rice

পার্থ, অস্ট্রেলিয়া থেকে :

বইতে পড়েছিলাম- আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি। সেই সময়ে আমরা তেমন বাঙালিই ছিলাম। সেই মাছের দিনগুলোর কথা না হয় আরেকদিন বলবো। আজ ভাতের গল্প বলি। এই সময়ে দেশে সবার জন্য মাছ না থাকলেও ভাত কিন্তু আছে- তা মোটা হোক আর চিকনই হোক। ভাতের সঙ্গে মাছ থাকুক আর নাই থাকুক, আমাদের দেশীয় স্বাদের কিছু একটা না থাকলে সে ভাত গলা দিয়ে নামে না- তা আলুভর্তা হোক আর মুসুরির ডালই হোক।

আমরা চার-পাঁচ মাস বয়স থেকে ভাত খাওয়া শুরু করি, মৃত্যু পর্যন্ত ভাত খাই- এক বেলা, দুই বেলা বা তিন বেলা। ভাত ছাড়া একদিনও চলে না। ঢাকায় চাকরি জীবনের প্রথমে বিনা বেতনে, পরে অল্প বেতনে কাজ করতাম। মাঝে মাঝে পকেটে ভাত খাওয়ার টাকা থাকতো না, দুপুরে বনরুটি আর কলা খেতাম। তাতে পেট ভরুক আর নাই ভরুক, মনে হতো কিছুই খাইনি। বিকেল না গড়াতেই মাথা বন বন করতো। পকেটে টাকা নেই, পেটে ভাত নেই- সে এককথা। কিন্তু পকেটে ডলার থাকতেও বিদেশের চকচকে রাস্তাঘাটে আর শপিংমলে ক্ষুধা পেটে ঘুরে বেড়ানোর মতো বিড়ম্বনা আর নেই।

আমি থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এআইটি) কাজ করতাম। চার-পাঁচ বছরে থাই খাবার খাওয়া শিখে গিয়েছিলাম। শুনতে পেলাম আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাই এসেছেন এআইটিতে। তিনি দেশে সরকারি কর্তা, ছাত্রজীবনে আমাদের ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। এসেছিলেন সাতদিনের একটা ট্রেনিংয়ে। সেই সঙ্গে একটু চিকিৎসা করাবেন। তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম একদিন বিকাল বেলা, তিনি আসার চার দিন পর। আমাকে দেখে খুবই খুশি হলেন। তিনি সন্ধ্যায় যাবেন ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে। আমাকে অনুরোধ করলেন সঙ্গে যেতে।

ভাবলাম, তার সঙ্গে পুরনো দিনের গল্প করা যাবে। তিনি পুরনো দিনের গল্প করলেন না। গল্প করলেন ঢাকায় অন্য সবার এখনকার স্ট্যাটাস নিয়ে। কার কত কোটি টাকা হয়েছে, কার গুলশানে অ্যাপার্টমেন্ট হয়েছে, কে প্রতিবছর বিদেশে যায় ছুটি কাটাতে ইত্যাদি। আমার এসবে আগ্রহ নেই। আমি মনে করি বেঁচে থাকার জন্য টাকার প্রয়োজন আছে কিন্তু টাকার জন্য বেঁচে থাকা অর্থহীন। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য ভিপি ভাইকে আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, থাই খাবার ঠিক মতো খেতে পারছেন তো?’ তিনি বললেন, ‘আরে ভাই, চাইর দিন কিছু খাই নাই। সকালে দুই পিস পাউরুটি মাখন দিয়া খাওয়া যায়- গলা দিয়া নামতে চায় না, সারাদিন আর কিছু খাওয়ার নাই, সব গন্ধ লাগে, ক্যান্টিনের আশপাশে গেলে নাক বন্ধ কইরা থাকি’। আমি একটু আঁতকে ওঠার ভান করলাম, ‘বলেন কী? কিছুই খাইতে পারেন না?’

তার মুখ শুকনো, জিহ্বা দিয়ে বারবার ঠোঁট ভিজাচ্ছিলেন, আবার উপরের পাটির দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরছিলেন। বললেন, ‘খালি লিচু খাই, সকালে লিচু, দুপুরে লিচু, রাইতে লিচু। গত চাইর দিন লিচুর উপর। আগে জানলে চিড়া-গুড় নিয়া আসতাম।’ আমি বললাম, ‘চিন্তা নাই, আজকে ব্যাংককে আপনারে বাংলা হোটেলে ভাত খাওয়াব’। এআইটি থেকে ব্যাংকক বিয়াল্লিশ কিলোমিটার। আমাকে বললেন, ‘আমি জানি বাংলা হোটেল আছে ব্যাংককে কিন্তু যাওয়ার সাহস পাই নাই, থাই ভাষা বুঝি না, কোথায় গিয়া খুঁজবো, কোথায় যাইতে কোথায় যাব সে আরেক চিন্তা। তার চেয়ে না খাইয়া থাকা ভালো।’ এমন করুণ মুখে বললেন যে, আমার মনে পড়ে গেল আমার এক সপ্তাহ প্রায় না খেয়ে থাকার কথা।

ভারতকে খাবারের দৃষ্টিতে বিদেশ বলা চলে না। সেই হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ ছিল আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। ছয় দিন ছিলাম প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ডন ইনস্টিটিউট অফ বিজনেস সায়েন্সে। ছোট ক্যাম্পাসটাতে একটা ক্যান্টিন ছিল, সন্ধ্যা সাতটায় বন্ধ হয়ে যেত। আমার ভিপি ভাইয়ের মতো আমিও না খেয়েছিলাম। ফল আর চা-কফি খেতাম। চোখে ঝাপসা দেখতাম। প্যান্টের কোমর ঢিলে হয়ে গিয়েছিল। বেল্টের বকলেসের কাটা এক গাঁট কমে গিয়েছিল। ক্ষুধার্ত মানুষ পেটে পাথর বাঁধে শুনেছি, আমি পাথর না বেঁধে বেল্টের এক গাঁট কমিয়ে বেল্ট পরতাম। রাতে উপুড় হয়ে ঘুমাতাম। ক্ষুধায় ঘুম ভেঙে যেত। সেখানে দেশের মতো রাস্তাঘাটে দোকান নেই যে, বিস্কুট বা বনরুটি-কলা কিনে খাব। রিকশা বা সিএনজি নেই যে উঠে বলবো ভাই ভাতের হোটেলে নিয়ে চল। জোহানেসবার্গ শহরে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট থাকাটা স্বাভাবিক। সেখানে একা গিয়ে খাওয়ার মতো সাহস হলেও ট্যাক্সি ভাড়া যখন রান্ড (সেখানকার মুদ্রা) থেকে টাকায় হিসেব করেছিলাম, তখন ভেবেছিলাম তার চেয়ে ছয়দিন না খেয়ে থাকা ভালো, দু-এক দিনে একমাসের বেতন খেয়ে ফেলার মতো অবস্থা ছিল না। সেই সময় বিদেশি মুদ্রায় কিছু কিনলে মাথা ক্যালকুলেটরের মতো কাজ করতো, টাকার অংক হিসাব করে আঁতকে উঠতাম।

সেই কষ্টের স্মৃতি মনে করে ভিপি ভাইকে নিয়ে গেলাম ব্যাংককে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট আল-হোসেনে।

বসার পরে একটা ভারতীয় ছেলে এসে জিজ্ঞেস করল ভাত খাব না কি বিরিয়ানি। ভিপি ভাই সঙ্গে বললেন, ‘ভাত ভাত- বিরিয়ানি না।’ উনাকে নিয়ে উঠে গেলাম যেখানে কাঁচের ভেতরে তরকারি সাজানো আছে। বললাম, ‘কী খাবেন? গরু, মুরগি, মাছ, সবজি?’ তিনি মাথাটা কাঁচে ঢাকা লম্বা সেলফটার এপাশ ওপাশ করলেন দুবার দুই-তিন সেকেন্ডে। তারপর বললেন, ‘ডাটা শাক আর ডাল দিতে বল।’ আমি বললাম, ‘মাছ বা মাংস খান?’ না তিনি আর কিছু খাবেন না। টেবিলে এসে বসে টেবিলের ওপর কাঁটা চামচ, ছুরি দেখে বললেন, ‘আমি কিন্তু ভাই হাত দিয়া খাব।’ তিনি হাত দিয়ে খেলেন। আমার জীবনে কোনদিন এমন গোগ্রাসে কাউকে খেতে দেখিনি। আরিচা-নগরবাড়ি-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে বাস-ট্রাক ড্রাইভারদের সঙ্গে বসে ভাত খেয়েছি, ক্ষুধার্ত সেই ড্রাইভারদের দেখতাম থালা ভরা ভাত বিশাল হাত দিয়ে চার-পাঁচ খাবলায় খেয়ে ফেলত। ভিপি ভাইয়ের সেদিনের খাওয়া তাদেরও হার মানিয়েছিল। আমি ছয়দিন ভাতের কষ্ট করে আমার ভাতের প্রতি ভালোবাসা টের পেয়েছিলাম। কিন্তু ভিপি ভাইকে খেতে না দেখলে কোনদিন বুঝতাম না ভাত আমাদের সংস্কৃতি নয়, আমাদের জীবন। একথা আমাকে একজন বলেছিলেন যখন গুয়াতেমালা গিয়েছিলাম।

তিনি গুয়াতেমালায় আমার সহকর্মিনী ছিলেন। ভদ্রমহিলার নাম ইরমা রোডাস। তিনি তখন পঞ্চাশোর্ধ ছিলেন। আমি তিন সপ্তাহের জন্য অফিসের কাজে সেখানে গিয়েছিলাম। এ অল্প সময়েই তিনি আমার মন ছুঁয়েছিলেন, এত দ্রুত আমি খুব কম মানুষকে কাছের মানুষ হিসেবে পেয়েছি। তার দুই ছেলে, আমার বয়েসী কিংবা একটু ছোট। বড় ছেলে ম্যানুয়েলের সঙ্গে দুবার দেখা হয়েছিল, সে ঈর্ষা করার মতো সুদর্শন। ইরমার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘ফারুক, ও যখন চলে গেল আমাকে ছেড়ে, আমার বয়স তখন চল্লিশ। আমি ভেবেছিলাম আমি বোধহয় আর কোনদিন কাউকে ভালবাসতে পারব না। কিন্তু কি জানো, ওর মৃত্যুর পাঁচ বছর পর আমি আবার একজনকে ভালোবেসেছিলাম।’ তার গলা ভারী লাগলো। আমি স্প্যানিশে বললাম, ‘ল সিয়েনতো ইরমা’ (আই এম সরি/ আই ফিল ইট)। আমি কাজ চলার মতো একটু-আধটু স্প্যানিশ জানতাম।

তিনি স্কার্ফের কোণ দিয়ে চোখ মুছলেন। ভাতের প্রসঙ্গেই ইরমাকে এখানে টেনে আনা। ইরমা বুঝতে পারছিলেন আমার খাবার সমস্যা, কারণ তার সঙ্গে একাধিকবার লাঞ্চ এবং ডিনার করেছিলাম। আমি তেমন কিছুই খেতে পারতাম না। ইরমা যথেষ্ট মনঃক্ষুণœ হতেন। কাজ শেষে একদিন সন্ধ্যায় তিনি আমাকে এক শপিংমলে নিয়ে গেলেন গুয়াতেমালার এক খাবার খাওয়াতে। আমরা টেবিলে বসলাম। ইরমা ওয়েট্রেসকে বললেন, ‘পয়ো কম্পেরো পর ফাভর’। খাবার আসার পর বুঝলাম সেটা চিকেন ফ্রাই। এর বৈশিষ্ট্য হলো ঝাল আর গুয়াতেমালার মসলা। অলিভ অয়েল আর চিজ দিয়ে খেতে হবে। আমার সমস্যা হলো আমি দেশি মুরগি ছাড়া খাই না। তার মন রক্ষার্থে দু-তিন কামড় খেয়েছিলাম।

গুয়াতেমালা শহরে কোনো ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট ছিল না। আমি যে কটেজ ধরনের হোটেলে ছিলাম তার নাম ‘লা কাসা সান্তা ক্লারা’। হোটেলের পাশে একটা মেক্সিকান রেস্টুরেন্ট ছিল। রাতে একা খেতে যেতাম। ফিরতাম পেটে ক্ষুধা নিয়ে। এক শনিবারে ইরমা দুঘণ্টা ড্রাইভ করে আমাকে এন্টিগুয়া নিয়ে গেলেন। স্প্যানিশ উপনিবেশের সময়ে তৈরি করা ছোট্ট শহরটাতে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট ছিল, সেখানে আমাকে খাওয়ানোর জন্যই তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি খেলাম আর তিনি মন ভরে আমার খাওয়া দেখলেন আর বললেন, ‘আমার খুব ভালো লাগছে যে, তুমি আজ কিছু খেতে পারছ।’ ইরমা অফিসের সময়ের বাইরে এবং সপ্তাহান্তে তার গাড়িতে করে আমাকে ঘুরাতেনÑ গুয়াতেমালা, এন্টিগুয়া, জীবন্ত আগ্নেয়গিরি, শপিং, তার নিজের বাসা। যেদিন আমি চলে আসি, আমাকে একটা গিফটের প্যাকেট দিলেন। উপরে স্প্যানিশে কিছু লেখা। আমি বললাম মানে কী? তিনি বলেছিলেন, পরে বের করো ইন্টারনেট ঘেঁটে। আমি গুয়াতেমালা ছেড়ে আসার পর লেখাটা অনুবাদ করতে পেরেছিলাম। লেখাটা ছিলÑ যদি কোনদিন আবার আমেরিকা আসো তবে জানবে তোমার একটা বাড়ি আছে গুয়াতেমালাতে- ইরমা।’ গুয়াতেমালা মেক্সিকোর দক্ষিণে মধ্য আমেরিকার একটি দেশ।

এখনও এখানে সেখানে যাই অফিসের কাজে বা পরিবার নিয়ে ছুটি কাটাতে। এখন নানা দেশের খাবার খেতে পারি, খাওয়ার কষ্ট হয় না। কদিন পর বাসায় ফিরে আসি, স্ত্রীর রান্না করা ভাঁপ ওঠা গরম ভাত, দেশি তরকারি আর মুসুর ডালের সঙ্গে লেবু আর কাঁচামরিচ দিয়ে খেতে খেতে ভাবি, ভাতের জন্য হাহাকার আমার চিরকালই থাকবে। তাই যেন থাকে।

১ মন্তব্য

  1. ফারুক ভাই আপনার লেখা গুলি সবসমই সুন্দর।
    জীবনের অনেক কাছের কথা গুলি বারেবারে মনে করিয়ে দেয় আমাদের শিকড়ের কথা.. নিজের অজান্তেই কখন যেন তা ভুলতে বসেছি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন