আমার কাজ, সংসার, সামাজিকতা আর কন্যাদের দেখাশুনা, লেখাপড়ার খোজ নেয়া, সব মিলিয়ে কোন সময় নেই । আর সবার স্বামীরা ব্রক ঊনিভার্সিটির ফুল টাইম স্টুডেন্ট , বাসায় আসে কিন্তু ব্যাচেলর ভাব ধরে থাকে । সারাক্ষন ওনাদের এসাইন্মেন্ট আর পড়াশুনার গল্প । মনে হয় ওনারা ও খুব আনন্দেই আছেন । এই দেশে পড়াশুনা করার মহা ফ্যাসাদ হলো কোনভাবেই নকল করে কিছু লেখা যায় না ,বই হাতে থাকলেও উত্তর খুজে পাওয়া যাবে না । আবার এসাইনমেন্ট ও ঝামেলা অন্যের টা দেখে করলেও যদি ওয়েব সাইটে খুজে পায়, নির্ঘাত ফেল আর সাস্পেন্ড হবার সম্ভাবনা আছে । ( রেফারেন্স দিতে হয়) । আমরা আশা করছি দুই বছরের কোর্স আর এক বছর গেলেই কে ঠেকায় তাদের চাকুরী ! এর মধ্যে ব্রক ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশী স্টুডেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের প্রোগ্রাম । আমরা খুব অপরিহার্য এই প্রগ্রামে , আশিকুজ্জামান টুলু ভাই আসল শিল্পী , আমাদের সুযোগ দিচ্ছে প্রতিভা দেখানোর । আবার কি বোর্ডে তাকেই সাহায্য করতে হচ্ছে । অনুষ্ঠানের মুল আকর্ষন আর্কের টুলু ভাই আর চন্দন চৌধুরী । সফল একটা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন সবার সহযোগিতায় । এর মধ্যে আগের ব্যাচের অনেকেই পাশ করে গেছেন কিন্তু কারোর ই চাকুরীর কোন খবর নাই । দেশে কে কি ছিল সে গল্পটা অনেকেই আর করে না এখন । অনেকে আবার আমেরিকাতে চলে যাচ্ছে ভাগ্যের অন্বেষনে । মন খারাপ হয়ে যায় কিন্তু সব কিছুকে পজিটিভ্লি নিয়েই আবার সামনে তাকাই । ভালোই আছি সবাই মিলে সবাই রাজা , সবাই ছাত্র , সবাই বেকার ।
প্রতি মাসে কেউ না কেউ টরোন্টো যেত বাজার করতে , যেই যেত ৮/১০ ফ্যামিলির বাজারের লিস্ট তার হাতে ধরিয়ে দেয়া হতো । কোন হালাল মাংসের দোকানের খোজ পাইনি অনেক দিন । একটা মাত্র লেবানীজ দোকান ছিল কিন্তু দাম হাকাত ইচ্ছামত । আবার কলিং কার্ড আর বাংলা হিন্দি ক্যাসেট আনতাম প্রতিটা ১ ডলার । দাম তুলে ফেলতাম, ভাজা ভাজা করে সবাই দেখত পালাক্রমে । আবার বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা হলে মন কেমন করত দেখার জন্য । কিন্তু এক্সপেন্সিভ ছিল ,তখন পিকনিকের মত হয়ে যেত কারো বাসায় অয়োজন করা হতো । সবাই এক ই ড্রইং রুমে আড্ডা। সবাই মিলে চাদা তুলে খেলা দেখতাম । মনে আছে প্রতিটা খেলার জন্য ৩০/৩৫ ডলার চার্জ করত সার্ভিস প্রভাইডার । যাদের লেখাপড়া শেষ হয়ে গেছে বা হবার পথে তাদের ন তুন চিন্তা যোগ হয়েছে সাথে এখন কি হবে !!
আমি কাজ করি আর চিন্তা করি এভাবে দাঁড়িয়ে আট ঘন্টা কাজ কত দিন সম্ভব । দিন শেষে আবার ভুলে যাই আবার দৃঢ় ভাবে মন কে বোঝাই আমাদের যে যুদ্ধ সেটা সফল হবে যদি নিজের সন্তান দের সঠিক পথে রাখতে পারি । সোমা বড় মেয়ে হাইস্কুলে যাবার পরে ,কোন হেল্প করতে পারি না , বুঝি ই না । টিউটর পাওয়া যায় কিনা তাও জানি না ! আফটার স্কুলে সাব্জেক্ট টিচার বা সিনিয়র ছাত্র/ছাত্রীর কাছে সাহায্য নিতে পারে ঘণ্টা খানেক কিন্তু বাসায় আসবে কিভাবে স্কুল বাস ছাড়া ! এখানে কোন টিচার প্রাইভেট পড়াতে পারে না , চাকুরী চলে যাবে কেস হয়ে যাবে তার নামে । কোন ছাত্র খারাপ করলে কিভাবে সে প্রগ্রেস করবে সেটার দায়িত্ব অনেকটা তার , আবার বোর্ডের কাছে জবাব দিতে হয় স্কুল কে ।
এরই মধ্যে সোমা স্কুলের স্টুডেন্ট কাউন্সিলে ইলেকশনে দাড়ালো , মজার ব্যাপার হলো স্কুলে কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিষদ্ধ। এমন কি কোন রাজনৈতিক আলোচনা করা যাবে না । যার যার ব্যক্তিগত ইমেজ ভ্লান্টারি ওয়ার্ক আর লিডারশীপ স্কিল থাকলে সে দাড়াতে পারে । গোপন ভোটে নির্বাচিত হয় এরা । আর এদের আসল কাজ স্কুলের ফান্ড রেইজিং, বিভিন্ন ক্লাব ( ডিবেট , বিজনেজ রোবোটিক ক্লাব , জব ফেয়ার সব আয়োজন করা ) কোন এসেম্বলী বা গ্রাজুয়েশন, স্টার হান্ট সব আয়োজন করা টিচারদের সাথে । সবার বসা আর আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে নিজেরা স্টেজের পাশে ফ্লোরে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকে । সামনে বসা নিয়ে মাস্তানী নেই , গার্বেজ পরিস্কার থেকে শুরু করে প্রতিটা কাজ নিজেরা করে স্কুলের উনয়নের জন্য । ১০০% সততা নিয়ে টাকা কালেক্ট করে সেগুলো স্কুলের ফান্ডে জমা দেয় । এসব মেয়েকে করতে দেখেছি আর শোকরিয়া আদায় করেছি সৃষ্টি কর্তার কাছে , সততা নিয়ে বেচে থাকার জন্য এমন সুন্দর একটি দেশে ওদের বড় হবার সুযোগ করে দিয়েছে ।
আমি কাজের জায়গায় সুযোগ খুজি যদি কোন পরিচিত বন্ধুদের ঢুকাতে পারি । লোক নিলে সবাইকে খবর দেই। আবার বাংগালী কাস্টমার পেলে এক্সট্রা কেয়ার করি মানে কথা বলি এগিয়ে । আমি প্রায় ই দেখতাম একজন লোক দুটো বাচ্চা নিয়ে শপিং করতে আসেন । একটা বাচ্চা বছর তিনেক আরেক টা খুব ছোট । মাঝে মাঝেই দেখি ক্যশ রেজিস্ট্রারের সামনে যে বেঞ্চ থাকে সেখানে বসে বাচ্চা দুটিকে খাওয়ান । আমি ধরেই নিয়েছি ওদের মা হয়ত রাতে কাজ করেন , আর দেখলে সাউথ ইণ্ডিয়ান মনে হয় । একদিন আমার ক্যাশ রেজিস্ট্রার দিয়ে যাবার সময় জিজ্ঞেস করলাম কোন দেশ থেকে এসেছেন ? আর বাচ্চাদের মা কে কখনো দেখি না কেন? বললেন উনি একজন বাংলাদেশী । আর বাচ্চা দুটির মা নেই । ছোট বাচ্চাটা প্রসবের সময় এখানেই মারা গেছেন । মনটা কেমন বিষন্ন হয়ে গেল । তারপর থেকে অনেক বার ওনার সাথে দেখা হয়েছে কথা হয়েছে , পেশায় ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার , সব ত্যাগ করেছেন এই সন্তান দুটিকে মানুষ করার জন্য । জিজ্ঞেস করেছিলাম উনি আবার বিয়ে করছেন না কেন ? স্ত্রীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা !! বলেছেন তা না , আমি ভয় পাই আমার এই বাচ্চা দুটিকে যদি সে মেনে না নেয় তখন কি হবে !! তার অনুভূতি আর ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই , জীবনে এত ত্যাগী আমাদের সেই সবার প্রিয় ফজলু ভাই অনেক কষ্টে বাচ্চাদের একা বড় করেছেন জানিনা তার সন্তানেরা কত টুকু মূল্য দিবে তার !
এই প্রবাসে আরো একটা বিষয়ে সবাই খুব আতঙ্কে থাকে ,দেশ থেকে কখন যেন বাবা মায়ের খারাপ খবর বা মৃত্যু সংবাদ আসে । এ রকম খবর মাঝে মাঝেই শুনি , দেখতে যাই , কিন্তু সেই হৃদয় বিদীর্ন কষ্ট সবার মাঝে , দেখা হয় নাই প্রিয়জনদের সাথে । ইচ্ছে করলেই যাওয়া যায় না , চাকুরী নাই , সংসার আবার প্লেনের ভাড়া !!আমি তখনও এতোটা বুঝিনি , নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হতো , আমার বাবা মাতো বেচে আছেন!!
চলবে ।