মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীতে সময়ের চেয়ে বড় বেরসিক বোধ হয় আর কিছুই নেই। এই বেরসিক সময় যখন রক্ত চক্ষু শাসনে তার বল্লম রথে করে এসএসসি পরীক্ষার ক্ষণ নিয়ে স্কুল গেট পার হয়ে প্রায় হোস্টেলের দোর গোড়ায় এসে হাজির, সংঘাত সংকুল এমনই একটা সময়ে আমরা করে ফেললাম বড় রকমের এক অপকর্ম। সেলিম শিকদার, আমি সহ আর চারজন মিলে হোস্টেল সুপারকে না বলেই রাতের অন্ধকারে পানগুছি নদীর মুক্ত হাওয়ায় নৌকাবিহার পিকনিকে গেলাম। কিছু কিছু খবর আছে যা তৈরী হওয়ার আগেই যেন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের নদী ভোজনের রোমাঞ্চকর এই গল্পটিরও সেই অবস্থা। হোস্টেলের অন্য ছেলেরা তো বটেই আমরা নদী পর্যন্ত যাবার পূর্বেই যেন বাতাস বাসার ছেলেদের কাছেও খবরটি পৌঁছে দিলো। আর বাতাস তো চতুর্দিকেই বয়। সুতরাং হোস্টেল সুপার ঐ রাতে হোস্টেলে না থাকলেও তার কানে পৌঁছাতে ও কোন দেরী হয়নি। সফল নদীভোজনের বিষদ বর্ণনা সম্ভব হলে অন্য একদিন কোথাও দেয়া যাবে। তবে বরাবরই আমরা যে হোস্টেল সুপার জাফর স্যারের শোণ দৃষ্টিতে তিনি এমন একখান সুযোগ ছাড়বেন কেন? আমাদের কোন দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের সুযোগ না দিয়েই অভিযোগের বলটা তিনি হেড স্যারের কাছে পাস দিয়ে দিলেন। পাপের মাত্রাটাকে লঘু করার জন্যে সারারাত জেগে থাকার পরেও স্কুল টেষ্ট পরবর্তী যে কোচিং ক্লাস হতো তা ঠিক মতোই করেছিলাম। কিন্তু হেড স্যারের কঠিন মনের বরফ তাতে এক ফোঁটাও গলেনি। বিকেল তিনটের সময়ই দেখি স্কুল পাড়ায় সেলিম শিকদার এর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু (!) স্কুলের দফতরি এবং নাইট গার্ড জয়নাল ভাই ফরমান নিয়ে হাজির। ছয় জনের নামে ফরমানের সারমর্ম হলো, এখনই হেড স্যারের রুমে গিয়ে দেখা করতে হবে অথবা হোস্টেল ছেড়ে দিতে হবে। কাম সারছে। চিপা কাকে বলে! অনেকদিন পরে “এনাকোন্ডা” ( Anaconda ) মুভিতে এমন একটি শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য দেখেছিলাম। উপরের দিকে উঠলে সাক্ষাৎ এনাকোন্ডা, ছেড়ে দিয়ে নীচে পড়ে গেলে গভীর খাদ সেখানেও এই ভয়ঙ্কর সাপের রাজত্ব। এই সব বিষয়ে সেলিম শিকদারের পূর্ব অভিজ্ঞতা যথেষ্ট। জয়নাল ভাইকে স্যারের রুম থেকে বেড় হতে দেখেই সে সোজা টয়লেটের পথ ধরলো। সে টয়লেটের ভিতরে স্বেচ্ছা নির্বাসনে আর অনতিদূরে জয়নাল ভাই নির্দিষ্ট বিরতিতে ওর নাম ধরে ডেকে যাচ্ছে। এদিকে আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ়। পরীক্ষার মাত্র মাস দেড়েক বাকী। এখন হোস্টেল ত্যাগ? ঈশ্বর তুমি কোথায় থাকো?? এর পরবর্তী দৃশ্যের বর্ণনায় যাওয়ার লোভটা সামলানো একটু কঠিন ই হচ্ছে। তবে কোন কথা না দিয়েই বলছি পাঠকের তা পাওনা থাকলো।
নদীভোজনের চূড়ান্ত অভিজ্ঞতার খাতায় যা ই জমা পড়ুক আমার জন্যে এটা এক রকম শাপেবর ই হয়েছে বলতে হবে। কারন এর পরেই মস্তিষ্ক গহ্বরে ঢুকলো মহান পরীক্ষার পুলসিরাত পার হতে হবে। সেলিম শিকদার ও দেখলাম বেশ সিরিয়াস। প্রস্তুতির প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সে ১০ টাকা দিয়ে কোথা থেকে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড প্যান্ট কিনে আনলো। ( আমাদের স্কুল পোশাক কোডে পাজামা বা প্যান্ট পড়তে হতো। বেশীর ভাগই আমরা পাজামা পড়তাম ) । কারন জিজ্ঞেস করলে শুধু বললো পরে দেখতে পাবি, দরকার আছে অবস্থা খুব প্যাথেটিক। এই প্যাথেটিক শব্দটিও তার একটি ট্রেড মার্ক শব্দ । কারনে অকারনেই সে এটি ব্যবহার করতো। ক্লাস টিসার শৈলেন স্যার মাসের প্রথম দিকে যখন টোকেন বেতনের টাকা নিতেন তখন ও তার ঐ একই ডায়লগ ‘ স্যার অবস্থা খুব প্যাথেটিক পরে দিবো’। দুদিনের মাথায়ই হঠাৎ তার প্যান্ট সভ্য হয়ে ওঠার কারন জানা গেলো। বাজারে দর্জির কাছে গিয়ে প্যান্টের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সাইজ এবং স্টাইলের পকেট লাগিয়ে ১০ টাকার প্যান্টেকে সে যেন পুনর্জীবন দিলো! উদ্দেশ্য? খুবই মহৎ। বিভিন্ন পকেটে বিভিন্ন মাপের নকল অর্থাৎ চোতা পুড়ে রাখা। তা ভালো। কিন্তু এই মহৎ কাজে সফলতা অর্জনের জন্যে সে আমাকেও কিছু দায়িত্ব অর্পণ করলো। দায়িত্বটি হলো শিক্ষকের ভূমিকায় পরীক্ষার হয়ে গার্ড দেয়া। সে পরীক্ষার হলে নকল করছে আর আমি পাহারা দিচ্ছি তাকে ধরার জন্যে। না না হাসির কিছু নয়। ব্যাপারটা সিরিয়াস। মহড়ায় একটা সত্যিকার আহব আনতে আমরা অন্য দুই রুমমেটকেও পরীক্ষার্থীর ভূমিকায় অবতীর্ণ করলাম। এমন একখান দায়িত্ব পেয়ে একজন সফল গার্ড হওয়ার জন্যে আমারও উৎসাহ উদ্দীপনার কমতি ছিলো না। বেশ কয়েক রাত ধরেই চললো আমাদের মহড়া। নকল পারদর্শীতায় সেলিম শিকদারের শনৈ শনৈ উন্নতি দেখে কয়েকদিনের মধ্যেই আমি ওকে এসএসসি পাশের সার্টিফিকেট দিয়ে দিলাম! সে আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে বললো বুঝিস কিন্তু ধরা খেলে অবস্থা প্যাথেটিক? কন্ঠে আত্মবিশ্বাস ঝরিয়ে বললাম আরে না.. এমন পারফরম্যান্স থাকলে তোকে কেউ ধরতে পারবে না।
ঐ যে বললাম বেরসিক সময় মানুষের মনের তোয়াক্কা কখনোই করে না। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো। প্রথম দুটো পরীক্ষা ভালোই কাটলো। বজ্রপাতটা হলো তৃতীয় পরীক্ষায়। ইংরেজি প্রথম পত্রে সেলিম শিকদার কুপোকাত! ইনিংস টা জমে উঠতে না উঠতেই হাতেনাতে ধরা। এক্সপেল্ড ( Expelled )!! এবার কি করা? এর অনেকখানি দায় যে আমারও! থমথমে রুমের পরিবেশ। সময়মতো শান্তনার কোন শব্দ আমার মাথায় তখনো আসতো না এখনো আসে না। নৈঃশব্দের বরফ ভাঙার জন্যে অনেকক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করলাম কিভাবে ধরা পড়লি? টাটকা ম্যাচ বক্স, কাঠিতে বারুদের পরিমান বেশী থাকলে যা হয়। নিমেষেই বিস্ফোরণ ! আর তার পুরো তাপটাই আমার মুখের উপর। সালা তুই এতোদিন ধরে কি গার্ড দিলি যে আধা ঘন্টা যেতে না যেতেই..। বুঝলাম কাউন্টার আঘাত ছাড়া উপায় নেই। আমার দোষ কি? আজকে তোর পারফরম্যান্স হয়তো খারাপ ছিলো? স্ট্রাইকার কি প্রতিদিন গোল করে? ঝাঁজটা দেখি ক্রমশ সে আমার থেকে গার্ডের দিকে সরিয়ে নিলো। বললো সালা একটা গান্ডু। পরীক্ষার আধা ঘন্টাও হয়নি, বললাম স্যার আর করবো না খাতাটা দিন। সালা দিলোই না!? স্বস্তি। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিকে হয়ে আসলে বললাম চল আবুবকরের হোটেলে যাই। সেলিম শিকদারের মনটা মনে হলো একটু যেনো জেগে উঠলো। অথবা আমার মনের ভুল। বললো এখন যাবি? বললাম এখনই তো। চল.. ওঠ। তখনকার মোড়েলগঞ্জে বিকেলের নাস্তায় এই আবুবকরের হোটেলের মোঙলাই পরাটা আর সকালের নাস্তায় দত্ত মশাইয়ের দই চিঁড়া। আহ্.. জীবনে এ দুটো থাকলে আর কি চাই? মাইকেলের কপোতাক্ষ নদের মতোই যেন বলতে হয় ‘কত খাবার চাখিয়াছি এ জীবন ভরে, কিন্তু সেই স্বাদের পরাটা এবং দইয়ের মতো অন্য কিছুতে কি আর এ প্রাণ মজে’? পরীক্ষা শেষে অবশ্যই সবাইকে হোস্টেল ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে। এরপরে শুধু আর একদিন গিয়েছিলাম পরীক্ষার ফলাফল জানতে। সেলিম শিকদারের সাথে দেখ না হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো। নাহ্.. আর কখনোই তার সাথে আমার দেখা হয়নি! শুনেছিলাম পরবর্তী বছর সে এসএসসি এর গন্ডী পেরিয়েছে। হয়তো মহড়ায় এবার সে আমার চেয়ে ভালো গার্ড খুঁজে পেয়েছিলো। কিংবা সময়ের প্রয়োজনে নিজেকেই খানিকটা বদলে নিয়েছিলো। এইতো জীবন।
সারেং বউ চলচিত্রের ‘ওরে নীল দড়িয়া’ গানটি আমার খুবই প্রিয়। এই পানগুছি নদীর বুকে জোয়ার ভাটার প্রবাহের মতোই আমাদের জীবনে ওঠে সুখ-দুঃখের আলোড়ন। এখন যা বর্তমান, নিমেষ পড়েই তা হারিয়ে যায় কালের গহীন আবর্তে। সরে যেতে থাকে দূর থেকে দূরে। প্রয়োজনের টান, বেঁচে থাকার অমোঘ তৃষ্ণায় জীবন ছুটে চলে সময়ের নিরবধি স্রোতে। ঘাট থেকে ঘাটে, নাট্য মঞ্চের এক দৃশ্যপট শেষে তৈরী হয় আরেক দৃশ্যপট। আমরা শুধু অভিনয় করে যাই। কখনও ইচ্ছায়, কখনো অনিচ্ছায়। সামনে অবধারিত শেষ দৃশ্যের প্রতীক্ষা। এই তো খেলা। সীমার ভিতরে অসীমের পথে হাঁটা। যে হাঁটায় বর্তমান আর ভবিষ্যৎ ই মূলতঃ তাড়িত করে আমাদের। অতীত সেখানে মৃত। আসলেই কি?
জৈব জাগতিক প্রয়োজন ফেলে অবচেতন মনের কুঠুরিতে হারিয়ে যেতে সক্ষম হইনি এখনও। কিন্তু ঘুমে, আধোঘুমে, কিংবা ঐ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে যখন সে মনের চৌকাঠ পর্যন্ত পৌঁছাই, কিছু অতীত যে জীবন্ত হয়ে উঠে। এই পানগুছি নদী, সেলিম শিকদার, এ সি লাহা স্কুল, বাড়ির দক্ষিণে শিরিশের দীর্ঘ শাখায় চৈত্রের দুপুরে একাকী ঘুঘুর বিষন্ন ডাক, এরা সবাই ই যে কোন এক সময়ের নাট্য মঞ্চের এক একটি চরিত্র। সুযোগ পেলেই এরা যে সব ভেসে উঠে ধুলি ধূসর মনের পাতায়। স্মৃতির তারে এরা সবাই ই যে এক একটি নোট, এক একটি সুর। কখনো আনন্দের, কখনো বেদনার, আবার কখনো বা ঐ দূর নক্ষত্রের মিটি মিটি রহস্যের মতোই তা ঘন নীল। জীবনের কাছে এ ও যে এক মূল্যবান অনুভূতি। এক মূল্যবান উপহার..!!