নরওয়ে থেকে:-
নরওয়ে সরকারের সবচেয়ে বড় আয় হচ্ছে কর এবং শুল্ক খাত। নরওয়ের প্রায় প্রত্যেক নাগরিকের কাছ থেকে ৩৫% ইনকাম ট্যাক্স নেয়া হয়, কারো কারো কাছ থেকে তাদের আয়ের ৩৫% এরও বেশি টাকাও কেটে নেয়া হয়,, এটা করা হয় যাতে সমাজের মাঝে ধনী গরিবের বিরাট একটা শ্রেণী বৈষম্য সৃষ্টি না হয়।
ষাটের দশকের আগে পর্যন্ত নরওয়ে ইউরোপের অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে গরিব একটা দেশ ছিল তাই নরওয়ের জনগণ টাকা পয়সা খরচের ক্ষেত্রে অনেক কঞ্জুস প্রকৃতির ছিল। কিন্তু ষাটের দশকে নরওয়ে যখন তেল ও গ্যাস তুলতে শুরু করে তখন নরওয়ের অর্থনীতি রাতারাতি পাল্টে যায়। সারা দেশজুড়ে পরিবর্তন আসতে থাকে, সরকারি প্রতিষ্টানগুলো অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং সাধারণ জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে সঠিক ও সুন্দরভাবে দেখভালেরও আওতায় আসে।
কিন্তু ষাটের দশকের আগে পর্যন্ত নরওয়ের মানুষেরা যেহেতু তুলনামূলক ভাবে গরিব ছিল এবং তারা যেহেতু টাকা পয়সা খরচের ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিল তাই ষাটের দশকের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরও বিশাল পরিমানের নরওয়েজিয়ান জনগণের মধ্যে কঞ্জুষি স্বভাবটা বদলায়নি। তাই ষাটের দশকের পর বুড়ো হয়ে যাওয়া অনেক নরওয়েজিয়ানদের ব্যাঙ্ক একাউন্টে কোটি কোটি টাকা ছিল যা কঞ্জুষি স্বভাবের কারণে এরা ব্যবহার না করেই মারা গিয়েছিলো । এছাড়া এরা সারা জীবন পরিশ্রম করে লক্ষ লক্ষ টাকা পেনশন জমালেও হটাৎ মরে যাওয়ার কারণে অনেকেই সারা জীবনে অর্জিত তাদের পেনশনের টাকাও উপভোগ করে যেতে পারেনি।
নরওয়েতে নিজের ব্যাংকে জমানো টাকা পয়সা যদি আপনি মারা যাওয়ার আগে আপনার ওয়ারিশদের ডকুমেন্ট করে না দিয়ে যান তবে সে ক্যাশ টাকা পয়সা সরকারের নিজস্সো ফান্ডে চলে যায়, এভাবেই বিগত ৫০ বছরে লক্ষ লক্ষ নরওয়েজিয়ানদের ব্যাংকে জমানো বিলিয়ন বিলিয়ন নরওয়েজিয়ান ক্রোনার তারা মারা যাওয়ার পর সরাসরি সরকারি ফান্ডে চলে গেছে।
বর্তমান নরওয়ে সরকার অনেক ধনী হওয়ায় তাদের পক্ষে তাদের প্রত্যেকটা জনগণের জন্য সব রকমের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা সম্বভ এবং এ কারণেই সন্তানদের ভবিষতের জন্য এখনকার বাবা মায়েদেরকে বিশ্বের অন্নান্য দেশের জনগণদের মতন তেমন একটা চিন্তা করতে হয়না। নরওয়েতে বাংলাদেশের মতো ছেলে মেয়েদের জন্য অনেক কিছু রেখে যাওয়ার ইচ্ছে বা তাগিদ তাই নরওয়েজিয়ানদের মাঝে নাই।
এ যুগের নরওয়েজিয়ানরা ব্যাংকে অব্যবহৃত টাকা রেখে যাওয়াতো দূরের কথা অনেকেই চেষ্টা করে মারা যাওয়ার আগে নিজের জমানো সব টাকা পয়সা এবং নিজের ঘর-বাড়ি ব্যাঙ্কগুলোর কাছে বন্ধক রেখে মারা যাওয়ার আগে যতটুকু পারে নিজের জীবনকে উপভোগ করে যেতে। অনেকেই আবার মারা যাওয়ার আগে নিজের সব সম্পত্তি নরওয়েজিয়ান সরকারকে লিখে দিয়ে যায় অথবা মরার আগে সব টাকা তুলে আফ্রিকা কিংবা এশিয়ার গরিব দেশগুলোর বিভিন্ন মানবকল্যাণ মূলক সংস্থাকে দিয়ে যায়।
কয়েকদিন আগে নিজের পেনশন ফান্ডে ঢুকে দেখলাম বিগত দশ বছরে যে কাজ করেছি সে হিসাব ধরে বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৮০ লক্ষ জমা হয়ে আছে, নিজের বয়স ৬৭ হওয়ার আগে পর্যন্ত কাজ করে গেলে নিজের পেনশন ফান্ডে এ টাকার পরিমান কয়েক কোটি টাকা হয়ে যাবে কিন্তু পেনশনে যাওয়ার আগে এই টাকাগুলোর এক টাকাও আপনি আমি কেউই উঠাতে পারবোনা এবং হটাৎ করে মরে গেলে নিজের ব্যাঙ্ক একাউন্টে জমানো ব্যক্তিগত সব টাকা পয়সার সাথে সাথে নিজের পেনশন ফান্ডে জমানো সব টাকাও নরওয়েজিয়ান সরকারের ফান্ডে চলে যাবে । আমাদের আসে পাশে অনেক দেশে অনেক প্রবাসীই আছেন যাদের অনেকেই অনেক পরিশ্রম করেন, অনেককে দেখি নিজের ব্যাঙ্ক একাউন্টে হাজার হাজার টাকা নিয়ে ঘুরলেও নিজের জন্য এক কাপ কফিও কোথাও কোনো রেস্টুরেন্টে বসে পান করেননা, নিজের জন্য ভালো একটা জামা জুতাও কিনেননা আবার নিজের গরিব আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্দবদের বিপদে আপদে এক টাকা অনুদানও করেন না ।
এতো কষ্ট করে দিনরাত এক করে পরিশ্রম করে নিজের জমানো টাকায় নিজেকেই যদি একটু স্বস্তি, একটু ভালোবাসা দিতে না পারলেন তবে এ টাকাগুলো জমানোর মানেই বা কি ??
তবে নরওয়েতে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের বেশির ভাগই নিজের প্রতি যত্নবান এবং প্রত্যেক গ্রীষ্মে নরওয়েজিয়ান বাংলাদেশিরা নিজেদের পরিবার পরিজন নিয়ে খুব ভালোভাবে নিজেদের জীবনকে উপভোগ করেন। কেইবা অযথা নিজের কষ্টার্জিত টাকা নরওয়েজিয়ান সরকারি ফান্ডে ফেলে রেখে মরে যেতে চায় বলুন ??