লন্ডনের আন্ডার গ্রাউন্ড বা টিউব রেলে যারা চড়েছেন তারা জানেন এর নেটওয়ার্ক কত বিস্তৃত। উত্তর দক্ষিণ, পূর্ব পশ্চিম এর সাধারণ লাইন ছাড়াও এর উত্তর পূর্ব, দক্ষিণ পূর্বের মতো আরো অনেক লাইনের শাখা প্রশাখা রয়েছে । সেবার মান এবং তা ধরে রাখার জন্য এদের চেষ্টা ও লক্ষ্য করার মতো । ঘড়ির কাটা ধরে সব ট্রেন চলছে, আমার দেড় বছরের লন্ডনের জীবনে কোনো দিন এর ব্যতিক্রম হতে দেখিনি । কিন্তু গুনগত মান উন্নত হওয়া সত্ত্বেও ট্রেনের কামরায় প্রবেশের পর কেন জানি মনটা খারাপ হয়ে যেত । এর কারণ মনে হয় ভিতরকার ভয়াল নিস্তব্দতা এবং আশে পাশের যাত্রীদের অদ্ভুত চাহনি । মনেহতো ভিন্ন গ্রহ থেকে বিরল প্রজাতির কোনো প্রাণী ট্রেনের কামরায় আবির্ভূত হয়েছে । মনে আছে একদিন সেন্ট্রাল লন্ডনে মেজো ভাইয়ের বাসার কাছে Euston স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছি, দরজার কাছের সীটে দুই ইংরেজ বুড়ো বুড়ি বসে আছে । ওদের পাশের খালি সীটে বসার সাথে সাথে আমার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে সরে গিয়ে অনেক দূরে আর এক সীটে গিয়ে বসলো । মুখে না বললেও অনুভব করছিলাম উনারা বোঝাতে চাইছেন, “You don’t belong to this place”. খেয়াল করলাম আশে পাশে বইয়ের পাতায় ডুবে থাকা এক দুই জন আড় চোঁখে আমার দিকে তাকিয়ে আবার বই পড়াতেই নিমগ্ন হলেন । একই ঘটনা আরো কয়েকবার ঘটেছে বাসে এবং ট্রেনে. প্রথম প্রথম মনে হতো এটি ব্রিটিশ জাত্যাভিমানের বহিঃপ্রকাশ । পরে দেখলাম যে না এটি আসলে ব্রিটেনে বিদ্যমান “systemic racism” এরই অংশ, যদিও লন্ডনে বসবাসরত আমার আত্মীয় স্বজনদের একটি বড় অংশ এখনো তা মানতে নারাজ. হয়তো এতে দোষের কিছুই নেই, অবাক হয়ে লক্ষ্য করতাম “বাংলাদেশী ব্রিটিশ” বা ” ব্রিটিশ বাংলাদেশী” না, অনেকের মধ্যে শুধুই “ব্রিটিশ” হবার অদ্ভুত এক প্রবণতা. সময়ের বিবর্তনে হয়তো অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু একযুগ আগের এই স্মৃতি এখনো অমলিন ।
লন্ডন ছেড়ে টরোন্টোতে এসেছি এগার বছর । আন্ডার গ্রাউন্ড রেলওয়ে বা টরোন্টোর সাবওয়েতে নিয়মিতই এখন চড়ি, বলতে গেলে প্রতিদিনই । এই সাবওয়ে লন্ডনের মতো চকচকে না, লন্ডনের মতো আট দশ লাইনের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ও এর নেই । কিন্তু এই সাবওয়েতে উঠলে মন খারাপ হয়না, কখনো মনে হয়না এই কামরায় আমি অনাহুত কেও একজন । তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিও কখনো চোখে পড়ে না । বরং মনে হয় বসে আছি বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের চলন্ত এক সম্মেলন কক্ষে. সোমবারে সকালে কাজে যাওয়ার প্রচ্ছন্ন অনিহা মাখা মানুষের মুখের ভিড় ঠেলে যখন ট্রেনে উঠি, অথবা শুক্রবারের বিকেলে যখন সপ্তাহান্তের ছুটির আমেজে পুলকিত যাত্রীদের পাশ কাটিয়ে ট্রেন থেকে নামি, মন তখনও ভরে উঠে আশ্চর্য এক প্রশান্তিতে । উপলদ্দি করি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে আপন করে নেবার, “Sense of Belongingness” দেবার উদারতা এবং বিশালত্ব সম্ভবত একটি দেশেরই আছে. এটি এমন একটি দেশ যেখানে মানুষ পরম নিশ্চিন্তে সম্মৃদ্ধ করে চলে তার সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা, ধর্মীয় বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের ভিত । যেখানে নির্ধিষ্ট ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে কোনো বিশেষ জন গুষ্টিকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা বা দেয়াল তুলে নিরাপত্তা কায়েমের দুঃসাহস কেও কল্পনাও করতে পারে না ।
স্রষ্টার অপার করুনায় সিক্ত, কৃতার্থ হয়ে তখন ভাবি, এগারো বছর আগে নেওয়া সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না ।
সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো
একদম ঠিক হাসান ভাই, আমি প্রথম যখন লন্ডনে যাই তখন ছিলাম তৎকালীন বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সেক্টরেটরির বাসাতে, তার বাসা ছিল ক্লারেনডন গার্ডেনে, আপনি ভালো চিনবেন। যখন এয়ারপোর্ট থেকে নেমে underground- এ গেলাম, মোটামুটি তিন বার রাস্তা ভুল করেছি, কি যেন জুবলী লাইন আরো কি, যাহোক অবশেষে ওরা এসে আমাকে কোনো এক এস্টেশন থেকে পিক আপ করে নিয়েছিল। Oh what an ordeal?
আর আপনি বলেছেন ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে আপন করে নেবার, “Sense of Belongingness” দেবার উদারতা এবং বিশালত্ব সম্ভবত একটি দেশেরই আছে। আমি একটু বাড়িয়ে বলবো যে, আমি পড়াশুনা, কাজ এবং ভ্রমণের কারণে এস্কান্ডেনেভিয়া, দক্ষিণ ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, সাউথ ইস্ট এশিয়া, সাউথ এশিয়া এবং আফ্রিকার প্রায় ২২ টি দেশে গেছি এবং এদের মধ্যে বলতে গেলে কানাডাতেই এই সেন্স অফ বেলংগিংনেসটা বেশি। ভারত, থাইল্যান্ড , সিঙ্গাপুর ইত্যাদি এশিয়ান দশ, এবং মোটামুটি আমাদের সংস্কৃতির কাছাকাছির হলেও এখানকার মতো সেখানে এতটা স্বাচ্ছন্দ বোধ হয় না। আর একটা জিনিস যেটা হলো আমাদের এখানে একটি লোক odd-job করে বা social আসিয়াটেন্স-এ থেকেও যে কোয়ালিটির বাসাতে থাকে তা অনেক দেশে সম্ভব না।
চুরী-চামারি, খুন-খারাবি যে এখানে নেই তা ঠিক না তবে এগুলির জন্য আইনের যথেষ্ট প্রয়োগ আছে এবং তার জন্য উপযুক্ত শাস্তি পেতে হয়। অনেক জিনিস এখনো উন্নতির পথে এবং সে জন্য এরা কাজ করে জাস্ছে এবং ভবিষতেও করবে।
হা, তাই সিদ্ধান্ত আমাদের কখনো ভুল ছিল না, হয়তো স্বপ্ন বা ধারণার থেকে একটু বেশি স্ট্রাগল করতে হয়েছে কিন্তু It paid off!
অনেক ধন্যবাদ মুকুল ভাই. ভালো থাকুন.