দীর্ঘদিন প্রায় বিচ্ছিন্ন থাকার পর এ বছরের শুরুতে আবার ফেসবুকে ফিরে আসি।  উদ্দেশ্য ছিল পুরোনো সহকর্মী, বন্ধু বান্ধব এবং আত্মীয় স্বজনদের সাথে নুতন করে সংযুগ স্থাপন এবং সময়মত নিজের উপস্তিতি জানান দেওয়া । বছরের প্রায় শেষ দিকে এসে ফিরে তাকালে দেখি এই অভিযাত্রা মন্দ ছিল না । অনেকের সঙ্গে নুতন করে যোগাযোগ স্থাপন ছাড়াও নিজের পুরোনো অভ্যাস লেখালেখিতে আবার নুতন করে মনোযোগ দেই । ফেসবুকের কল্যানে এখন আবার প্রতিনিয়তই প্লাবিত হই হাজার ধরণের তত্ত্ব এবং তথ্যে । একবছর ফেসবুকে সক্রিয় থাকা সময়ের হিসেবে হয়তো বেশি কিছু নয়, কিন্তু আমার নিজের উপলব্দি এবং পর্যবেক্ষণের বিবেচনায় যথেষ্টই বলতে হবে । এই ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণই আজকের লেখার বিষয়বস্তু । কাউকে কঠাক্ষ বা হেয় করা আমার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু তারপরও লেখার বিষয়বস্তু বা আমার একান্তই ব্যক্তিগত বিশ্লেষণে কেউ মনঃক্ষুন্ন হলে আমি সবিনয়ে ক্ষমাপ্রার্থী ।

 মাঝে মাঝে অবাক হয়ে দেখি কত বিচিত্র রকমের বিষয় নিয়ে মানুষ ফেসবুকের পাতায় হাজির হয় । লক্ষ্য করি বিশ্বাস-অবিশ্বাসে, চিন্তা-চেতনায়, প্রকাশ ভঙ্গিতে মানুষে মানুষে পার্থক্য কত ব্যাপক । অনেককে দেখি সব সময় মানুষকে ইসলামী জ্ঞান দেওয়ার কাজটি বিপুল আগ্রহের সাথে করে যাচ্ছেন । ভালো কাজ নিঃসন্দেহে, যদি এই জ্ঞান বা তথ্যের ভিত্তি নির্ভরযোগ্য এবং সঠিক হয়.কারণ ভিত্তিহীন তথ্য ঈমানকে মজবুত না করে বরং অনেক সংশয়ের জন্ম দেয় । ইসলামের নামে    সহিংসতা এবং অনেক অনাচারও সৃষ্টি হয় এই মনগড়া, ভুল ব্যাখ্যার    কারণে । দুঃখজনক হলেও সত্য যে ফেসবুকে এই জাতীয় চেষ্টার কমতি নেই । সম্প্রতি  স্থানীয় এক অনুষ্ঠানে আমি ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে যুগোপোযুগী গবেষণা করা টরোন্টোর একজন ইসলামী শিক্ষাবিদকে প্রশ্ন করেছিলাম যে প্রযুক্তির বিপুল উৎকর্ষের এই যুগে কিভাবে আমরা একটি বিষয়ে ইন্টারনেটে  সঠিক ইসলামী ব্যাখ্যা পেতে পারি । উনার জবাব ছিল ইন্টারনেটে খোজার আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী বিশিষ্ট কোনো আলেমের সাথে কথা বলে তারপর গবেষণার কাজে নামা । কিন্তু তা না করে গুগল হুজুরের বদৌলতে আমরা সবাই এখন মৌলানা । যেকোনো বিষয় নিয়ে আমরা প্রত্যেকেই নিজস্ব ইসলামি ব্যাখ্যা ফেসবুকে হাজির করি এবং তারপর তা প্রতিষ্টার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি । ফেসবুকে ইসলাম বিষয়ক প্রচারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু নিজে একটি বিষয় সঠিক এবং বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে না জেনে আরো একশো জনকে জানানোর মধ্যে কি বিশাল অবদান সূচিত হয়, আমার তা জানা নেই । সমস্যা আসলে অন্য জায়গায়, আমরা নিজেরা অনুশীলনের মাহাত্ম্যকে ভুলে প্রচারের মধ্যেই  শান্তি ও  স্বস্তি খুঁজে বেড়াই। সম্ভবত আমরা ভুলে যাই পবিত্র সেই হাদিস “মান আরাফা নাফসাহু, ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু ”- “যে নিজেকে চিনেছে সে আল্লাহকে চিনতে পেরেছে”. আপাতত ইসলামী বিষয়ে অন্য মানুষকে উদ্ধারের চিন্তা বাদ দিয়ে না হয় নিজেরা নিজেদেরকেই উদ্ধারের কাজটি একটু জোরেসুরে করি । হয়তো এতেই স্রষ্টার নৈকট্য এবং সৃষ্টির সেবা দুটোই অর্জিত হবে । প্রার্থনা করি আল্লাহ্পাক  আমাদেরকে আত্মশুদ্ধির সুযুগ এবং প্রকৃত ইসলামকে জানার এবং অনুশীলন করার তৌফিক দিন ।

এবার সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী আর একটি গ্রূপের প্রসঙ্গে আসি । সংখ্যায় অল্প হলেও ফেসবুকে তাদের উপস্তিতি লক্ষ্য করার মতো । ব্যক্তিগতভাবে আমি মানুষের বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে মাথা ঘামাই না । কারণ যার যার বিশ্বাস ও কর্মের ফল সেই ভোগ করবে । কিন্তু বিস্মিত হই যখন দেখি কিছু মানুষ জীবনের অনিবার্য পরিণতিকে অস্বীকার করার চেষ্টা করে । তাদের কথাবার্তা এবং লেখা অনুসরণ করলে মনে হয় স্বয়ং আল্লাহ্পাক উনাদেরকে পার্মানেন্ট রেসিডেন্টশিপ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন নয়তো উনারা নিজেরাই এক একজন অমরত্মের বড়ি খেয়ে পৃথিবীতে এসেছেন । জরা, ব্যাধি মৃত্যু চিন্তা তাদেরকে স্পর্শ করতে পারে না । উনারা শুধু জীবনের জয়ধ্বনিই শুনেন, মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পান না । জীবন ও জগতের নশ্বরতা, সৃষ্টির আদি, অন্তের বা পারলৌকিক সঞ্চয়ের আলোচনায় শুধু যে তাদের ধ্যানভঙ্গ হয় তাই না, তাদের সহিষ্ণুতার বাঁধ ও তখন অনায়েসে ভেঙে যায় । বিষয় এখানেই শেষ না, উনারা আবার সবাইকে আহব্বান জানান তাদের মতাদর্শী হয়ে চলার জন্য । এ যেন অনেকটা ডুবন্ত নৌকার ডোবার গতি তরান্বিত করার জন্য নৌকা ভারী করার প্রয়াস. আরো কিছু মানুষকে দেখি যারা সারাক্ষন তৈরী হয়ে বসে থাকেন সর্ব বিষয়ে মতামত দেবার জন্য, তা চেরনোবিলে  পারমাণবিক বিকিরণই হউক অথবা চর কুকরী মুকরিতে আর্সেনিক মুক্ত নলকূপ বসানোই হউক । মনে হয় তাদের মতামত না পেলে জাতি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে । আমি নিজেও সম্ভবত এই দলভুক্ত । নিতান্তই আবর্জনা টাইপের কিছু পোস্টিং বাদ দিলেও আমার বিবেচনায় চতুর্থ আর একটি গ্রূপ রয়েছেন যারা সব কিছুকেই ফেসবুকে নিয়ে আসেন । যদিও এটি যার যার ব্যক্তিগত রুচি এবং ইচ্ছার প্রতিফলন, কিন্তু আমার মনে হয় নিজের একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়কে সবার সামনে উপস্থাপন করা বা জনসম্পত্তিতে পরিণত করার আগে দ্বিতীয়বার ভেবে দেখা উচিত।

একটু পিছন ফিরে যখন ফেসবুকে মানুষের এই বহুমাত্রিক প্রবণতার কারণ বিশ্লেষণের চেষ্টা করি, তখন পারিবারিক, সামাজিক, নৈতিক, মূল্যবোধগত  অবস্থা এবং অবস্থানগত অনেক বিষয় মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় । কিন্তু আমি সব কিছুকে ছাড়িয়ে এই প্রবণতার সাথে মনস্তাত্ত্বিক যোগসূত্র খুঁজে পাই । মানসিক স্বাস্থ্য এবং আসক্তি নিয়ে কাজ করার সুবাদে Impulse Control বা ঝোঁক নিয়ন্ত্রণ ধারণাটির সাথে মোটামুটি ভালোই পরিচিত । মনস্তত্ত্বের বাইবেল খ্যাত ডায়াগনস্টিক এন্ড স্ট্যাটিসটিকাল ম্যানুয়ালে (পঞ্চম সংস্করণ) একে Impulse Control Disorder নাম দিয়ে একটি বিশেষ রোগে শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে । খুব সহজ বাংলায় বিশ্লেষণ করলে এর অর্থ দাঁড়ায় প্রবৃত্তি/ঝোঁক বা তাড়নার বশবর্তী হয়ে অগ্র পশ্চাৎ, ভালো মন্দ বিবেচনা না করে কোনো কিছু দেখে, শুনে বা  পড়ে তাৎক্ষণিক কিছু করা বা প্রতিক্রিয়া দেখানো । সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে পশু পাখি, জীব জন্তুর সাথে মানুষের পার্থক্য বোধহয় এখানেই । জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা মানুষের আছে, জন্তু-জানোয়ারের নেই । এই প্রবৃত্তি বা তাড়না নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে শুধু ফেসবুকেই নয়, ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনেও অঘটন ঘটার সম্ভাবনাই বেশি ।

সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে

2 মন্তব্য

  1. ভাই আপনার অনেদিন পর FB- এ আসার কারণ হলো আপনি কায়দামতো এক একটি বিষয় নিয়ে হাজির হন। অনেক ঠিক কথা লিখেছেন তবে যারা FBকে ঐভাবে ব্যাবহার করে তাদের মাথায় আপনার কথাগুলি ঢুকবে কি না জানিনা কিন্তু আপনার সাথে আমিও আল্লাহর কাছে দোআ চাই তাদের যেন ওই বোধগম্য হয়। ICD-র কথা ঠিক বলেছেন, এই FB-র বদলে এখন দেখা যায় যে পৃথিবীতে কি পরিমানে narcissist আছে, আপনার মতো বলতে হয় এদের অনেকের মধ্যেই Narcissistic Personality Disorder-র symptom রয়েছে। যাহোক আপনার লেখাতে একটি বিষয় মাথায় আসলো, ভবিষ্যতে সময় পেলে সে বিষয় লেখার ইচ্ছা আছে। বিষয়টি হবে এ রকম ‘ গ্রিক mythology-র শিকারী Narcissus আর এ যুগের এক দল FB প্রেমী “. আমার খুব বেশি দূরে যেতে হবে না, আমার অনেক আত্মীয় এবং বনধু বান্ধবদের মধ্যে এদের দেখা মিলবে।

  2. মুকুল ভাই. যে ইম্পালস কন্ট্রোলের আলোকে আমার লেখা, আমি জানি এরকম বিষয়ে আপনি আরো চমৎকার ভাবে লিখতে পারবেন. ভবিষ্যতে সেই আশায় রইলাম. মন্তব্য ও অনুপ্রেরণার জন্য অনেক ধন্যবাদ.

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন