traffic-jam

টরন্টো থেকে:-

বাংলাদেশ থেকে ঘুরে এলাম গত জানুয়ারী মাসে।  জমিজমা সংক্রান্ত জরুরি কাজের জন্য মাত্র তিন সপ্তাহের জন্য দেশে গিয়েছিলাম। কাতার এয়ারওয়েজের বিমানে আমেরিকা হয়ে যাওয়া আসাতেই পাঁচ দিন লাগে। যাওয়া আসার মধ্যে ঢাকায় সর্বমোট চার  দিন অবস্থান করার সুযোগ হয়েছিল। প্রায় সাড়ে  তিন বছর  পরে দেশে যেয়ে এবারে রাজধানী শহর ঢাকা সহ দেশের অন্যান্য সব ক্ষেত্রে যে সব পরিবর্তন বিবর্তন লক্ষ্য করেছি সে বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই।

ঢাকা বিমানবন্দরে নেমেই প্রথম বিড়ম্বনার শিকার হলাম। এয়ারপোর্ট এ ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হতে একঘন্টারও বেশি সময় দাড়িয়ে থাকতে হল। ইমিগ্রেশনে কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তাদের ঢিলেঢালা আচরণ , জরাজীর্ণ কাউন্টার, টেবিল চেয়ার ও ক্যামেরা দেখে মনে হল হায়রে দুর্ভাগা দেশ আমার। কবে এদের দায়িত্ববোধ জাগ্রত হবে! সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তারা কি এসব দেখেনা ? তারাতো প্রতিনিয়ত বিদেশ ভ্রমন করেন। তখন কি বিদেশের এসব বিষয় লক্ষ্য করেন না ? যাইহোক , ইমিগ্রেশন শেষ করে লাগেজ পেতে আরো প্রায় দু’ঘন্টা। কি কারণে যেন কাতার এয়ারওয়েজের বিমানের লাগেজ আসতে দেরী হবে বলে জানানো হল। চরম বিরক্তি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। বিমান থেকে অবতরণ করার পরে অবশেষে প্রায় তিন ঘন্টা পরে এয়ারপোর্ট এর বাহিরে এসে আমার ছোট ভায়রা কে অপেক্ষা করতে দেখলাম।

অনেক কসরত করে অজস্র মানুষের ভিড় ঠেলে শেষ পর্যন্ত তার গাড়িতে এসে উঠলাম। তখন বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা। সে বলল ,আজ রাস্তায় একটু জ্যাম আছে। কারণ আজ হচ্ছে বিশ্ব এস্তেমার আখেরী মোনাজাতের দিন। মানুষ মোনাজাত শেষে বাড়ি ফেরা শুরু করেছে। তার কথার সত্যতা টের পেলাম যখন গাড়ি এসে এয়ারপোর্ট রোডে উঠলো। চারিদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ! আর সেই সাথে অজস্র গাড়ি আর গাড়ি!! একি অবস্থা !!! আর রাস্তায় চলাচলের কোনো নিয়ম কানুনের বালাই নাই। যে যেদিক থেকে পারে সেদিক দিয়ে আগে যাবার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যেতে যেতে ৩/৪ টা ফ্লাইওভার চোখে পড়ল। কিন্তু তারও একই দশা। একেতো ৩৩/৩৪ ঘন্টার বিমান জার্নি ,তার ওপর রাস্তার এই চিত্র দেখে একেবারে হতাশ হলাম।

 অবশেষে এয়ারপোর্ট থেকে যাত্রার দু’ঘন্টা পরে তার বাসায় পৌছলাম। বিশ মিনিটের পথ দু’ঘন্টায় আসলাম। বাব বার মনে হচ্ছিল এ অবস্থায় কিভাবে ঢাকায় মানুষ চলাফেরা করে। গ্রামের বাড়ি যাবার আগে দু’দিন ঢাকায় ছিলাম। তবে এয়ারপোর্ট থেকে আসার সময়ের যান ও জন জটের কথা ভেবে ঢাকা শহরে বের হওয়ার আগ্রহ হারিয়ে গেছিল। তারপরও একদিন বিকালে শালী ও ভায়রা ভাইয়ের সাথে বের হলাম। উদ্দেশ্য কিছু টুকটাক কেনাকাটা ও কয়েকটা প্যান্ট বানাতে আমাদের এক পরিচিত টেলরের দোকানে যাওয়া। মাগরিবের নামাজ পরে আমরা বের হলাম। ওরা বলল, বিকালে নাকি রাস্তায় গাড়ি একটু কম থাকে। কিন্তু রাস্তায় এসে আমার মনে হল যেন মানুষ ও গাড়ির মিছিল চলেছে সমান তালে। সেইসাথে হরেকরকম আওয়াজ ও গাড়ির হর্ন। তারপরে সেই অসহনীয় ট্রাফিক জ্যাম। আমার শালীর গুলশানের বাসা হতে এলিফান্ট রোড হয়ে নিউমার্কেট পৌছাতে লাগলো দু’ঘন্টা। গাড়িতে বসে বসে রাস্তার দু’দিকে দেখছি। যেতে যেতে আমার একটি জিনিস চোখে পড়ল। সেটি হল মানুষের বাড়িঘর বা বিভিন্ন মার্কেটগুলোর ভগ্নদশা। আমি যে সরকারী কলোনিতে বসবাস করে এসেছি সেখানকার বিল্ডিংগুলির কোনটির রং নেই এবং নোংরা ও হতশ্রী চেহারা ধারণ করেছে। এছাড়া মার্কেট বা দোকানপাট গুলির অবস্থাও তথৈবচ। মনে হল ঢাকা শহরটা একটা পুরানো ও জরাজীর্ণ শহর।

মার্কেটে যেয়ে আমার কেনা কাটার আগ্রহ হারিয়ে গেল। জিনিস পত্রের দাম এত বেশি যা কানাডার সাথে তুলনা করে আমার কাছে অনেক বেশি মনে হল। তবে লক্ষ্য করলাম মানুষ কেনা কাটা করছে সমান তালে। তাদের কাছে টাকার অভাব আছে বলে মনে হল না। এক মহিলাকে দেখলাম এক লক্ষ টাকা দিয়ে শাড়ি কিনলো। আমার এক ভদ্রলোক দেখলাম একটা স্যুট পিছ কিনলো চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে। এসব কেনাকাটা দেখে আমার নিজেকে অত্যান্ত হতদরিদ্র মনে হল। কি ভাবে এরা এত টকা এক দিনের মার্কেটিং এভাবে ব্যয় করছে বা তাদের মাসিক আয় কি রকম ? আমরা যারা বিদেশে থাকি তাদের অনেক কষ্ট করে আয় করতে হয় এবং সেভাবে হিসাব করে ব্যয়ও করতে হয়। তাই এভাবে ব্যয় করতে দেখে হতচকিত হওয়া ছাড়া উপায় কি?

যাইহোক, মার্কেটের কেনা কাটা শেষ করে বাসায় আসতে রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজলো। যাতায়াতের চার ঘন্টা বাদে মাত্র এক ঘন্টা আমরা কেনাকাটার জন্য সময় পেয়েছি। তাই রাতে ঘুমানোর আগে চিন্তা করছিলাম ঢাকার মানুষের জীবনযাত্রা কত কঠিন এখন। যারা চাকুরী করে তারা প্রতিদিন অফিস যাতায়াতের জন্য ৪/৫ ঘন্টা ও অফিস এ ৮ ঘন্টা অর্থাৎ প্রতিদিন ১২/১৩ ঘন্টার হিসাব নিয়ে বাড়ি থেকে বাহির হয়। তারপর হেটে বা বাসে বা সিএনজি’তে করে যাওয়া আসাতে যে ভোগান্তি তার আর কোনো শেষ নাই। তারপরে আবার সব জিনিসপত্রের যে দাম বা টাকার যে অবমুল্লায়ন তা আরও অসহনীয়। নোংরা রাস্তা ঘাট ,বাড়িঘর ও সীমিত নাগরিক সুযোগ সুবিধা, সর্বত্র অবাবস্থাপনা ও অজশ্র মানুষের ভিড়ে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এখানে অচলাবস্থায় পৌছেছে। এজন্যই বোধহয় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে ঢাকা শহর কে বিশ্বের সবচাইতে অযোগ্য নগরী হিসাবে চিন্নিত করা হয়েছে।

তবে দেশ বিদেশের এসব জরিপ বা অবমুল্লায়ন করা সত্বেও এখানকার জীবনযাত্রা থেমে নাই। দেশের মানুষ যথারীতি বাজারঘাট কেনাকাটা করছে, দৈনন্দিন অন্যান্য কাজকর্মও করে যাচ্ছে। হয়ত অনেকটা নিরুপায় হয়েই করছে ,কারণ বিকল্প কিছুই তো নাই। অব্যশ  দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। এরমধ্যে বিশেষ করে যাতায়াত ক্ষেত্রের কাজ আমার চোখে পড়েছে। তাছাড়া মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আমার মনে হয় এ সব কিছুই অর্থহীন হয়ে পড়বে যদি দেশের জনসংখা নিয়ন্ত্রণ করা না যায়। যেহারে এখন জনসংখা বাড়ছে তা যদি অব্যহত থাকে তাহলে কোনো ক্ষেত্রে কোনো পরিকল্পনাই সফল হবেনা। জানিনা দেশের রাজনৈতিক নেতাগণ এ বিষয়ে কি ভাবছেন।

 

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন