1

ইউক্রেন থেকে:-

ছোটবেলায় সবচাইতে প্রিয় জিনিস ‘টিনের পিস্তল’ নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সময় ছোটখাটো মাস্তান মনে হতো নিজেকে, হাতছাড়া করার কোনো ইচ্ছে ছিল না বলে রাতে ঘুমোতাম বালিশের তলায় রেখে। লাল রঙের কাগজের রোলে বারুদের গুটি বসানো গুলি কিনতাম, অচমকা ট্রিগার টিপে ফটাস্ শব্দে ছেলেপিলেদের ভয় পাইয়ে দিয়ে মজা পেতাম খুব! “একাত্তুরের যুদ্ধ” খেলার সময় সবচাইতে প্রয়োজনীয় জিনিস ছিল ওটা।

2

ফেসবুকে বন্ধু এহসান জামানের ক’দিন আগের পোস্টে খেলনাগুলো দেখে ছোটবেলার অনেক কথাই মনে পড়ে গেল আজ। ছবিতে জুতোর মত দেখতে ওই টিনের নৌকো আমারও ছিল, তবে লাল রঙের। কুপিতে কেরোসিন ঢেলে সলতেয় আগুন লাগিয়ে ছেড়ে দিতাম ফায়ার ব্রিগেডের পুকুরের জলে, হাল থাকলেও ভট্ ভট্ করে এলোমেলো ভেসে অনেক দুরে হারিয়ে যেত টিনের তরী। মাঝে মাঝে তেল ফুরোলে কিংবা আগুন নিভে দুরে কোথাও থেমে গেলে জলে নেমে সাঁতার কেঁটে নৌকো ফিরিয়ে আনা ছাড়া অন্য উপায় থাকত না। অনেক আগের কথা এইসব, কুমিল্লায় বাগিচাগাঁয় ফায়ার ব্রিগেডের পুকুরের পাশে “গগন কুটিরে” থাকতাম তখন।

3

‘গুলতি’র কথা মনে হলে চোখে জল আসে এখনো! আমাদের দু’বাড়ি পর ছিল সুচিত্রাদের বাড়ি। ঠিক কখন, সঠিকভাবে মনে পড়ে না,… এক বিষন্ন বিকেলবেলায় সুচিত্রাদের উঠোনে টিউবওয়েলের পাশে কামিনী গাছের পাতার আড়ালে বসে থাকা বুলবুলিকে গুলতি দিয়ে নামিয়ে ফেলেছিলাম! মাটিতে পড়ে বার কয়েক ডানা ঝাপটে আমার চোখের ওপর মরে গেল অসহায় পাখী, গুলতির মার্বেল মাথায় আঘাত করে।পাশে দাঁড়ানো “মনমোহন কুটিরের” নুরুল ওহাব (ডাক নামটা এখন আর মনে পড়ে না) উত্তেজনায়  লাফিয়ে উঠে হাততালি দিলেও নিজেকে আমার গানফাইটার  মনে হয়নি তখন। কামিনী গাছের তলায় দুফোঁটা রক্ত পড়েছিলো, আমি মাটি চাঁপা দিয়ে মৃত পাখি হাতে নিয়ে নিঃশব্দে সড়ে পড়েছিলাম। এরপর জানিনা, কি কারনে অনেকখানি বদলে যাই আমি, ওই বিকেলে গুলতি ফেলে দিয়েছিলাম পুকুরের জলে, পরদিন পেট ব্যাথার নাম করে ইস্কুলে যাইনি, আরো দু’দিন কারো সাথে কথা বলার চেষ্টা করিনি,… শুধু বিকেলবেলায় পাড়ার শিবমন্দিরের সিঁড়িতে চুপচাপ বসে থাকতাম।

…এরপর আর কখনো গুলতি হাতে নেইনি, মার্বেল খেলার ডাকও উপেক্ষা করেছি। অনেক জল গড়িয়েছে সেই সময় থেকে, বদলেছে জীবন,…সময়, এবং অনেক কিছুই। অকারনে মরে যাওয়া বুলবুলির স্থির চোখ আমায় এখনো বিষন্ন করে দ্যায় সময়ে অসময়ে, মনের ভেতর অপরাধবোধ কাজ করে আগের মতোই। ওটাই  আমার জীবনে প্রথম ‘বড় ধরনের’ পাপ!

4

প্রতিবছর ‘পরবর্তী’ ক্লাসে উঠলে পাড়ার বই-দোকান থেকে কেনা হতো নুতন বই। কান্দিরপাড়ের এক নামকরা স্টেশনারী দোকান থেকে আসতো কাগজ-কলম, খাতাপত্র, জ্যামিতি বাক্স, রেডিও বন্ড কাগজ ইত্যাদি,…আরো আসতো বিখ্যাত ‘ব্রাউন পেপার’, যা দিয়ে বইয়ের মলাট লাগানোর ধুম পড়ে যেতো! একমাত্র আনন্দ ছিল ‘ওটাই’,…এবং ওই পর্যন্তই, কারন ইস্কুলে যাবার নাম উঠলে নিয়মিত পেট-ব্যাথা আর জ্বর আসত ঠিকই!

অনেক কথা হলো আজ, বাকী সব পরে বলা যাবে।বাগিচাগাঁয় আমাদের এককালের (সাময়িক) বাসস্থান “গগন কুটির” এখনো আছে কিনা জানিনা। ছেলেবেলার সাথীদেরও খোঁজ নেই কোনো,…তবে কে কোথায় কেমন আছে, খুব জানতে ইচ্ছে করে! সুচিত্রাকে  “একদিন ঠিকই বুড়ী হবি” বলে ঠাট্টা করলে রেগে যেত সেই সময়,…কত বয়স এখন ওর, কোথায় আছে, তাও জানিনা! শিব মন্দিরের কোনায় শিউলি গাছটা শরতে পাগল করে দেওয়া গন্ধের শাদা ফুলে ছেয়ে যেত,…এখনো বেঁচে আছে কি? শুধু বুলবুলি আর ওই ধরনের দু’একটা বেদনাদায়ক কাহিনী ছাড়া বাকি সব এখন “bliss of solitude” হয়ে আছে আমার জন্যে, এতোদিন পরেও ভুলে যাইনি কিছুই!

এরকম হাজারো কাহিনী আছে ছোটবেলার, মনে এলে বানের জলের মত বাঁধ ভাঙে, কুল-কিনারা ছাপিয়ে দ্যায়, ভেসে যাই আমি…, অনেক রাতে জেগে থাকি, দুঃখ পাই,…বড় ভয়ংকর এইসব ঘুমহীন রাত!

 

2 মন্তব্য

  1. অমিতাভ্দা, অনেক দিন পর আপনার লেখা পড়ে খুব ভালো লাগলো. অনেক আগে একসময় পন্ডিত অজিয় চক্রবর্তীর গান খুব বেশি শুনতাম. তার কন্ঠে গাওয়া একটি প্রিয় গান,”কুল ছেড়ে এসে মায দরিয়ায় পিছনের পানে চাই. ফেলে আসা তীরে কি মায়া যে টানে, মন বলে ফিরে যাই”. কিন্তু আমাদের আর ফিরা হয়না, হয়তবা সম্ভব ও না. কিন্তু স্মৃতি মাখা, ফেলে আসা এই দিনগুলো কি ভোলা সম্ভব ? ধন্য বাদ অমিতাভ্দা, ভালো থাকুন, আরো লিখুন.

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন