ দেশে ভিসিট ভিসা নিয়ে আসা লোকদের ৯০% শরণার্থী দাবি করে ইমিগ্রেশন নিয়ে থাকার ব্যবস্থা একটা প্রচলিত নিয়ম। শুনা যাচ্ছে এবার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে কয়েক লক্ষ লোক ভিসিট ভিসা নিয়ে এসে শরণার্থী দাবি করেছে, বাংলাদেশ থেকেও অনেক লোক এসেছে; এ সব বাঙ্গালী ছেলেমেয়েরা টরোন্টোর ডেনফোর্থ এলাকা এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
৩ ) এ ছাড়া ও বিনিয়োগকারী ভিসা, ল্যান্ডিং ইমিগ্রেশন নিয়ে এসে স্থায়ীভাবে থাকার প্রচলিত নিয়ম রয়েছে। স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে এসে পড়াশুনা করে থাকার অনুমতি নিয়ে থেকে যেতে পারে।
কানাডাতে ৯৯% লোক খালি হাতে এসে পরিশ্রম করে দাঁড়িয়ে যায়। যত সাদা, কালো, ব্রাউন বুড়ো লোক এখানে সেখানে দেখা যায়, জিজ্ঞেস করলে এক ধরণের জবাব পাবেন, “কঠোর পরিশ্রম করো এবং একদিন দাঁড়িয়ে যাবে “। Canada is a land of opportunity (কানাডা সুযোগের দেশ )।
ও হ্যাঁ , আমার সামার গার্ডেনিং সম্পর্কে বলতে গিয়ে অনেক কথা বলা হলো। আমি কেবল-ই ধনিয়া,বেগুন,পুঁই শাক,সিম,টমেটো, সালাদ,লাল শাক,ডাটা লাগিয়েছি।
আমাদের বাংলাদেশ থেকে অনেক কৃষিবিদ ইমিগ্রেশন নিয়ে কানাডায় এসেছেন ; ওরা প্রতি বৎসর সামার শুরু হওয়ার পূর্বেই সেমিনার করে কিভাবে বাগান করতে হবে এবং বিনামূল্যে দেশি লাউ,বেগুন,সিম ও নানাহ চারা (বাগান প্রেমিকদের) বিতরণ করে।
কানাডায় সামারে ফুলের সমারোহ, চারিদিকে গোলাপ,টিউলিপ, আরও কত কি বাহারের ফুল এবং সবাই বাড়ির সামনে ফুলের টব দিয়ে সাজিয়ে রাখে। রাতে অনেক বাড়ির সামনে লনে সোলার লাইট (সৌর আলো ) মিট মিট করে জ্বলছে।
সামারে নিয়াগারা ফলস,বিভিন্ন পার্ক,দূর দূরান্তরে ছেলেমেয়ে,আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়া এবং মাছ ধরার অপরূপ সুযোগ , অনেকে কয়েকদিনের জন্য কোনো লেকের কিনারায় কটেজে গিয়ে আনন্দ করে । টাটকা মাছ ধরে বার্বাকিউ,রান্না এবং এ সঙ্গে ছেলেমেয়ে ও বন্ধুদের নিয়ে হরেক রকমের খাওয়া দাওয়া ও আনন্দ করে সময় স্মৃতিতে ধরে রাখে। কানাডা শান্তিপ্রিয় দেশ, এখানে পরিশ্রমীদের জন্য সব ধরণের সুবিধা রয়েছে।
সমাপ্ত