ইউক্রেন থেকে:-
মেঘের পলেস্তারা দিয়ে ঢাকা রাতের আকাশে তারা দ্যাখা যায়না। অন্ধকার ভোর, ধূসর দিনেরা বৃষ্টিহীন,…শুধু পাতার ওপর টুপ টুপ পড়ে কয়েক ফোঁটা শিশিরের জল, মরে যায় নীরবতার শব্দ।
অনেক দূরে রুপাখালীর মেঠো পথে তেমনি গড়ায় গরুর গাড়ী, কাঠের চাকার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ আমার মাথার ভেতর ধারালো ব্যাথার দৈর্ঘ্য টেনে বাড়ায় শুধু। বাঁশবনে ল্যাংড়া প্রেতাত্মা ফুঁপিয়ে কাঁদে আগের মতোই,… আমার ঘুম আসেনা…,
…ভারী বাতাস প্রাক্তন প্রেমিকার হৃদয়ের চাইতেও শীতল মনে হয়।
স্কুলের দেয়াল টপকে ‘শিশু মঙ্গলের’ ভেতর দিয়ে পালিয়ে সিনেমা দ্যাখার কথা ভুলে যাইনি এখনো, নির্মম বেত্রাঘাত কোনদিনই ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি আমাদের! অনেক কথা মনে আসে,…টাউন হলের মাঠে বসে কোনো এক হেমন্তের বিকেলবেলায় বন্ধুদের নিয়ে ‘সত্যিকার’ সিগারেট ফুঁকতে শিখেছিলাম!
স্কুল ফাঁকি দিয়ে পাড়ার মুদির দোকানে বইখাতা ফেলে চলে যেতাম অনেক দূর…, অস্পষ্টভাবে মনে আছে,…ভর দুপুরে গোমতীর তীরে কাশবনে ঘুরে বেড়ানোর পর নৌকোয় নদী পার হয়ে রেললাইন ধরে হেঁটে ফিরতাম শহরে, বাড়ি ফেরার সদিচ্ছে হতো না বলে বই-খাতা বগলে ফেলে চলে যেতাম ধর্মসাগরের পাড়ে, বিশুদ্ধ বাতাসে সবুজ ঘাসে বসে বিশাল দীঘির ঢেউ গুনে অনেক সন্ধ্যা কেটেছে যেখানে, …রাতে বাড়ি ফিরে পিটুনির কথা নাহয় বাদই দিলাম!
মনে করলে দুঃখ আসে, আর দুঃখ ভুলে থাকার জন্য আমাকে অনবরত মনে করে যেতে হয় ,… আমার অন্য কোনো উপায় নেই।
ছেলেবেলা আর স্কুল জীবনের পুরোটাই কেটেছে কুমিল্লায়। জিলা স্কুলে পড়ার সময় মাঝে মাঝে বিকেলবেলায় চলে যেতাম রেল স্টেশনে। স্লিপারের ওপর তেলের দাগ, ধোঁয়া এবং ভারী বাতাস…, আমরা বসে থাকতাম বুকস্টলের কোনায়, রেলগাড়ির আসা যাওয়া দেখতাম। কুলি, চাওয়ালা, সিগনালম্যান এবং যাত্রীদের ব্যস্ততা আর কোলাহলে মুখর স্টেশনের আলাদা ‘নিজস্ব জীবনের’ অংশ হয়ে যেতাম আমরাও। নোংরা ওয়েটিংরুমের বাইরে যাত্রীদের ছেলেপিলেরা নোংরা হাতে বিস্কুট নিয়ে হা করে অবাক চোখে দেখতো বিশাল লম্বা রেলগাড়ি ,…আর ব্রিজের ওপর দাড়িয়ে আমরা দেখতাম বকের মত সিগনালের পাশ দিয়ে দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া রেললাইন। অনেক দূর থেকে এখনো রেলস্টেশনের সেই অদ্ভূত গন্ধ পাই আমি,…সেই যে আমার নানা রং এর দিনগুলি!
এর মধ্যে অনেক জল গড়িয়েছে নদীতে। অনেক বড় আর উঁচু হয়েছে কুমিল্লা, বেড়েছে নতুন মুখ। সময় বদলায়, বদলায় মানুষ,…অথচ শিমুল আর কৃষ্ণচুড়ায় রং লাগে আগের মতোই,… দাউ দাউ আগুনে জ্বলে শহর। প্রসারিত হয় পথ-ঘাট, শুধু ওখান দিয়ে চলেনা জলিল খানের সাইকেল। মাঠে-ঘটে, পথের কোনায় ক্যানভাসারদের আড্ডা হয়তো বসে এখনো, তবে চশমার পেছনে ওদের চোখের রং এদ্দিনে বদলে যাবার কথা! ‘লটকন’ কিংবা ‘মাইলং’ এর নাম শোনেনি আজকালের ছেলেপিলেরা,…উঠোনগুলোয় ডাঙ্গুলি, কুতকুত কিংবা মার্বেলও হয়তো খেলেনা কেউ আর। সময় নেই আমাদের, তাছাড়া যান্ত্রিক জীবনে অনুভূতির জায়গা কোথায়?
হারিয়ে গেছে সেসব দিন,…যা হারায়, ফেরেনা কখনো।
সারারাত ধরে কেউ ডালপালা ভাঙে আমার মাথার ভেতর, আমার ঘুম আসেনা। ‘নির্জনতার আশীর্বাদ’ বলে এখন আর কোনো কথা নেই! অস্তিত্বের আধখানা ঘুণপোকা খেয়ে নিলে কি হবে ডানা মেলে?
ফিরে যাবার পথ নেই…,
…আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ!
দাদা,
কোথায় যেন একটা জমাট অভিমানের গন্ধ পাচ্ছি।
কে সে? সে কি আপনার স্বদেশ?
ফিরে যাবার পথটা যে কখন হারিয়ে গেছে, নিজেরাই জানি না।
ভাল থাকুন…
যে বাংলার “মায়া ভরা পথে হেটেছি এতটা দূর”, সেই পথে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার অদ্ভূত এক ব্যাকুলতা ফুটে উঠে আপনার লেখায়. স্বল্প সময়ের জন্য হলেও মন ফিরে যায় সেই বাংলায় যার প্রতিটি ধুলি কনার সাথে মিশে আছে আমাদের শৈশব, কৈশোরের অনেক স্মৃতি. অনেক ধন্যবাদ অমিতাভদা.
ছোট বেলা বিমল মিত্রের উপনাস পড়তাম। মনে হয় সেধরনের আর একটি লেখা আজ আবার পড়লাম। *good*