যেদিনই আমি নার্সিং হোমটিতে যাই, ফিরে আসি মনে কষ্ট নিয়ে।
নার্সিং হোমে বুড়োবুড়িরা থাকেন, তারা নার্সের সাহায্য ছাড়া চলতে পারেন না। নার্সিং হোমের বাসিন্দারা ওল্ড হোমের বাসিন্দাদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে। এইধাপ জীবনের শেষ ধাপ, মৃত্যুর দিকে। এরপরের ধাপ কফিন।
আমি ভলান্টিয়ার, এক পোলিশ বুড়ো রুডিকে সঙ্গ দেই। সে কেবল তার বিছানা থেকে উঠে বসতে পারে। তারপর আবার নিজেই শুয়ে পড়তে পারে। এর বাইরে কিছু দরকার হলে নার্স ডাকতে হয়। গত ফাদার্স-ডে সন্ধ্যায় আমি তাকে দেখতে গিয়েছিলাম।
আমি কথা শুরু করেছিলাম অনেক আগ্রহ নিয়ে। তার মনকে রঙিন করতে আমি তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম তার যৌবনের সময়ে। পোল্যান্ডে তার সেই রঙিন দিনগুলোতে! পঞ্চাশ বছর আগে প্রথম তার মেয়েবন্ধুর সঙ্গে কফি খাওয়া, তারপর একসঙ্গে সিনেমা দেখা, তারপর সিনেমা দেখতে গিয়ে প্রথম চুমু খাওয়া। তারপর তারই সঙ্গে ৫২ বছরের বিবাহিত জীবনের গল্প।
গল্প বলতে বলতে মাঝে মাঝে রুডি থেমে যাচ্ছিল যেন ভুলে গিয়েছে। তারপর দাঁতবিহীন মুখে হেসে বলছিল, ‘আমি কাজ করতাম ওর থেকে দূরে, তিন-ঘণ্টা ট্রেনের পথ। সপ্তাহান্তের জন্য পুরো সপ্তাহ ব্যাকুল হয়ে থাকতাম’, তারপর একটু থেমে আমার দিকে তাকিয়ে বুড়ো বাচ্চাদের মতো দুষ্টু হাসি হেসে বলল, ‘ইয়াংম্যান ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, হুয়াট এ টাইম!’
আমি একটু খোঁচা দিলাম, ‘খুলে বলো, বুঝলাম না’।
‘হে হে হে হুয়াট এ টাইম! ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড। আই ওয়াজ অনলি টুয়েন্টি ফাইভ, শী ওয়াজ টুয়েন্টি ওয়ান, ভেরি ওয়াইল্ড টাইম! হে হে হে ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড।’
রুডির চোখমুখ উজ্জ্বল হতে থাকে গল্প বলতে বলতে। দাঁতহীন হাসিমুখ দেখতে বাচ্চাদের মতো লাগছিল। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে বলছিল, ‘ফাউক (ফারুক) ইউ স্টে, ডোন্ট গো’। তার মনে একটা আশঙ্কা হয়তো কাজ করছিল যে, তার গল্প অসম্পূর্ণ রেখে আমি চলে যাব।
তার মেয়েদের প্রসঙ্গ আসতে জানলাম সকালে তার দুই মেয়ে এসেছিল তাকে বাবা দিবসের শুভেচ্ছা জানাতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েরা তাকে বাইরে গাড়িতে করে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল কিনা। সে বলল “না”।
গাড়ি প্রসঙ্গ আসায় রুডি আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি কি গাড়ি চালাই। আমি বললাম আমার গাড়ির নাম। সে বললো, ‘সুঃইশ (সুইডিশ) কার’। তারপর বললো, যে সে পছন্দ করতো স্কোডা যা চেকোস্লোভাকিয়ান। বুড়ো হয়তো জানে না যে, স্কোডা এখন জার্মানির ভক্সওয়াগেন কোম্পানি কিনে নিয়েছে। দুনিয়াটা এখন কেনা-বেচার। কে যে কাকে কিনে নিচ্ছে!
রুডি নিজের শরীর ছেড়ে দিল বিছানায় ধপাস করে। কিছুক্ষণ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠে বসলো। তারপর আমাকে তার ক্লোজেট খুলতে বলল। আমি খুললাম। ক্লোজেটে দশ-পনেরটা শার্ট এবং জ্যাকেট হ্যাঙ্গারে ঝোলানো। সে বিছানায় বসে নীল জ্যাকেটটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে বলল, ‘বু (ব্লু) জ্যাকেট, গিভ মি বু ওয়ান’। আমি নীল জ্যাকেটটা দিলাম তার হাতে। সে সেটা পরিয়ে দিতে বলল। আমি পরিয়ে দিলাম।
ঘরে ঠাণ্ডা ছিল না। তার জ্যাকেট পরার কারণ বুঝতে পারছিলাম না। হয়তো তার শীত লাগছিল। কিন্তু তারপর সে যা বললো তা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘টেক মি আউট ফর এ ড্রাইভ’। আমি? আমি কীভাবে তাকে নিয়ে বাইরে যাব? আমার তো অনুমতি নেই। আমি শুধু কথা বলতে পারি তার সঙ্গে – আমি কথার মানুষ। শুধু একবার এক বুড়োকে বাইরে নিয়ে গিয়েছিলাম।
তখন আলেক্স নামের এক স্কটিশ বুড়োর ভলান্টিয়ার ছিলাম। নার্সিং হোমের অনুমতি নিয়ে তাকে একটা শপিং মলে নিয়ে গিয়েছিলাম কফি খাওয়াতে। সে অতি কষ্টে হাঁটতে পারতো। সে গাড়িতে উঠে বসেছিল আমার শরীরের ওপর ভর দিয়ে, নেমেছিল একইভাবে। সারাক্ষণ আমি উৎকণ্ঠায় ছিলাম। আলেক্সের অস্ট্রেলিয়ায় কেউ ছিল না। রুডির মেয়েরা তো এখানে আছে!
আমি রুডিকে ব্যাখ্যা করলাম যে, আমার অনুমতি নেই তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার।
তাকে বিষন্ন লাগলো। সে মেঝের দিকে তাকিয়েছিল। আমি কঠিন হৃদয়ের পরিচয় দিলাম – তার জ্যাকেট খুলে দিলাম। তারপর তা আবার ক্লোজেটের ভেতরে হ্যাঙ্গারে রেখে ক্লোজেট বন্ধ করে দিলাম।
ভাবছিলাম প্রসঙ্গ পাল্টাতে হবে। দেয়ালের সঙ্গে লাগানো ডেস্কে দুটো কার্ড দাঁড় করানো দেখলাম। কার্ড দুটো নিয়ে রুডির বিছানার পাশে চেয়ারে বসলাম। কোনটিই তার জন্মদিনে দেওয়া আমার কার্ড ছিল না। দুটোই তার মেয়েদের দেওয়া ফাদার্স ডে কার্ড। একটা কার্ডের ভেতরে পোলিশ লেখা, আমি পড়তে পারলাম না। অন্যটির ভেতরের পাতায় ইংরেজিতে লেখা – আই লাভ ইউ সো মাচ ড্যাড। আরও দুটো ইংরেজি লাইন ছিল যা আমার এখন মনে নেই।
আমি যখন কার্ডের লেখা পড়ছিলাম, সে কার্ড দুটো চাইলো। আমি পোলিশ লেখা কার্ডটা তার হাতে দিলাম। সে বলল কোন কার্ড কোন মেয়ে দিয়েছে।
রুডি কার্ডের লেখা পড়লো। তারপর আমার দিকে তাকালো। কিছু ভাবলো। তারপর দুহাত দিয়ে কার্ডটা ধরে দুদিকে টানতে লাগলো। আমার কয়েক মুহূর্ত লাগলো বুঝতে যে বুড়ো কার্ডটা ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছিল। তার হাত এবং আঙ্গুলগুলো কাঁপছিল। যে মানুষটি যুবক বয়েসে পোলিশ আর্মিতে মেশিনগানের ট্রিগার টানতো সে একটা কাগজের তৈরি শুভেচ্ছা কার্ড ছিঁড়তে পারলো না।
সময় মানুষকে এমনিভাবে অসহায় করে!
আমি কার্ডটা তার হাত থেকে উদ্ধার করলাম। তারপর তার দিকে তাকালাম তার অনুভূতি বোঝার জন্য। রুডি বলল, ‘পুট ইন দ্যা ট্র্যাশ, পুট ইন দ্যা ট্র্যাশ’। আমার বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো।
রুডির মতো আমিও হয়তো একদিন তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকবো ছেলে-মেয়েদের আসার অপেক্ষায়। তাদের একটু দেখতে পাবো। তারপর আবার একাকিত্ব – তা দেশেই হোক আর বিদেশেই হোক।
দেশে এবং বিদেশে এ অবস্থার তফাৎ আছে। দেশের অনেক হতভাগা বুড়ো-বাবাদের কষ্ট অনেক বেশি। তাদের অনেকের ভাগ্য পুত্রবধূদের হাতে। সংসারে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আমি খুব কম সংসারী পুরুষের মাঝে দেখেছি। ফলে খেতে বসে অনেক বুড়ো-বাবা চোখের দুই ফোঁটা পানি ফেলেন সবার অগোচরে। অনেকে দিনের পর দিন দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখতে রাখতে শ্বাস ত্যাগ করেন চিরকালের মতো।
দেশে নিজের আত্মীয়দের মধ্যে দেখেছি গ্রাম বা মফস্বল থেকে বুড়ো-বাবা ছেলে-নাতিদের দেখতে ঢাকা আসতে চান। দুটোদিন তাদের সঙ্গে থাকতে চান। কিন্তু বাচ্চাদের পরীক্ষা, ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার ক্ষতি হবে, তাই ছেলের (বা ছেলের স্ত্রীর) মত – যেন পরীক্ষা শেষ হলে তিনি আসেন। ছেলেমেয়েরা ভালো স্কুলে পড়াশুনা করবে, বয়সে বড় হবে, বড় ডিগ্রি হবে, বড় চাকরি হবে। ফুলস্টপ।
যে বাবা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কষ্ট করে তাকে বড় করেছে তার জন্য দুটোদিন ব্যয় করতে কত অজুহাত!
মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ!
সময় আমাদেরও সেই অবস্থায় নিয়ে যাবে। সেই দিন বেশি দূরে নয়।
ফারুক ভাই, সুন্দর এই লেখার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আপেক্ষায় রইলাম আরো একটা সুন্দরের জন্য…
আপনার লেখা পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল ফারুক ভাই।সুন্দরভাবে উপস্থাপনার জন্য এ ধরনের অনুভূতি তৈরি হয়েছে।ধন্যবাদ আপনাকে।