নরওয়ে থেকে –
২০০৫ সালে লন্ডনের ভিসার জন্য বাংলাদেশে অবস্থিত ব্রিটিশ এম্বাসিতে ছাত্র ভিসার আবেদন করি, সব কিছু ঠিকঠাক থাকার পরও আমার ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করে আপিল করতে বলে, পরে বোঝতে পারি যে প্রতি বৎসর ওদের একটা নির্দিষ্ট পরিমান ভিসা দেবার অনুমতি থাকে, এর উপরে গেলে ওই বৎসরের জন্য যেকোনো একটা অজুহাত দেখিয়ে আর ভিসা দেয়না। যাই হোক মন অনেক খারাপ হবার পরও আপিল করি ও নিজের অনার্সের পড়ালেখায় মনোনিবেশ করি। মনে হয়েছিল ইংল্যান্ডের ভিসা আর হবেইনা , যাই হোক, ২০০৭ সালে ইংল্যান্ড থেকে একটা চিঠি পাই। সেই দিন প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিলো, চিঠিটা ইংল্যান্ডের হওয়ায় বুঝতে পারিযে আপিলের রেজাল্ট এসেছে। ধরেই নিয়েছিলাম ভিসা হয়নি , তাই বৃষ্টির মধ্যেই তাচ্ছিল্ল ভরে চিঠিটা খুলি। চিঠি খুলার পর প্রথম পৃষ্টাগুলোর কোনো কিছু না পড়েই শেষ পৃষ্টায় যাই সারমর্ম জানার জন্য। সারমর্ম দেখে আমার চুখ তো ছানাবড়া। আমাকে চিঠিটা নিয়ে বৃটিশ এম্বাসি থেকে ভিসা আনতে বলেছে এবং সাথে সাথে ইন্টারভিউয়ের দিনে ভিসা না দেবার জন্য এক প্রকার দুঃখ প্রকাশ করেছে। যাই হোক এক মাসের মাথায় ২০০৭ সালের অক্টবরে ইংল্যান্ডে এসে পৌঁছাই। আমার কলেজ ম্যানচেস্টার উনিভার্সিটির অধীনে ম্যানচেস্টারে হলেও এক সপ্তাহের মধ্যে কলেজ পরিবর্তন করে লন্ডনের সেন্ট্রাল একটা কলেজে বিজনেস ডিপ্লোমার উপর একটা কোর্সে ভর্তি হই। লন্ডনে যখন আসি তখন ক্রয়ডন নামক এলাকায় এক সপ্তাহের জন্য আমার কাজিন সানু আপা এক বাসায় থাকার ব্যবস্তা করে দেন, এক সপ্তাহ পর যা করার তা আমাকেই করতে হবে। দেশে থাকতে সিলেট শহরে ছাত্র রাজনীতি সহ নানা ব্যাপারে জড়িত থাকবার কারণে অনেকের কাছেই প্রায় মোটামোটি পরিচিত ও ভালোবাসার পাত্র ছিলাম যাদের অনেকেই তখন লন্ডনে থাকেন। নিজের পরিচিত স্বজনরাও লন্ডনে ভরপুর , তারপর মেজর টিলার হীরাকে ফোন দিলাম। হীরাকে বললাম লন্ডন এসেছি , ক্রয়ডনে আছি একসপ্তাহের জন্য এর পর কাজ দরকার , কাজ খুঁজে দে। আমি লন্ডনে আসছি শুনে হীরা সে রাতেই আমার অস্থায়ী বাসস্থানে হাজির , আমাকে ওর বাসায় নিয়ে যাবেই যাবে , কি আর করা , সে রাতেই হীরার সাথে ইস্ট লন্ডনে বেথনাল গ্রীন নামক এলাকায় হীরার বাসায় আসলাম, আমাকে পেয়ে হীরা যে কি খুশি। ফোন করে আমাদের সাথে যারাই সিলেটের ছাত্র রাজনীতি ও অন্নান্য বিষয়ে সম্পৃক্ত ছিল সে সব বন্ধুদের খবর দিলো যে আমি ওর বাসায় আছি। পরের দিনই সবাই এসে হাজির, এক সপ্তাহ জুড়ে অনেক আনন্দের মাঝে কাটে। হীরা থাকে ওর খালার সাথে, ওর খালার কোনো সন্তান বা স্বামী নাই , হীরাই উনার ছেলে। এটাই আমার লন্ডনে প্রথম আসা তাই দেশে রেখে আসা পরিবার পরিজনদের জন্য মন খারাপ হচ্ছিলো , হীরার খালা অসম্ভব মায়াবতি একজন মহিলা ছিলেন, তাই যতদিন হীরার সাথে উনাদের বাসায় ছিলাম উনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেছিলেন , খাবার দাবারের কোনো রকম সমস্যা তো হয়ইনি অন্নান্ন যত রকম সাহায্য প্রয়োজন ছিল, বলার আগেই হীরা ও ওর খালা আমাকে সে সাহায্য দিয়েছেন। এক সপ্তাহ পর ছারে নামক ডিস্ট্রিক্টের ফার্নহাম নামক এক ছোট্ট শহরে পড়ালেখার পাশা পাশি কাজ শুরু করি, ৩ মাস কাজ করার পর ভালো আরেকটা কাজের অফার পেয়ে ফার্নহাম থেকে Babu Chowdhury ভাইয়ের অত্যন্ত সুন্দর জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট মিলিনিয়াম সাগরে আইলফ ম্যান নামক দ্বীপে প্রায় এক বৎসর কাজ করি। আইলফ ম্যান দ্বীপে বসবাসকালীন সময়ে বাবু ভাইয়ের আব্বা বীর মুক্তিযুদ্ধা মরহুম জনাব হুমায়ুন চৌধুরীর কাছ থেকে শোনা মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর গল্পগুলো আজও কানে ভাসে। এর পর ২০০৮ সালের মাঝামাঝি আবার লন্ডনে চলে আসি , লন্ডনে থাকাকালীন অবস্থায় লন্ডনের অভিজাত এলাকা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একেবারে পাশে বেলগ্রেইব রোডে, ওয়েস্টমিনিস্টার থাকতাম, সেখানে Anne এর সাথে দেখা হয়, ও আমার মতো নরওয়ে থেকে লন্ডনে পড়া লেখা করতে গিয়েছিলো। পরে Anne কে বিয়ে করে নরওয়েতে চলে আসি।
১৯৭০ সালের আগে থেকে ইংল্যান্ডে স্টুডেন্ট ভিসা সহ অন্যান্ন কাজে বাংলাদেশিদের যাতায়াত শুরু , তবে ইংল্যান্ডে যাওয়া বাংলাদেশিদের প্রায় ৯৭% ই সিলেটি। প্রথমদিকে ইংল্যান্ডে যাওয়া সিলেটিরা বর্ণবাদ সমস্যা , সাংষ্কৃতিক বেধাবেদ, ধর্মীয় মতোবিভেদ সহ না সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন। সামাজিক, ধর্মীয় ও ভাষাগত মতো পার্থক্য থাকবার কারণে সে সময়ে বাংলাদেশিদের জন্য ব্রিটিশ সমাজে কাজ পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। তার পর তারা ব্রিটিশ গার্মেন্টস শ্রমিক হিসাবে ছুটো ছুটো কাজ করতে থাকেন এবং যেভাবে সম্ভব পাউন্ড জমাতে থাকেন। তারা ভালো ভাবেই জানতেন অন্যের কাজ করে এভাবে বেশিদূর আগানো যাবে না , তাই ওই সময়ে বাংলাদেশিরা নিজেদের যা সামর্থ আছে তা নিয়ে কারী ব্যবসায় নিজেদের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করতে থাকেন এবং অনেক প্রতিকূলতার পর আস্তে আস্তে তারা সফল হতে থাকেন। বর্তমান ইংল্যান্ডের প্রায় সমস্ত কারী ব্যবসা সিলেটিদের দখলে, এবং লন্ডন, ম্যানচেস্টার, বার্মিংহাম, সহ ইংল্যান্ডের সব বড়ো বড়ো শহর গুলোতে সিলেটিরা কত শত মিলিয়ন পাউন্ডের ব্যাবসা প্রতিষ্টানের মালিক তা না দেখলে বুঝতে পারবেন না।
বর্তমানে ইংল্যান্ডে বাংলাদেশিদের প্রায় ৪তুর্থ প্রজন্ম চলছে , প্রতি ইলেকশনে বাংলাদেশী কাউন্সিলর ও এম পি রা নির্বাচিত হচ্ছেন , ইংল্যান্ডের বড়ো বড়ো ব্যাঙ্ক সহ মাল্টি ন্যাশনাল প্রতিষ্টানে গেলে ম্যানাজার সহ নানা পর্যায়ে বাংলাদেশিদের দেখতে পাবেন, হটাৎ রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন, কোনো পুলিশ অফিসারকে হয়তোবা রাস্তার কথা জিজ্ঞেস করলে আপনি যদি ভালো ইংলিশ না বুঝেন তবে হয়তোবা খাঁটি সিলিটিতে উনি আপনাকে বাড়ির অবস্থান বুজিয়ে দিবেন কেননা উনার বাপ্ দাদার কেউ একজন হয়তোবা সিলেটের সন্তান। জজ কোর্ট সহ ইংল্যান্ডের হাসপাতাল, সরকারি সেবা প্রতিষ্টান স্কুল কলেজ, উনিভার্সিটিতে আমাদের বাংলাদেশী ছেলে মেয়েরা অনেক সম্মানের সহিত কাজ করছেন।
২০০৭ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত লন্ডনের দিনগুলো অনেক উপভুক্ত করেছি, মনেই হয়নি সিলেটের বাইরে আছি। ইংল্যান্ডে বসবাস কালীন অবস্থায় হীরা , বাবু ভাই , ফারুক ভাই ও ভাবি , সালমা ফুফু, সফিনা আপা, সিপার মামা এবং বিশেষ করে আমার কাজিন শানু আপার অবধান ভুলবার নয়।
লন্ডনের দিনগুলো শেষে এখন নরওয়েতে দিনগুলো গুনে যাচ্ছি , আমাদের আগে তেমন কোনো বাংলাদেশিরা নরওয়েতে আসেননি তাই আমার যারা বিগত ১০ বৎসর আগে নরওয়েতে এসেছি তারা নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ১৯৭১ সালের পর থেকে নরওয়েতে আর যারা এসেছিলেন তারা নানা সমস্যার কারণে এবং বিশেষ করে নিজেদের মধ্যে কোন্দলের কারণে নিজেরাও কিছু হয়ে উঠতে পারেন নি এবং পরবর্তীতে আমরা যারা এসেছি তাদের জন্য কোনো প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে পারেন নি ,তাই বর্তমান সময়ে নরওয়ের বিভিন্ন শহরে বসবাসকারী আমরা কিছু সংখ্যক বাংলাদেশী তরুণ সংগঠক আগামীতে আসা বাংলাদেশিদের জন্য প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং চেষ্টা করে যাচ্ছি বাংলাদেশিদের জন্য কিছু একটা করার যাতে আগামীতে ইংল্যান্ডের মতো নরওয়েতেও আমাদের তৃতীয় কিংবা চতুর্থ প্রজন্ম নরওয়ের মূলধারার সমাজ ব্যবস্তার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে , চাকরি, রাজনীতি সহ নানাবিধ পর্যায়ে সফল হয় এবং তাদের নিজেদের ও তাদের বাংলাদেশী বাবা মায়েদের জন্য সম্মান বয়ে আনতে পারে এবং আগামীতে নরওয়েতে আসা বাংলাদেশিদের জন্য নরওয়ের জীবন সাচ্ছন্দ পূর্ণ হয়। আজকে খবরে দেখলাম লন্ডনের স্থানীয় নির্বাচনে লন্ডনের বিভিন্ন অংশে সিলেটি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ-বাংলাদেশী ছেলেমেয়েরা প্রায় গণহারে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন যা আমাদের বাংলাদেশিদের জন্য সত্যি গর্বের বিষয়। আর এটা হতে পেরেছে ব্রিটিশ সমাজ ব্যবস্তার মূলধারায় বাংলাদেশিদের মিশে যাবার কারণে। আর এটা হতে পেরেছে কারণ বিগত দিনগুলোতে যে বাংলাদেশিরা ইংল্যান্ডে এসেছিলেন তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে একটা প্লাটফর্ম তৈরী করে দিয়েছিলেন বলে। নরওয়েতে আমরা যারা তরুণ সংগঠক আছি, যারা বাংলাদেশিদের জন্য কাজ করে যাচ্ছি, আশা করি আমরাও একদিন সফল হবো, আশা করি আমাদের ছেলেমেয়েরাও নরওয়ের বিভিন্ন প্রান্তে নরওয়েজিয়ান কাউন্সিলর , এম পি হয়ে বাবা মা ও বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।
মন থেকে করা কোনো কাজই বিফলে যায়না। আশা করি আগামী কয়েক বৎসরের ভেতর নরওয়ের পূর্ব থেকে পশ্চিমের সব শহরে বাংলাদেশের পতাকা উড়বেই উড়বে।