প্রতিদিন মৃত্যুর খবর শুনছি। দিন দিন সংখ্যাটা বাড়ছে, সাথে সাথে বাড়ছে মনের আতংক। এ কেমন রোগ? রোগীর হাঁচি, কাশি, মুখের লালা, শরীরের ঘাম, শরীরের র্স্পশ থেকে হয়ে যেতে পারে এ রোগ! অফিসের গেটে রাখা আছে সাবান, সেনেটাইজার আর পানি। অফিসে ঢুকার আগে ভালোভাবে কনুই পযর্ন্ত ধুয়ে ঢুকতে হবে, তারপর কিছুক্ষণ পর পর হাত ধুতে হবে।এ রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এটাই অন্যতম উপায়। সহকর্মীদের সাথে হ্যান্ডশেক করা বন্ধ হয়ে গেল – সবাই সবাইকে ভয় পাচ্ছে।একজন আরেকজনকে ভাবছে মরণব্যাধি রোগের জীবানু বাহক।স্ত্রী আর একমাত্র মেয়েকে কানাডা থেকে পশ্চিম আফ্রিকার দরিদ্র দেশ লাইবেরিয়ায় নিয়ে এসে কি ভুল করলাম? আমরা না হয় সচেতনভাবে চলাফেরা করব, কিন্তু আমার মেয়ে? সেতো প্রতিদিন স্কুলে যায়। সহপাঠীর সাথে খেলাধুলা করে। স্কুল থেকে যদি ‘ইবোলা’ নিয়ে আসে।
ভেবেছিলাম দুই বছর লাইবেরিয়া থেকে আবার কানাডা ফিরে আসব। উন্নয়ন কর্মী হিসেবে খান ফাউন্ডেশন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং একশনএইড বাংলাদেশ- এ প্রায় ১৩ বছর কাজ করলাম। সেই সুবাদে এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ ও অষ্ট্রেলিয়ার ৩০টি দেশে স্বল্প সময়ের জন্য গিয়েছি। কিন্তু লম্বা সময়তো কাজ করি নি। আর উন্নয়ন কর্মীর জন্য আফ্রিকায় কাজ করার অভিজ্ঞতা নেয়াতো একটা বিশেষ কিছু, অন্ততঃ আমি মনে করি। তাই ‘মানবাধিকার উপদেষ্টা’ হিসেবে একশনএইড ডেনমার্কের (কমর্স্থল লাইবেরিয়া)নিয়োগপত্র পাওয়ার পর সুযোগটা হাতছাড়া করতে ইচ্ছে হলো না। লাইবিরিয়ার রবার্টস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে সপরিবারে নামলাম ২০১৩ সালের ৩০ অক্টোবর। এয়ারপোর্ট দেখে আমার মেয়ে নুহা বলল, ‘বাবা, এটাকেতো এয়ারপোর্ট মনে হচ্ছে না; বাসা মনে হচ্ছে’। সাথে ছিল চৌদ্দটি লাগেজ। বিমানবন্দরের কর্মকর্তা সবগুলো লাগেজ খুলতে বললেন। দীর্ঘ সময় ভ্রমণ করে খুউব বিরক্ত লাগছিল। বললাম, সবগুলো লাগেজ খুলতে হবে? কর্মকর্তার জবাব, ডলার দাও না হয় সবগুলো লাগেজ খুলতে হবে। আমি বললাম, তোমার দেশের উন্নয়নে কাজ করতে এসেছি। তোমাকে ঘুষ দেব না, আমি সবগুলো লাগেজ খুলছি। লাগেজ খুলতে শুরু করলাম, দুইটা খোলার পর সে বুঝে ফেলল আমি তাকে ঘুষ দিব না। বাকী ১২ টি লাগেজ আর আমাকে খুলতে হয় নি।
কানাডা থেকে লন্ডন হয়ে সিয়েরালিওন-এর পর লাইবেরিয়া, প্লেনের খাবার খেতে খেতে সবাই খুউব বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। রাত দশটার দিকে যখন মনরোভিয়া পৌঁছলাম, অফিসের ড্রাইভার একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। সে বলেছিল বাংলাদেশি বা পাকিস্তানি রেস্টুরেন্ট হবে, শুনে খুশি হয়েছিলাম কিন্তু দেখে খুশি হলাম না। রেস্টুরেন্টটা বাংলাদেশি বা পাকিস্তানি না, কোন দেশি তাও জানি না কিন্তু জানলাম যে ‘খাবার শেষ’। অনেক অনুরোধ করার পর যে খাবার দিল তা নির্ধারিত আবাসস্থলে এসে খাওয়ার বৃথা চেষ্টা করলাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই বের হলাম কেনাকাটার জন্য। এদিক সেদিক থেকে আমার কানে দু’টো শব্দ ভেসে আসল – ‘বস ম্যা’।দেখি রাস্তায় যাঁরা বেচাকেনা করছে তাঁরাই আমাকে উদ্দেশ্য করে ডাকছে ‘বস ম্যা’। লাইবেরিয়ায় চাকুরির ইন্টারভিউ চলাকালীন সময়ে ‘গুগল র্সাচ’ করে দেখেছিলাম এখানকার অফিসিয়াল ল্যাংগুয়েজ ইংরেজি। ‘বস’ তো ইংরেজি শব্দ, তবে ‘ম্যা’ কোন শব্দ? বাজারে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি ডাকলাম, ড্রাইভার কাছে এসে বললো ‘লে গো’। স্ত্রী শিউলি মেয়ের স্কুল থেকে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করল ‘ই সা’ ও ‘অ সা’ মানে কি? নুহার ক্লাস টিচার মিসেস গে-কে নুহা কোথায় জানতে চাওয়ার উত্তরে বলেছে ‘নট ই সা, সি ইজ অ সা’। এ রকম শব্দের তালিকা আমাদের বাড়তে লাগল। সপরিবারে লাইবেরিয়ান ইংরেজি শিখতে লাগলাম – ‘ম্যা’ হচ্ছে ‘ম্যান’, ‘লে গো’ হচ্ছে ‘লেটস্ গো’, ‘ই সা’ ‘ইন সাইড, ‘অ সা’ ‘আউট সাইড’। মেয়েকে মনরোভিয়ার একটি ভালো প্রাইভেট স্কুলে (টার্কিশ হোপ ইন্টারন্যাশনাল)ভর্তি করলাম, দুই বছর পর মেয়ে কী উচ্চারনে ইংরেজি বলবে তা নিয়ে ভাবতে লাগলাম।
অফিসে গেলাম। দেখি ল্যাপটপ, বসার জায়গা, স্টেশনারী সামগ্রী কোন কিছুরই ব্যবস্থা করা হয় নি। একটা বসার জায়গা খুঁজে নিয়ে নিজের ল্যাপটপে কাজ শুরু করলাম। ইন্টারনেট ছাড়া কি কাজ করা যায়? কানাডার সাথে তুলনা করাতো ঠিক হবে না, বাংলাদেশের সাথেও তুলনা করা যাচ্ছে না-এত ধীরগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট! দুই বছর কিভাবে কাজ করব? বাসায় আসার পর শিউলী বলল, সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বিদ্যুত ছিল না। এটাই রুটিন, প্রতিদিন এ সময়ে বিদ্যুত থাকবে না। বিদ্যুত না থাকার অর্থ পানিও থাকবে না। লাইবেরিয়ায় শুকনো মৌসুমে প্রচন্ড গরম। বিদ্যুত ছাড়া, পানি ছাড়া, টিভি ছাড়া, এসি ছাড়া শিউলী বাসায় কিভাবে থাকবে? আমরা বাপ-মেয়েতো এই সময়টা বাসার বাইরে থাকব। সমাধান খুঁজতে লাগলাম। একটি ফুল ফার্নিশড্ বাসা পেলাম যেখানে ২৪ ঘন্টা বিদ্যুত, পানি, নিরাপত্তা কর্মী থাকবে ভাড়া প্রতি মাসে ২৫০০ ইউএস ডলার। নতুন বাসায় উঠলাম, দেখলাম ২৪ ঘন্টা জেনারেটর থেকে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়। সরকারি বিদ্যুত বিভাগের উপর ভরসা নেই ইন্ডিয়ান এর্পাটমেন্ট কোম্পানির, সব সময় লোড শেডিং, তাই জেনারেটর ব্যবহার করা হয়। এ সমস্যার সমাধান হলো কিন্তু অফিস? প্রয়োজনীয় কোন কিছুই পাই না। বাংলাদেশের অফিসে যে কাজ ৩০ মিনিটে হতো, সে কাজ এখানে ৩০ দিনেও করাতে পারি না। প্রথম প্রথম খুউব বিরক্ত লাগত। পরে বুঝতে পারলাম এখানে এভাবেই কাজ করতে হবে। ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ, মিটিং পরিচালনা শুরু করলাম। এসব আয়োজনের মাধ্যমে লাইবেরিয়ার ভিন্নতর খাবারের স্বাদ পেলাম: কাসাভা লিফ (একপ্রকারের আলুর পাতা) দিয়ে মুরগি, মাছ ও শুটকির তরকারি – এক তরকারিতেই সব; প্লেনটিন (অনেকটা কলার মত), কাসাভা সিদ্ধ, পাহাড়ী মরিচের আচার ইত্যাদি। একদিন অফিস থেকে স্থানীয় আদিবাসীদের এক অনুষ্ঠানে গেলাম।আমার সাথে জিম্বাবুয়ের এক সহকর্মীও ছিল। কিন্তু সবার চোখ আমার দিকে, তাঁদের কাছে আমি বিদেশি (জিম্বাবুয়ের সে নয়, মনে হয় গায়ের চামড়া কালো বলে)। তাঁরা আমার কথা শুনতে চায়, আমি আমার উচ্চারণে ইংরেজিতে বক্তব্য রাখলাম, আমার স্থানীয় সহকর্মী তা লাইবেরিয়ান ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন (ইংরেজি থেকে ইংরেজি ভাষায় কি অনুবাদ হয়?)।
আস্তে আস্তে লাইবেরিয়ায় অভ্যস্ত হতে শুরু করলাম। পুরোদমে মিশন শুরু করলাম। জাতিসংঘ মিশনের বাংলাদেশি সদস্যদের সাথে পরিচয় শুরু হলো। মনরোভিয়ার অন্যান্য বাংলাদেশি পরিবারের সাথে যোগাযোগ হলো। প্রতিদিন বিকেলে বাসার ছাদ থেকে আটলান্টিক দেখা বা হাটঁতে হাঁটতে আটলান্টিকের পাড়ে চলে যাওয়া উপভোগ করতে লাগলাম। হঠাত করে ইবোলার প্রাদুর্ভাব সব তছনছ করে দিল। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে।বিভিন্ন বিমান সংস্থা লাইবেরিয়ার ফ্লাইট অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা শুরু করেছে। কি করব? কিছুই বুঝতে পারছি না। বিমান চলাচল বন্ধ হলে লাইবেরিয়া থেকে বের হব কিভাবে? লাইবেরিয়ার একমাত্র বড় হাসপাতাল, জনএফ কেনেডি হাসপাতালের এক ডাক্তার ইবোলায় মারা গিয়েছে, হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স সবাই হাসপাতাল ছেড়ে চলে গিয়েছে। এখানে মারা গেলে লাশ বাংলাদেশেও পাঠানো যাবে না কেননা ইবোলায় মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তির লাশ থেকেই ইবোলা সবচেয়ে বেশি ছড়ায়। লাইবেরিয়া যেন হয়ে উঠেছে এক মৃত্যুপুরী। আর থাকতে পারব না। সখের গাড়িসহ সবকিছু ফেলে রেখে বাংলাদেশে রওনা দিলাম ২০১৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। মৃত্যুর হাত থেকে এ যাত্রা বেঁচে গেলাম।
লাইবেরিয়ার মানুষতো লাইবেরিয়ায় ছিল, আছে। ইবোলার সাথে যুদ্ধ করেছে, করছে, হয়ত ভবিষ্যতেও করবে। তাহলে আমরা কেন চলে এলাম? আমরা লাইবেরিয়ান না। সেজন্য? আমরা ভীত ছিলাম? মৃত্যুর কাছ থেকে কতদিন পালিয়ে থাকতে পারব?
জাকির ভাই, লাইবেরিয়ার কঠিন একটি সময়ে আপনার সপরিবারে অবস্থান এবং এর সাথে সংস্লিষ্ট চ্যালেঞ্জ গুলোকে নিপুন ভাবে উপস্থাপনের জন্য অনেক ধন্যবাদ. আরো লেখার অপেক্ষায় রইলাম.
ধন্যবাদ মশিউল হাসান ভাই। সবসময় লিখতে ইচ্ছে করে, তবে সময় বের করতে পারি না। সময় করতে পারলে অবশ্যই আবার লিখব।
ভালো লেগেছে পড়ে। এধরনের অভিগ্যতা বিরল। আমরা যারা বিদেশের মাটিতে জীবনের ঝুকি নিয়ে উন্নয়ন কাজ করি, তাদের কথা খুব কম মানুষ ই জানতে পারে। আপনার মতো আমার অভিজ্ঞ্যতা Sierra Leone এ এবং সেটা পুরপুরি Ebola emergency র সময়। পরে কখন লিখব হয়ত।