পৃথিবীতে প্রেম ভালোবাসা বা স্নেহ মমতা সব জীব জন্তুর মধ্যেই বিদ্যমান। আসলে এসবের জন্যই আমাদের সামাজিক বা পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। তবে স্থান কাল বা পরিবেশদভেদে স্নেহ ভালোবাসার প্রকৃতি ও  প্রকাশ  স্থানান্তরিত বা পরিবর্তিত  হয়। ভালো বাসা দিবসে আমার এ লেখা তাই ভালোবাসার গতি প্রকৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এ বিষয়ে গুণীজন এবং গবেষকগণ বিভিন্ন বিশ্লেষণ ও মতবাদ দিয়েছেন। আমি ঐ সব তাত্ত্বিক আলোচনায় যেতে চাই না,বরং আমার ও আমার মা বাবা স্ত্রী পুত্রের ক্ষেত্রে কিভাবে ভালোবাসা বা স্নেহের নিম্নগামিতা লক্ষ্য করেছি তার কিছু কথা বা স্মৃতির উল্লেখ করতে চাই।

আমাদের খাবারের পছন্দ থেকে আমি ভালোবাসার নিম্নগামীরা লক্ষ্য করেছি। আসুন, কিভাবে এটা লক্ষণীয় সেটা দেখা যাক। চিকেন বিরিয়ানী খেতে কে না পছন্দ করে ? অথবা মোরগ পোলাও ? মধ্যবিত্ত বাংগালীদের হাতে গোনা কিছু চালু খাবারের মধ্যে এই দু’টি আইটেম কম-বেশী সবাই পছন্দ করে । একটা  বিষয় নিশ্চয়ই সবাই খেয়াল করেছেন দেশে যখন হোটেল রেস্তোরায় খেতে গেছি তখন দেখেছি  ‘বিরিয়ানী’ বা ‘মোরগ পোলাও’-য়ের অর্ডার দেয়ার সময় প্রায়ই বলা হয়-‘ভাই, বুকের মাংস কম দিয়ে রান কয়েকটা বেশি দিয়েন’।

 যাইহোক,একটু গোড়ার থেকেই শুরু করি। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি মুরগির থেকে গরুর মাংস তুলনামূলক ভাবে সস্তা ছিল। মানুষ দাওয়াত খেতে যেয়ে বলতো-‘আমার গরু খেতে মানা আছে বা গরুর মাংসে এলার্জী আছে…আমাকে মুরগীর রোস্ট আরেকটা দিন।’ কিছুদিন পর খাবার মেন্যুতে ধুমকেতুর মতো আবির্ভাব হলো ‘ফার্মের মুরগী’। এখন আবার মানুষ দাওয়াতে এসে গরু বা খাসীর রেজালার বাটি আগে খোজ করে! যাকগে যা বলছিলাম, বাসায় যেদিন মোরগ বা মুরগী রান্না হতো তখন আমার মা আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য সযত্নে দুটি রান রেখে দিতেন, নিজেরা ভুলেও কখনো খেতেন না।

একসময় বড় হলাম, বিয়ে করলাম, নিজের সংসার হলো। বিয়ের আগে থেকেই জানা ছিল আমার স্ত্রী কি কি খেতে পছন্দ করে। মুরগির মাংসের রান তার পছন্দের খাবার। বিয়ের পর যখনই বাসায় মুরগী রান্না হতো, তখন একটা ‘রান’ আমার স্ত্রী, আরেকটা ‘রান’ আমি। আমি যখন দেশে ছিলাম তখন কোথাও বাহিরে খেতে গেলে আগে তার  জন্য মুরগির ‘রান’ টা রেখে দিতাম। সাধারনতঃ বাইরে বিরিয়ানী খেতে গেলে, যদি দুইটা অর্ডার থাকে তাহলে দুইটাই ‘রান’ বা লেগ পিস দেয় না, একটা দেয়। আমি স্যাক্রিফাইস করা শুরু করলাম, আবিস্কার করলাম মুরগীর ‘সিনার পিস’-যেখানে পাজরের হাড়গুলো থাকে (কোথাও কোথাও এটাকে ‘হেলিকপ্টার’ বলে) চাবাতে একেবারে খারাপ লাগে না। ভালোবাসার আরেক নাম‘স্যাক্রিফাইস’। তাই আমিও স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার জন্য মুরগির রান খাওয়া‘স্যাক্রিফাইস’ করলাম।

চাকুরী জীবনের শুরুর দিকে আমরা যখন গোপালগঞ্জ বাগেরহাট বা খুলনার মতো মফস্বল শহরে স্বামী স্ত্রী বসবাস করতাম এসব ঘটনাবলী সে সময়ের। পরবর্তীতে রাজধানী শহর ঢাকায় বদলি হয়ে আসলাম। ঢাকায় সরকারি বাসায় আমাদের সাথে আমার ছোট ভাই,ছোট সম্মন্দী ,আমার ছোট বোন ও শালীরা প্রায় সব সময়ই থাকতো। এ সময়ের মধ্যে বাসায় মুরগির মাংস রান্না হলে স্বাভাবিক ভাবেই একটা রান তার ভাই.বা অন্য কোনো আত্মীয় এবং ওপর রানটি অনেক সময় আমার কপালে জুটতো।

এভাবে কালাতিক্রমে আমাদের ছেলে হলো।বাবা-মা দু’জনেরই ‘রান’–প্রীতি সে  উত্তরাধিকার সূত্রে নিয়ে এলো। তখন থেকে দু’টি রানের একটি আমার ছেলে অন্যটি তার মামা বা বাসায় কেহ না থাকলে তার মার্ ভাগ্যে জুটতো। আমি ততোদিনে মুরগীর ‘সিনার পিস’ বা ‘হেলিকপ্টার’ ও ‘গিলা-কলিজা’র মধ্যে নতুন স্বাদ পেয়ে গেছি। তবে শালীর বাসায় যখন বেড়াতে যেতাম সে সব সময় আমাকে মুরগির রান দিয়ে আপ্যায়ণ করতো। আমি তখন আপত্তি  তুলে বলতাম, তোমার বোনকে দাও।

এভাবেই ঢাকায় আমার চাকুরী জীবন অতিবাহিত হতে লাগলো। চাকুরী  জীবনের এক পর্যায়ে প্রায় দশ বছর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের পি আর ও হিসাবে কাজ করেছি। মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে দেশের বিভিন্ন জেলা উপাজেলা গ্রাম গঞ্জে সফর করেছি এবং প্রচুর ভালো-মন্দ খেয়েছি। ইতোমধ্যে আমার মুরগির ‘রান’ খাওয়ার আগ্রহ একেবারে কমে গেছে। তবে মাসের মধ্যে ৩/৪ বার গ্রামের বাড়িতে গেছি মা বাবার সাথে দেখা করতে। বাড়িতে গেলে মা তার পুরানো অভ্যাস মত  মুরগি রান্না করলে তার ‘রান’ আগে আমাকে দিতেন। অনেক সময় দুটো রানই আমাকে দিতেন।  আমি এতে সংকোচ বোধ করতাম আব্বা ছোট বোনদের সামনে। মা বলতেন,ঢাকা শহরে কি দিয়ে কি খায় তা তিনি জানেন,তাই বাড়ি আসলে একটু ভালো ও পছন্দের জিনিস খাবে না কেন। মার এসব কাজে বাবার মৌন সমর্থন সব সময় লক্ষ্য করেছি। আজ এ সব ভাবতে গেলে চোখে পানি আসছে। এগুলো কি আসলেই ‘রান’ নাকি আদি, অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ! আমি মাথা নীচু করে খাওয়ার দিকে মন দিতাম।

মেট্রিক পরীক্ষার সময় বাংলা নোট বই-‘উচ্চ নম্বরের সিড়ি’ তে পড়েছিলাম-‘ভালোবাসা নিম্নগামী হয়’। তখন কথাটার মানে ভালো মতো বুঝিনি, এখন বুঝেছি। মা বাবার ভালোবাসা ‘আমি’। আমার থেকে আমার থেকে আমার স্ত্রী-পুত্র হয়ে নিম্নে যাচ্ছে।  আমার ছেলের পর থেকে হয়তো তার ছেলে।  এভাবে ভালোবাসা উচ্চক্রম থেকে নিম্নক্রমের দিকে যাচ্ছে। উদাহরন হিসাবে মুরগীর ‘রান’ পছন্দের বিষয়টি একেবারে ফ্যালনা নয় কিন্তু ! মুরগির রান ছাড়া ইচ্ছা করলে মাছ বা কেউ অন্য খাবার নিয়েও ভেবে দেখতে পারেন। শুধু খাদ্য দ্রব্য কেন আরো অনেক পছন্দের জিনিস নিয়ে ভেবে দেখতে পারেন। তাহলে অবশ্যই প্রমান পাবেন যে স্নেহ-ভালোবাসা সব সময় নিম্নগামী হয়…………

মোঃ মনিরুজ্জামান

টরন্টো

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন