trust3

পার্থ, অস্ট্রেলিয়া থেকে :
কয়েক বছর আগে অস্ট্রেলিয়াতে আমার সরকারি চাকরির অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করি। একদিন সকালবেলা কম্যুনিকেশন ম্যানেজার লিয়া ভেজাচোখে আমার ডেস্কের পাশে দাঁড়ালো। পঁচিশতলার কাচের জানালা দিয়ে শীতের রোদে সোয়ান নদীর নীল পানি দেখছিলাম। আমার দৃষ্টি এবং নদীর মাঝে সে, নদীকে কিছুটা আড়াল করে রেখেছিল। দুচোখ লাল। হয় কান্নার জন্য অথবা ঘুম হয়নি। আমি হেসে গুড মর্নিং বললাম। মিনিটখানেকের মাঝেই অবস্থার হেতু জানলাম।

আগের দিন সন্ধ্যার পর অফিসের বড়কর্তা লিয়ার মোবাইলে ফোন করে রাগারাগি করেছিলেন। আমাদের বড় কর্তার রেগে যাওয়ার বাতিক ছিল। রেগে গেলে ‘এফ’ দিয়ে শুরু একটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করতেন না। তবে মনে হয় না তিনি কোনো মহিলা সহকর্মীকে সেই শব্দ ব্যবহার করতেন। কর্তার রাগের কারণ কর্মীর (লিয়া) পাঠানো ইমেইলের এটাচড ডকুমেন্ট। তিনি তা খুলতে পারলেও ফরম্যাট এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। কর্তার রাগের মাত্রা অতিক্রম করার কারণ অনুমান করলাম- ইমেইলের কপি মন্ত্রী মহোদয়ের কাছেও গিয়েছিল। মন্ত্রী মহোদয় আমাদের বড়কর্তারও কর্তা।

অফিসে আস্থা রাখা যায়, বিশ্বাস করা যায় এমন এক-দুজন সহকর্মী সবাই খোঁজে- নিজের অজান্তেই। সম্ভবত সে কারণেই সে আমার কাছে এসেছিল একটু আশার কথা, একটু শান্তনার কথা শুনতে।

বড়কর্তার রাগের ফল কি হলো? একটা মেয়ের রাতজেগে কান্না। তার মনে ভীতির সৃষ্টি, বিশ্বাস বা আত্মবিশ্বাসে ফাটল ধরা। কর্তার কি লাভ হলো? তিনি সঠিক ডকুমেন্ট পেয়ে গেলেন লিয়ার কাছ থেকে আধঘণ্টার মধ্যে- না রাগলে হয়তো আরও তাড়াতাড়ি পেতেন। কারণ আমার ধারণা সেই আধ-ঘণ্টার অর্ধেকটা কান্নায় ব্যয় হয়েছিল।

আমি ভাগ্যবান ছিলাম। আমার এবং বড়কর্তার মাঝে আরেকজন ছিলেন। তিনি বড় কর্তার বিপরীত – সবসময় হাসিখুশি। আমার আর বড় কর্তার মাঝে তিনি অনেকটা পুরু স্পঞ্জের ভূমিকা পালন করতেন। সেই অফিসে আমার ভূমিকা ছিল দশজন ইঞ্জিনিয়ারকে দেখাশোনা করা। আমি কাজ দেখাশুনা করতাম, প্রয়োজনে ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধাও। ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধা দেখাশুনা করার গুরুত্ব অনুভব করেছিলাম দেশে যখন চাকরি করতাম। একবার আমাদের অফিস ধানমন্ডি থেকে গুলশানে ম্যুভ করেছিলাম। আমি আইটি ম্যানেজার ছিলাম। নতুন অফিসে ওঠার পর অনেক কাজ ছিল – সার্ভার, নেটওয়ার্ক ইত্যাদি। একদিন রাত দশটার সময় কাজ করছিলাম। বড় কর্তা আমাকে দেখলেন। তিনি প্রায়ই রাতে অফিসে আসতেন- সময়ের ব্যবধানের জন্য হেড অফিস লন্ডনে যোগাযোগ করতে। তিনি পরদিন আমার রুমে এসে বলেছিলেন, ‘কদিন এমন রাত জেগে কাজ করছেন?’

আমি বললাম, ‘তিন-চার দিন”।

‘আর কয় দিন লাগবে শেষ হতে?’

‘আজ-কালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে’।

তারপর তিনি বললেন, ‘এরপর আপনি সাতদিন অফিসে আসবেন না। ছুটি নেওয়ার দরকার নেই। এটা আপনার জন্য স্পেশাল। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু সি ইওর ফেস নেক্সট সেভেন ডেস।’

এ ঘটনার পর থেকে তার সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। এ সম্পর্ক কাজের দ্বায়িত্বের অনেক উপরে। আমি আমার মন-প্রাণ দিয়ে কাজ করতে শিখেছিলাম। বেতন বাড়ার আশায় না, প্রমোশনের আশায় না। তিনি বলতেন, ‘ইফ ইউ লুক আফটার দিস অর্গানিজেশন, ইট উইল লুক আফটার ইউ’।

আমি প্রায় একইভাবে কাজ করি। আমি আমার সহকর্মীদের কাজের পরিধি বুঝিয়ে দিয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা দেই। লিয়ার মতো কেউ ভুল করলে ভুল থেকে শিখি, শিখতে বলি। কেউ বারবার একই ভুল করলে হাসি, দ্বায়িত্ব আরেকজনের সঙ্গে শেয়ার করতে বলি। সবাই সমান না। কেউ এক মিনিটে বুঝে কাজ শেষ করে ফেলে। কেউ তিনবার বুঝতে আসে, তারপর ভুল করে। কাউকে রাতে কাজ করতে হলে তাকে পরদিন দুপুরের আগে অফিসে আসতে না করি। আমি তাদের প্রত্যেকের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি। অনেকে পারিবারিক সমস্যার কথা শেয়ার করেন। এক স্কটিশ সহকর্মী তার ছেলে কিভাবে বখে যাচ্ছে তা নিয়ে আমার কাছে আক্ষেপ করেন। এক নিউজিল্যান্ডের সহকর্মীর নতুন বাচ্চা রাতে ঘুমাতে দেয় না ইত্যাদি। পারিবারিক সমস্যা জানলে সহকর্মীদের বুঝতে অনেক সুবিধা হয়। সে মোতাবেক তাদের সাহায্য করা যায় – ছুটিছাটা দিয়ে, কাজের পরিমাণ কমিয়ে, বাসা থেকে কাজ করতে বলে – আরও নানাভাবে। কারো যদি মন খারাপ দেখিÑ কফিশপে নিয়ে যাই। আধঘণ্টা আড্ডা দেই। এ আধঘণ্টার বদৌলতে আমি অনেক ঘণ্টার বেশি কাজ পাই- হাসিমুখে। সবচেয়ে বড় কথা সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় – আস্থা আর বিশ্বাসের। অনেকে বলেন, এসব করলে অনেকে সুযোগ নেয়। কথা ঠিক নয়। প্রথম প্রথম দু-একজন সুযোগ নেয় – বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হলে তারা অনুতাপ করে। এ সম্পর্ক পারিবারিক জীবনে আরও গুরুত্বপূর্ণ।

দেশে চাকরি করার সময় এক সহকর্মিনী রুবিনা লিয়ার মতো কাঁদছিলেন। সব দেশের মেয়েদের কান্না একই রকম। সমস্যা কি? তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিবেন কিন্তু ঈদের পর। তার কর্তা বললেন, ‘ঈদ বোনাসের জন্য আপনি ঈদের পর রিজাইন করতে চাচ্ছেন তা বুঝি। ঈদের আগে করলে কি হয়? এত লোভ থাকা ভালো না’। কি মারাত্মক কথা ! তিনি আমার রুমে বসে ফিচফিচ করে কাঁদছিলেন আর ওড়না দিয়ে চোখ মুছছিলেন (সেকালে টিসু পেপারের এত ব্যাপক ব্যবহার ছিল না)। আমি তখন দু-তিন মাস হয় বিয়ে করেছি। বাসায় এসে স্ত্রীকে বললাম ঘটনাটা, ভাবলাম একজন মেয়ে আরেকজনের দুঃখে যদি সমব্যথী হয় ! হিতে বিপরীত হয়েছিল। আমার স্ত্রীর সরল সাদা মুখ বাঁকা হয়ে গিয়েছিল, ‘কেন? অফিসে এত লোক থাকতে তোমার সামনে কানতে হবে কেন? অফিসে মেয়ের অভাব যে তোমার সামনে কানতে হবে?’ এ প্রশ্ন আমার নিজেরও ছিল নিজের কাছে।

পনের বছর পর লিয়ার ঘটনাটা বলেছিলাম আমার স্ত্রীকে, সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, ‘আহা বেচারী ! দিস ইজ পার্ট অফ লাইফ।’

এ পরিবর্তন কি করে হলো? সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে লিয়া আর রুবিনার কর্তাদের সম্পর্কে একটু বলি।

আমি তাদের দুজনকেই ভালো করে জানতাম। দুজনেই ব্যক্তিগত জীবনে বন্ধুসুলভ। তাহলে তারা সহকর্মীদের সঙ্গে এমন আচরণ করেন কেন? রুবিনার কর্তার কথা বলি। একবার আমরা অফিসের সবাই তিনদিনের রিট্রিট এ কুমিল্লা বার্ডে যাচ্ছিলাম। পথের মাঝে চা বিরতি। কর্তার হাতে দেখি তিন প্যাকেট সিগারেট – গোল্ডলিফ, ৫৫৫, বেনসন। জীবনে এমন দেখিনি। ছোটবেলায় এক বন্ধুর বাবাকে দেখতাম গোল্ডফ্ল্যাগ সিগারেটের প্যাকেটে পাতার বিড়ি রেখে খেতেন। কিন্তু তিনরকম তিন প্যাকেট সিগারেট? আমি এগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই বিষয় কি?’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি নরমালি গোল্ডলিফ খাই। যখন অনেক টেনশনে থাকি তখন খাই ৫৫৫। আর যখন রিলাক্সে থাকি তখন বেনসন’। মানে তিনি সবসময়ই টেনসনে থাকেন। মানুষ যখন টেনসনে থাকে তখন সে অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে – গালিগালাজও করতে পারে। টেনসনের কারণ কি? একজন পৃথিবী বিখ্যাত লিডারশিপ কোচ ট্রেনিংয়ে বলেছিলেন, ‘দে রান আফটার টু মাচ উইনিং, টু মাচ সাকসেস’। আমি ভাবি এত দৌড়াদৌড়ি করে হবে কী? এত জিতে হবে কী? এত সফল হইয়েই বা হবে কী, যদি প্রতিদিন নিজে টেনসনে থাকি, সঙ্গে আরও দশজনকে টেনসনে রাখি ? হার্টের ক্ষতি ছাড়া এর কোনো উপকারিতা দেখি না।

পারিবারিক বা দাম্পত্য জীবনে আমরা শুধু ভালবাসার সম্পর্কটাকেই চোখের সামনে দেখি। ভালবাসা ভালো। রোমান্টিক হতে পারলে তো কথাই নেই। কিন্তু ভালবাসা আর রোমান্সের ভিত যদি আস্থা আর বিশ্বাসের ওপর না হয় তবে সে ভালবাসায় ফাটল ধরলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এ ভিত তৈরি হতে সময় লাগে। সংসার জীবনের রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ের মধ্য দিয়ে অনেক বছরে এ আস্থা আর বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়। তখন সহকর্মিনীর কান্নায় স্ত্রীর মুখ বাঁকা হয় না।

তাই কাজে হোক, সংসারে হোক – সম্পর্ক যেন হয় আস্থা আর বিশ্বাসের।

১ মন্তব্য

  1. আনুষ্টানিক বহিঃপ্রকাশ এর চাইতে আন্তরিক অনুভব বেশি প্রয়োজনীয় হলে ও সম্পর্কের ভিতকে মজবুত করার ক্ষেত্রে এখনকার সময়ে বোধ করি দুটো বিষয়ই সমান ভাবেই প্রযোজ্য. পেশাগত ক্ষেত্রে ও এই আস্থা তৈরী করতে অনেক যোগ্যতারই প্রমান দিতে হয়. অনেক ধন্যবাদ ফারুক ভাই, সময় উপযোগী চমত্কার একটি বিষয় নিয়ে লেখার জন্য.

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন