লেখকের কথা:
হলিডে-র আনন্দঘন মুহূর্তে আপনেরা যখন এই শীতের আমেজে পরিবারের মানুষজন নিয়ে মজা করছেন, একেবারে বেরসিকেরমতো আমি আবার হাজির হলাম আমার হোমলেসের পঞ্চম পর্ব নিয়ে। নতুন করে, হোমলেস নিয়ে আজ আর কোনো ভূমিকা টানছি না। শুধু এটুকু বলবো আমরা যারা প্রবাসী বাংলাদেশিরা ভিনদেশে পরিবার পরিজন নিয়ে সুখ/দুঃখ হাসি কান্না নিয়ে বেঁচে আছি, আমাদের এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকা মানসিক ভারসাম্যহীন হোমলেস মানুষেরা তাদের শোকের কথা, দুঃখের কথা অথবা দেশের স্মৃতির কথা কারো সাথে শেয়ার করা তো দূরের কথা ওঁদের নিজ নিজ জীবন সংগ্রাম চালিয়ে নিতে থাকে ওঁদের মতো করে।সত্যি কথাবলতে কি, প্রবাসে পথেঘাটে এখনো বাংলাদেশি হোমলেস চেখে পরেনি । তবে শেল্টারে অল্প কিছু বাংলাদেশি দেখতে পাওয়া যায় । লেখক কল্পনিকভাবে নিজাম উদ্দিন নামক সম্পূর্ণ কাল্পনিক চরিত্রকে মূলত এখানকার কোনো হোমলেস সাজিয়ে আরো রং মাধুরী মিশিয়ে কিছুটা ঔপন্যাসের ঢঙে চিত্রিত করতে চেয়েছে। ভুলত্রূটি ক্ষমা করবেন।
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীনউদ্দিন.
রেজিস্টার্ড সোস্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার, টরেন্টো, কানাডা, নভেম্বর ৩০, ২০১ ৯
———————
আগের পর্বগুলির সারাংশ :
মানসিক ভারসাম্যহীন হোমলেস নিজাম উদ্দিন আজকে থেকে প্রায় ৩৬ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৮৩ সাল থেকে কানাডার টরেন্ট শহরে বসবাস করে আসছে। প্রায় বছর পাঁচেক পর বাংলাদেশ থেকে রুপা নাম একটি মেয়ে কে বিয়ে করে নিয়ে আসে । বিয়ের দুই বছরের মাথায় ছেলে রিফাত ও আরোও ৫ বছর পরে মেয়ের নাজমার জন্ম হয় । বিয়ের আগে নিজাম উদ্দিন যখন টরেন্ট শহরে ব্যাচেলর জীবন যাপন করতো তখন শৈশবের বন্ধু একরামের সাথেই থাকতো ডানফোর্থ এলাকার বাঙালি পাড়ারই এক মেসে । এই একরামর হাত ধরেই নিজাম উদ্দিনের সুন্দরী স্ত্রী রুপা এক কাপড়ে পালিয়ে বিয়ে করে। স্ত্রী হারা দিশেহারা নিজাম উদ্দিনের স্কিজোফ্রেনিয়া রোগের উপস্বর্গ দিনের পর দিন ঔষুধ না খাওয়ায় অনেক বেড়ে যায় ।
আগের পর্বে আমরা দেখতে পাই, নিজাম উদ্দিন টরেন্ট ছেড়ে যাওয়ার আগে কিছুদিনের জন্য নায়াগ্রা ফলসে গিয়েছিলো। ঘটনাচক্রে, সেখানে ছেলে, ছেলের বৌমা ও নাতি-র সাথে দেখা হয়ে যায়। ওঁদের সাথে কিছুটা সময় কাটালেও ওঁদের থেকে কৌশলে পালিয়ে আসে নিজাম উদ্দিন।
——————————-
আজকের পর্ব :
নিজাম উদ্দিনকে বেশ চিন্তান্বিত মনে হচ্ছে. কারণ, খোদ ডাউনটাউনে তার মতো একাধিক হোমলেস এদিকওদিক যত্রতত্র ভিক্ষাবৃত্তি পেশাকে বেশ কম্পিটেশনের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। নায়াগ্রা এলাকা থেকে গত দুদিন আগে নিজাম উদ্দিন টরেন্ট ডাউনটাউন ফেরার পর থেকে ইউনিয়ন স্টেশন থেকে পায়ে হেটে হারবার স্কয়ারে এলাকায় থাকতে শুরু করেছে। এখানে সুবিধার দিক হলো, পাশেই লেক। রাতে লেকের ধার ধরে হাটতে ভালোই লাগে। পাহাড় ও পানি দুইটিই নিজাম উদ্দিনের বেশ প্রিয়। নিজাম উদ্দিন মনেকরে প্রকৃতি প্রদত্ত এই দুটি সৃষ্টিই মানুষকে যাবতীয় পার্থিব বিষন্নতা ভুলিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।
ডাউনটাউনের এই যে এলাকাটিতে সাময়িকভাবে নিজাম উদ্দিন থাকতে শুরু করেছে, এখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটার দূরত্বের মধ্যে সি এন টাওয়ার, টরেন্টোর বেশ আকর্ষণীয় ভিজিটিং স্পট. ভীষণ ব্যাস্ত এলাকা। গার্ডেনার হাইওয়ের কাছে ব্রিজের নিচেই নিজাম উদ্দিনের থাকার ব্যাবস্থা। নিজাম উদ্দিনের প্রায় গা ঘেঁষে গতকাল থেকে আরেকজন হোমলেস থাকা শুরু করেছে। আসলে, নিজাম উদ্দিনই আমন্ত্রণ জানিয়েই পাশে থাকতে দিয়েছে।এই হোমলেস এক মাঝ বয়সী গ্রিক তরুন। ছেলেটির নাম জন। কাঁধ বরাবর লম্বা চুল।সারা গায়ে টাট্টু-র ছাপ। কানে মেয়েদের মতো দুল। ঘাড়ে সবসময়ের জন্য ঝুলানো থাকে স্প্যানিশ গিটার। দেখতে অনেকটা হিপ্পি হিপ্পি ভাব। জনের সাথে নিজাম উদ্দিনের পরিচয় হয়েছিল সি এন টাওয়ারের ওখানে গত শুক্রবারের রাতে। ডাউন টাউন শুক্রবারের রাতে বেশ সরব থাকে। এখানকার লোকজন ঘুব ঘটে করে তাদের ভাষায় “ফ্রাইডে-নাইট’ সেলিব্রেট করে। জনের গানের গলা বেশ চমৎকার। গানই মূলত জনের পেশা। রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে যে ২/১ পয়সা পায় তা দিয়েই ওর চলে যায়. জন এযুগের ছেলে হয়েও মূলত পুরাতন রক টাইপের গান গায়। সে রাতে অনেক দিন পরে বিটলসের গাওয়া …
“Hey Jude, don’t make it bad
Take a sad song and make it better
Remember to let her into your heart
Then you can start to make it better…”
বেশ ভালোই লাগছিলো অনেকদিন পরে গানটি শুনে। শ্রোতারা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে জনের গান শুনছিলো। নিজাম উদ্দিন ভলান্টিয়ার হয়ে জনের হয়ে মাথার হ্যাট উঁচিয়ে সবার থেকে টাকা/পয়সা কালেকশন করছিলো। সেই থেকে জনের সাথে নিজাম উদ্দিনের ভাব । দুজনের বয়সের বিশাল গ্যাপ হলেও দুজনের বন্ধুত্ব জমে উঠে। গানের শেষে দুই অসম বয়সী বন্ধু বারে যেয়ে গলা অবধি মদ খেয়ে লেকের পাশে ঝিম মেরে বসে থাকে প্রায় মাঝ রাত পর্যন্ত। গভীর রাতের লেকের ধারের সুন-সান নীরবতা ও চাঁদের আলোয় চিক চিক করা সোনালী লেকের পানি ওদের দুজনের অনেক ‘না বলা’ কথাকে বলার সুযোগ করে দেয়।
জন এক নিস্বাসে নিজের কথা বলতে থাকে আর গাঁজা, ক্র্যাক ইত্যাদি নেশা করতে থাকে। নিজাম উদ্দিনের আবার মদ, সিগারেট ছাড়া অন্যকোনো নেশা নেই। সাইক্রিয়াটিস্টরা নিজাম উদ্দিনকে তাদের ভাষায় বলে থাকে ‘ কোন্কারেন্ট ডিসর্ডার পেসেন্ট’। অর্থাৎ মানসিক রোগ আর সাবস্টেন্স এব ইউজ এর কম্বিনেশন। স্কিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত সুদূর বাংলাদেশ থেকে আগত অভিবাসী নিজাম উদ্দিনকে এক ভিনদেশি তরুণ বন্ধুকে নিজ জীবনের কথা, নিজ স্ত্রীর পালিয়ে যাওয়ার কথা, সংসার ছেড়ে হোমলেস হওয়ার কথা বিরতিহীনভাবে বলতে থাকে। নেশাগ্রস্ত জনও একইভাবে নিজের শৈশবের কথা নিজের জীবনের কথা বন্ধুকে বলতে থাকে। জনের কথাগুলোর সারাংশটা এরকম: জন্মের পর থেকে ও বাবাকে কখনো দেখেনি। জনের বয়স যখন প্রায় সাত বছর মা আরেকজন কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কারকের সাথে সংসার পাতে। সেই বাবার আবার আগের পক্ষের দুই ছেলে, এক মেয়ে। জন এদের সাথে কিছুতেই খাপ খেয়ে চলতে পারতোনা। লেখাপড়ায় অমনোযোগী জন বন্ধুদের সাথে হাইস্কুলের টিফিন পিরিয়ডে বন্ধুদের সাথে গাঁজা খাবার জন্য অনেকবার বকুনি খেয়েছে । এমনকি স্কুল থেকে প্রায় বের করে দেয়ার উপক্রম। এর মধ্যে একদিন জনের সৎ বড় ভাই একবার এক সাথে ভিডিও গেম খেলার সময় খুব তুচ্ছ কারনে ওকে মেরে দুটি দাঁত ভেঙে ফেলে দেয়। দিনের পর দিন জনের উপর সৎ বড় ভাইদের অত্যাচারের মাত্রা বাড়তেই থাকে। এক পর্যায়ে, নিরুপায় মা, জনের নিরাপত্তার কথা ভেবে জন কে একটি ইয়োথ শেল্টারে রেখে আসে। সেই থেকে জন বাড়ি ছাড়া ।
নিজাম উদ্দিনের মতো জনেরও শেল্টারে খুব ভালো সময় কাটেনি। দুজনের মিলের দিকটাহলো দুজনেই শেল্টার ছেড়েছে নেগেটিভ অভিজ্ঞতা নিয়ে । তবে, নিজাম উদ্দিন যেমন মারামারি করে শেল্টার ছেড়েছে, জনের ক্ষেত্রে ঘটেছিলো অন্য কারনে। শেল্টারে একজন ওকে রেপ করে একাধিকবার যা জনকে পোস্ট ট্রমাটিক ডিসর্ডার পেসেন্টে পরিণত করে। কথার ক্লান্তিতে দুই বন্ধু কিছুটা সাময়িক বিরতি টানে। জন গিটার বাজিয়ে জর্জ মাইকেলের গাওয়া আশির দশকের একটি জনপ্রিয় গান “কেয়ারলেস হুইস্পেয়ার” গাইতে থাকে। নিজাম উদ্দিন ভাবতে থাকে এই পৃথিবীতে মানুষ নামের এক বিচিত্রি জীবের অদ্ভুৎ রংবেরঙের কষ্টের কথা। সংসারের সুখ/দুঃখ, হাসি/কষ্টের কোনো জাত পাত নেই। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি সুতা হাতে ধরে থেকে প্রথিবী নামক গ্রহের সুবিধা বঞ্চিত কিছু মানুষের দুঃখ/কষ্ট নিয়ে পাপেটের মতো নাচাতে থাকে। এক সময় নিজাম উদ্দিন হেরে গলায় গান ধরে”
“খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে।
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে।।
শূন্যে মহা আকাশে
মগ্ন লীলা বিলাসে,
ভাঙিছ গড়িছ নিতি ক্ষণে ক্ষণে।।
তারকা রবি শশী খেলনা তব, হে উদাসী,
পড়িয়া আছে রাঙ্ পায়ের কাছে রাশি রাশি।
নিত্য তুমি, হে উদার
সুখে দুখে অবিকার,
হাসিছ খেলিছ তুমি আপন মনে।।
নিজাম উদ্দিনের ধারণা হোমলেসদের জন্য ডাউন টাউন কিছুদিন থাকার জন্য ভালো তবে স্থায়ীভাবে না। বিশেষকরে, নিজাম উদ্দিনের জন্য এটি মোটেই নিরাপদ জায়গা না। নিজাম উদ্দিনের ধারণা এবার টরেন্ট থেকে খানিকটা দূরে কোথাও থিতু হওয়া। পিটারবোরো এলাকা থেকে আরোও প্রায় ৪৩ কি মি পশ্চিমে লিন্ডসে নাম একটি ছোট শহর আছে ওটিও হতে পারে। ওখানে আয়-রোজগার ভালো হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা কারণ জায়গাটি বাণিজ্যিকভাবে বেশ ব্যাস্ত এলাকা, আর তাছাড়া ওদিকটায় বাঙ্গালী বা এশিয়ান লোকজন নাই বললেই চলে। গত কয়েক বছর আগে এক বন্ধুর সাথে ওখানে বেড়াতে গিয়েছিলো নিজাম উদ্দিন। তখন থেকেই জায়গাটি বেশ ভাল লেগেছিলো। সুতরাং, ২/১ দিনের মধ্যে লিন্ডসে তেই সেটেল্ড হওয়ার মন স্থির করে নিজাম উদ্দিন।
আজ সকাল থেকেই নিজাম উদ্দিনের মন মেজাজ বিশেষ ভালো না। খুব ভোরবেলায় জনের চ্যাচ্যামেচিতে নিজাম উদ্দিনের ঘুম ভেঙে গেলো। শেষ রাতের স্বপ্নে জড়ানো ঘুম ভেঙে চোখ খুলেই দেখতে পেলো কাছেই পুলিশের ভ্যান। নিজাম উদ্দিনকে আর কিছুই বলতে হলোনা। ঝটপট তল্পিতল্পা সহ জনের সাথে বেরিয়ে পড়লো নতুন কোনো ডেরার সন্ধানে।
নিজাম উদ্দিনের মেজাজটা আরোও বিগড়ে গেলো যখন এই ভোর বেলা বাথরুম সাড়তে একটি টিমহর্টোন এ ঢুকে ছিল বাথরুমের সামনে কাগজ টাঙিয়ে লেখা আছে “আউট অব অর্ডার”। পরে, সি এন টাওয়ার থেকে ফ্রন্ট স্ট্রিট হয়ে প্রায় আধা ঘন্টা খানিক পায়ে হেটে নোফ্রিলস স্টোরে যেয়ে প্রাতঃকাজ শেষ করে নোফ্রিলস থেকে জনের সাথে শেয়ার করে এক কাদি কোলা ও একটি পাউরুটি কিনে তারই খানিকটা খেয়ে সকালের নাস্তা সেরে ফেলে নিজাম উদ্দিন।
জনের আজ কোর্টে হাজিরা দেয়ার কথা সকাল দশটায়। একাধিকবার বিনা টিকিটে টিটিসি বাসে উঠার কারণে গত বছর ১৯৫ ডলারের টিকেট পিয়েছিলো। সময়মতো টিকিটের টাকা না দেয়ায়, পুলিশি ঝামেলায় পরে যায়। আজ কোর্টে ওর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা। জনের সাথে কথা হয় কোর্ট থেকে ফিরে সি যান টাওয়ারের ওখানে ওদের দেখা হবে। সেখান থেকেই ঠিক করা যাবে কোথায় আস্তানা গাড়া যায়।
জনকে বিদায় জানিয়ে হারবার স্ট্রিটের দিকে নিজাম উদ্দিন আপনমনে হাটছিলো। হটাৎ, এক বাংলাদেশী ট্যাক্সি ড্রাইভার ট্যাক্সি থামিয়ে একেবারে বাংলায় জিজ্ঞাসা করলো, “আঙ্কেল, আপনার কাছে কুড়ি ডলারের চেঞ্জ হবে?” নিজাম উদ্দিনের কাছে ট্যাক্সি ডরাইরার এভাবে এপ্রোচ করাকে খুব একটা প্রফেশনাল মনে হলোনা। নিজাম উদ্দিন ভাবে, সে বাঙ্গালী নাও হতে পারতো। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা এমনকি গাইনীজদের চেহারা অনেকটা বাংলাদেশীদের মতো। যাহোক, নিজাম উদ্দিন কুড়ি ডলারের চেঞ্জ ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ঠিক ঠাক বুঝিয়ে দিয়ে পকেটে রাখে। এখানেই লেঠা চুকে যাওয়ার কথা ছিল. কিন্তু, না। ট্যাক্সি ড্রাইভারটি আগের চেয়ে আরো বেশি আন-প্রফেশনালের পরিচয় দিয়ে এই সাত সকালে নিজাম উদ্দিনের সাথে আলাপ জুড়িয়ে দেয় :
আঙ্কেল, আপ্নে কানাডায় এসেছেন কবে? মানে, বলছিলাম কি, বাংলাদেশিদেরতো এভাবে পথেঘাটে তেমন রাতের বেলায় দেখা যায়না!
নিজাম উদ্দিনের মনে হয় ছোকরাটিকে যদি কষে এক চড় দেয়া দিতে পারতো, কিন্তু এসব দেশে তো গায়ে হাত দেয়া যায়না। নিজাম উদ্দিন যখন রাগে দাঁত কিড়মিড়করছে ছেলেটি নিজাম উদ্দিনের দিকে মৃদু হেসে দামি সিগারেট বাড়িয়ে দিলো। নিজাম উদ্দিন কচ্ছপের মতো হাত বের করে খপ করে সিগারেট টি নিয়ে নিলো। ছেলেটির উপর থেকে নিজাম উদ্দিনের রাগ মুহূর্তের মধ্যে ঠান্ডা হয়ে গেলো। আসলে নিজাম উদ্দিনের বেশ সিগারেট খেতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। পকেটে পয়সা থাকলেও এত সকালে সিগারেটের দোকান এখনো খোলেনি। তাই, সিগারেট না খেতে পেয়ে বেশ বেকায়দার মধ্যে ছিল সে। নিজাম উদ্দিন ঠিক করে রেখেছিলো আরোও ঘন্টা খানিক হেটে গ্যাস স্টেশনে যেয়ে সিগারেট কিনবে। নিজাম উদ্দিন ট্যাক্স ড্রাইভার ছেলেটিকে যতটা খারাপ ভেবেছিলো ছেলেটি আসলে বোধহয় ততটা খারাপ না। ছেলেটি সামনে এগিয়ে এসে নিজাম উদ্দিনের দিকে ঝুকে যত্ন করে লাইটার দিয়ে নিজাম উদ্দিনের সিগারেট ধরিয়ে দিতে দিতে বললো : ” আঙ্কেল, আপ্নে ডলার চেঞ্জ করে দিয়ে আমার বেশ উপকার করলেন। একটু আগে এক প্যাসেঞ্জার টাকা খুচরা করার নাম করে কেটে পড়েছে। সতেরো টাকা ভাড়া হয়। হাতে কুড়ি ডলারের নোট। খুচরা না থাকায় লোকটি আরেকটি ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে এগিয়ে যেতেই ভোঁ দৌড়। নিজাম উদ্দিনের বেশ মন খারাপ হয়ে যায়. সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলে,” শুধু বাংলাদেশের দোষ দিয়ে লাভ লেই, সারা দুনিয়া জুড়ে আসলে মানুষ যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে, চরিত্রবলে কিছু নেই”। স্বল্প পরিচয়ে নিজাম উদ্দিনের সাথে ছেলেটির আরো আলাপ হয়। ছেলেটির নাম সাব্বির। বাড়ি বাংলাদেশের মাদারীপুর এলাকায়। বড় ভাই শরিফুল বছর পাঁচেক আগে বাবা সহ সাব্বিরকে এখানে স্পনসর করে কানাডায় নিয়ে এসেছিলো । পরে, সাব্বির সেনেকা কলেজ থেকে পুলিশ ফাউন্ডেশনের উপর ডিপ্লোমা করে চাকুরীর চেষ্টা করেছিল। বছরখানিক এখানে ওখানে ভলান্টিয়ার করতো। ইতিমধ্যে বড় ভাইয়ের সাথে বাবা/মা-র সম্পর্কে বেশ ফাটল ধরতে শুরু করে। বড় ভাইয়ের দুই বাচ্চাই এলিমেন্টরি স্কুল শেষ করে হাই স্কুলে যাওয়া শুরু করে। তাই, বেবি সিটিঙের জন্য বাবা/মায়ের প্ৰয়োজনীয়তা অনেকটাই কমে আসে. বড় ভাই, ভাবি দুজনেই সকাল সকাল কাজে চলে যায়, ফেরে সেই বিকাল নাগাদ. সাব্বির ব্যস্ত থাকে চাকুরী পাওয়ার আশায় ওর ভলান্টিয়ার কাজ নিয়ে. ঠান্ডার এই দেশে বাংলাদেশ থেকে আসা নতুন অভিবাসী বৃদ্ধ বাবা-র বন্দিত্ব একাকী জীবন কাটে আবদ্ধ ঘড়েই। এর মধ্যে আবার খাবারের কষ্ট। বাসায় কদাচিৎ ভাত তরকারি রান্না হয়। বাড়িতে ছেলের বৌ-এর অনুমতি ছাড়া রান্না ঘরে যাওয়া নিষেধ। কাজে যাওয়ার আগে যতটুকু খাবার টেবিলে দেয়া থাকে এতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। দিন দিন সেই খাবারের মান ও পরিমান কমতে থাকে। কথাগুলি বলতে যেয়ে সাব্বিরের চোখ ছল ছল করে উঠে। সাব্বির আরো বলতে থাকে একদিন উইকেন্ডে বড় ভাই, ভাবি বাচ্চাদের নিয়ে সকালের দিকে বেরিয়ে যায় অনেক রাত অবধি বন্ধুর বাসায় দাওয়াত খেয়ে বাসা ফেরে। এদিকে, সেই দুপুর ডাইনিং টেবিলে রেখে যাওয়া দুই বাটি পাস্তা খেয়ে বাবা মায়ের সারাদিন কেটে যায়। সন্ধ্যার দিকে বাবা ডাইনিং চেয়ারে দাঁড়িয়ে উঁচুতে কিচেন ক্যাবিনেট খুলে সিরিয়ালএর প্যাকেট খুলে বাবা মা দুজনে মিলে শুখনো সিরিয়াল খেতে থাকে। রাত প্রায় দশটায় সাব্বির বাসায় ফিরে দেখে বাবা মা ক্ষুধায় ছটফট করছে। আর দেরি করে না সাব্বির। পরের মাস থেকেই সাব্বির চাকুরীর আশা ছেড়ে দিয়ে ভলান্টিয়ার বাদ দিয়ে ট্যাক্সি চালানো শুরু করে ও বাবা মা কে নিয়ে ভাড়া বেসমেন্টে চলে যায়। দেশে ওদের আর্থিক অবস্থা তেমন খারাপ ছিলোনা। বড় ভাইয়ের ইমিগ্রেশনের সময় বেশ খানিকটা জায়গা জমি বিক্রি কোরতে হয়েছিল। পরে, বাবা, মা ও সাব্বিরের স্পন্সরের সময় আরও কিছুটা বিক্রি কোরতে হয়। সাবিরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো দুই বছর পর নতুন দেখে একটি গাড়ি কিনে উবার চালাবে। সাব্বিরের সাথে নিজাম উদ্দিনের আলাপ বেশ জমেই উঠেছিল, কিন্তু একটি প্যাসেঞ্জারের কল পাওয়ায় সাব্বিরকে দ্রুত চলে যেতে হলো। সাব্বির যাওয়ার আগে নিজাম উদ্দিনকে আরেকটি সিগারেট দিয়ে যায়। নিজাম উদ্দিন সিগারেট না জ্বালিয়ে হাতে ধরে থেকে গ্যাস স্টেশনের দিকে হাটতে থাকে আর ভাবতে থাকে ছেলে/মেয়েরা বাবা/মার্ উপর কি করে এতটা নির্দয় হতে পারে। প্রবাসে থাকাকালীন নিজাম উদ্দিন বাংলাদেশের কমিউনিটিতে বাবা/মা নিয়ে বেশ অদ্ভুত ধরণের পরস্পরবিরোধী চিত্র দেখেছে। একদিকে যেমন কিছু প্রবাসীরা বাবা/ মা কে স্পনসর করে এখানে নিয়ে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে পরে, আবার, এঁদের মধ্যে কেউ কেউ বাবা মা কে নিয়ে এসে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যাবহার করে। নিজেদের প্রয়োজনে ব্যাবহার করুক তাতেও নিজাম উদ্দিন তেমন দোষ দেখেনা। কিন্তু, তাইবলে, খাবারের কষ্ট দেওয়া মানসিক ভারসাম্যহীন হোমলেস নিজাম উদ্দিনকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। কয়েক বছর আগে একবার এক ফুড ব্যাংকে এরকম এক অসহায় অবহেলিত বাংলাদেশী বাবার সাথে নিজাম উদ্দিনের দেখা হয়েছিল। নিজাম উদ্দিন একজন বাংলাদেশী জানতে পেরে লজ্জিত, অপমানিত সেই বাবার মুখ নিজাম উদ্দিন এখনোও ভুলতে পারেনা। সফেদ দাড়ি, মাথায় টুপি দেখে নিজাম উদ্দিন সালাম দিতেই, বৃদ্ধটি নিজের কষ্টের কথা নিজাম উদ্দিনকে বলতে থাকে।
এই বিচিত্র পৃধিবীর এই এক নিয়ম। একজন অসহায় মানুষ আরেকজন অসহায় মানুষের কথা শুধুমাত্র একজন মনোযোগী শ্রোতা হিসাবে শোনা ছাড়া করার কিছুই থাকেনা।
এমনিতেই সকাল থেকেই সময়টা খুব একটা ভালো যাচ্ছিলোনা নিজাম উদ্দিনের। এর মাঝে ট্যাক্সি ড্রাইভার-এর মুখে ওর বাবাবার কথা শুনে মনটা বেশ খারাপ হয়ে যায় নিজাম উদ্দিনের। সকাল গড়িয়ে বেলা প্রায় দুপুর গড়িয়েছে। বন্ধু জনের কোর্ট থেকে ফেরার প্রায় সময় হয়ে এসেছে। নভেম্বরেই এবার শীত জেঁকে বসেছে। গত বিকাল থেকে রাত অবধি বেশ বরফ পড়েছিল। সিটির লোক ইতিমধ্যে ডাউন টাউনের রাস্তা বরফ ক্লিন করে গেছে। লবণের গাড়ি এসে রাস্তায় লবণও ছিটিয়ে দিয়ে গেছে। কিন্তু, সকালের তাপমাত্রা শুন্যের অনেক নীচে চলে যাওয়ায় ফুটপাতে হাঁটার রাস্তায় তুষার ঠান্ডায় জমে গিয়ে বরফ হয়ে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে পরেছে। আরো বেশি ঠান্ডা পড়ার আগেই টরেন্ট থেকে দ্রুত সটকে পরতে হবে, মনে মনে ভাবতে থাকে নিজাম উদ্দিন। ট্রাফিক সিগনালে সাবধানে রাস্তা পার হয়ে ফুটপাথে উঠেই বায়ের দিকে কিছুটা ফাঁকা জায়গার হয় দিকে এগুতে চেষ্টা করে নিজাম উদ্দিন। বিধি বাম। পা পিছলিয়ে একেবারে চিৎপটাং। ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে নিজাম উদ্দিন। মুহূর্তেই, নিজাম উদ্দিনকে নিয়ে ওখানে ছোটোখাটো জটলা তৈরী হয়। ৫/৭ মিনিটের মধ্যে সাইরণ বাজিয়ে এম্বুলেন্স চলে আসে। প্যারামেডিক স্টাফরা নিজাম উদ্দিনকে প্রাথমিক এসেসমেন্ট সেরে স্ট্রেচারেকরে তুলে এম্বুলেন্সের ভিতরে তোলে। সাইরণ বাজিয়ে এম্বুলেন্স ডাউন টাউনের সকালের রাস্তার ভিড় ঠেলে তোর তড়িয়ে এগিয়ে ছুঁটে চলে হাসপাতালের দিকে। প্রবাসী ইমিগ্রান্ট মানসিক ভারসাম্যহীন হোমলেস নিজাম উদ্দিনের নিজের কাছে তাকে নিয়ে এই যে ব্যাস্ততা, কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগে। এম্বুলেন্সের মধ্যে অসাড় হয়ে শুয়ে থেকে নিজাম উদ্দিন ভাবতে থাকে বহু বছরের ফেলে আসা বাংলাদেশের কথা। আজকের এই এক্সিডেন্টের ঘটনাটি যদি বাংলাদেশের কোনো রাস্তায় একজন হোমলেস মানসিক রুগীর হতো কি কি হতে পারতো। এমনিতেই বাংলাদেশে মানসিক রুগীর সামাজিক অবস্থান অনেক নিচের দিকে, তার পরে আবার হোমলেস। নিজাম উদ্দিনের মনে পরে প্রাইমারী স্কুল জীবনের কথা। টিফিন পিরিয়ডের সময়, স্কুল ঘেঁষে রাস্তায় একজন বিব্রস্ত অর্ধ উম্মাদ লোক আপনমনে রাস্তা পার হচ্ছিলো। স্কুলের ছেলেরা দলবেঁধে ঢিল ছুড়তে ছুড়তে লোকটিকে ধাওয়া করতে থাকে। ব্যাচারা লোকটি কোনোরকম প্রতিবাদের মধ্যে না যেয়ে ভয় পেয়ে পালিয়ে দৌড়াতে থাকে। নিজাম উদ্দিন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সহপাঠীদের নির্মমতা দেখতে থাকে। এক পর্যায়ে একটি ঢিল লোকটির মাথায় লেগে মাথা ফেটে যায়। তাল সামলাতে না পেরে চিৎ হয়ে পরে যায় লোকটি। মাথা বেয়ে গোল গোল করে রক্ত ঝরতে থাকে। রাস্তায় লোকজন জমে যায়। বেশ খানিকটা পরে, হেড স্যারের সহায়তায় লোকটিকে রিকশায় করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেদিন, টিফিন পিরিয়ডের পরের ক্লাশগুলিতে নিজাম উদ্দিন কিছুতেই মন বসাতে পারেনি। কেবলি ভাবছিলো সেই পাগল লোকটির কথা। স্কুল শেষে রাস্তায় যে জায়গায় লোকটি মাটিতে পরে গিয়েছিলো, নিজাম উদ্দিন একা সেi জায়গায় চুপি চুপি অনেক্ষন দাঁড়িয়ে থাকে। জায়গাটিতে এখনোও রক্ত জমাটবেঁধে কিছুটা কালচে হয়ে আছে। সারি বেঁধে লাল পিঁপড়া সেই শুখনো রক্তের মধ্যে দিয়ে খাবার সন্ধানে এগিয়ে চলছে। পাশেই দুটি ক্ষিপ্ত নেড়ী কুকুর একে ওপরের সাথে ভেউ ভেউ করে উচ্চস্বরে চেচামেচি করছে। বালক নিজাম উদ্দিন ভাবতে থাকে তার সে সহপাঠীদের কথা যারা ঢিল ছুড়ে মারতে মারতে ধেয়ে চলছিল সেই বিব্রস্ত পাগল লোকটির দিকে। একসময় বালক নিজাম উদ্দিনের কাছে এই পরস্পর ঝগড়ারত নেড়িকুকুরগুলিকে সেই সহপাঠিদের চেয়ে উত্তম মনে হয়।
পুব দিক থেকে আকাশ কালো মেঘে চেয়ে আসছে। বৈশাখ মাসের দমকা হাওয়া ছেড়েছে। বালক নিজাম উদ্দিন কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সেই জায়গায়। ভাবতে থাকে মানুষ কতটা নির্মম হলে একজন বিকারগ্রস্ত মানুষকে নিয়ে ঢিল ছুড়ে তামাশা করে। কিছুক্ষনের মধ্যেই মুষুলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। প্রকৃতি নিজ উদ্যোগে বৃষ্টি-র পানিতে পাগল লোকটির জমাট বাঁধানো কালচে রক্ত রাস্তা থেকে ধুয়ে মুছে নিয়ে যায়। কাক ভেজা নিজাম উদ্দিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে।
নিন্ম বিত্ত পরিবারে একজন বালকের সন্ধ্যায় স্কুল থেকে কাক ভেজা হয়ে বাড়ি ফেরা নিয়ে বাড়ীতে তেমন হৈচৈ হয়না। কেবল নিজাম উদ্দিনের বাবা তমিজ উদ্দিন মাগরিব নামাজের দুই রাকাত ফরজ নামাজ শেষে দুই রাকার সুন্নত নামাজ পড়ার আগমুহূর্তে শুধু আরো চোখে একবার নিজাম উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ও বাপজান , ভিজেতো একেবারে চুপসাইয়া গেছো, কাপড় বদলায়া নামাজ পইড়া লোও বাপজান”। নিজাম উদ্দিনের মা, মন্টুকে নিয়ে কুপির আলোয় পড়াতে থাকে “ও” তে অজগর, ওই অজগর আসছে ধেয়ে”। নাজমা আপা শুকনা গামছা নিয়ে নিজাম উদ্দিনের দিকে এগিয়ে দেয়, : “তাড়াতাড়ি মাথা মুছে না”। নিজাম উদ্দিন হাতমুখ ধুয়ে শুকনো কাপড় পরে বাবার পাশে মাগরিবের নামাজ আদায়করে পড়তে বসে। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠে একজন বিব্রস্ত পাগল লোকের ভয়ার্ত, আতংকিত মুখ।