তিনদিন ট্রেনিং এর পর আমার কাজের স্ক্যাজুয়াল দিবে । কাজ হওয়াতে যেমন খুশী হয়েছি আবার চিন্তাও আছে । কারন আমার এভেলেবিলিটি দিয়েছি সকাল ৮ থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত । এর যে কোন সময়েই আমাকে কাজ দিতে পারে । আমি আগেও কাস্টমার সার্ভিসে কাজ করেছি কিন্তু এবার অনেক বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ বিধায় প্রচুর জিনিষ মাথায় রাখতে হচ্ছে । সব সময় হাসতে হবে, নেগেটিভ কথাকেও পজিটিভলি বলতে হবে ,কেউ চুরি করলেও কিছু বলা যাবে না সিকিউরিটিকে ফোন দিতে হবে , আর পার্সোনাল হাইজিন খুব ভালোভাবে মেইন্টেইন করে চলতে হবে । ক্যাশ হ্যান্ডিলিং তো আছেই । যাহোক তিন দিন পরে স্ক্যাজুয়াল দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল । বেশীর ভাগ কাজ ই দিয়েছে ৩ টা থেকে ১১ টা । মানে মেয়েদের সাথে সকালে স্কুলে যাবার সময় দেখা হবে আর রাতে ফিরে দেখব ওরা ঘুমে । আবার পরের সপ্তাহে একদিন সকালে এক দিন বিকেলে কাজ পরেছে , মেনে নেয়া ছাড়া উপায় কি!
আমার এই চাকুরীর কারনে বিল্ডিং এ মহিলাদের আড্ডাবাজী নাকি অনেক টা কমে গিয়েছে । আগে প্রতিদিন বিকেলে বাচ্চাদের নিয়ে নিয়ে স্কুলের মাঠে যেতাম , ওরা সাইকেল চালাতো , খেলাধুলা করত আর আমরা ফ্লাস্কে চা নিয়ে যেতাম, সাথে মুড়ি আর যার ঘরে যা আছে । তবুও যখন ই সময় পেয়েছি বাদ যায়নি আড্ডা। আমার ছুটির জন্য অপেক্ষা করত মনীষা বউদি , মুক্তা, সালমা ভাবী আরোও অনেকে । আমার রাতে কাজের দিন বড় মেয়েকে দায়িত্ব দিতাম ছোট দুবোনের হোক ওয়ার্ক চেক করার জন্য । এই গার্জিয়ানী পেয়ে সেও খুব খুশী , নিজের পড়ার আগে বোনদের তদারকী করে । আমি আসলেই ছোট দুজনের নালিশ , আর ছোট জনের নালিশ থাকত দুজনের বিরুদ্ধেই । তবুও অনেক নিশিন্তে থাকতাম তিন বোন একসাথে আছে । আবার আমার অনেক শুভাকাংক্ষী ছিল যারা নিজেদের দায়িত্ববোধ থেকে দেখে আসত ওরা কি করছে । মনীষা , মুক্তা, সালমা সবার কথাই কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি । আমার রাতে কাজ থেকে ফিরতে দেরী হতো । বেশীর ভাগ সময় আমার হাজব্যান্ড গিয়ে নিয়ে আসত , যেদিন পারত না সেদিন রণ দা আর বউদি রাস্তায় গিয়ে দাড়াত আমার বাস আসার অপেক্ষায় । এই ভালোবাসার ঋণ শোধ হবার নয় ।
এর মধ্যে স্কুল ইয়ার শেষ হয়ে গেল । বড় মেয়ে আশ্চর্য জনক ভাবে সে নায়েগ্রা রিজনে সব চেয়ে বেশী নাম্বার পেয়ে গ্রেড নাইনে উঠল । আমার মেয়ের টিন এজ সব কিছুতেই মেজাজ , কেন তাকে বাইরে যেতে দেই না । বন্ধুরা স্লিপ ওভার করে সেটা তে অনুমতি নাই । আরোও অনেক বিষয়ে খুব মতের বিরোধ হতো । খুব ভয় পেতাম, না পারি এখানকার অনেক কিছু গ্রহণ করতে আবার না পারা যায় দেশীয় কালচার পুরোপুরি ফলো করতে । সব কিছু মিলিয়ে চ্যালেঞ্জ মনে হতো । মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম আর যাই হোক বাসার কাছে যে হাইস্কুল আছে এখানে ভ র্তি করাব না । ক্যাথলিক স্কুলে দিব । সেখানে দিলে অনেক সুবিধা , নিত্যি নতুন ড্রেস নিয়ে ঝামেলা করতে পারবে না । স্কুল ড্রেস আছে , আবার ট্যাটু, চোখের উপরে দুল আর চুলের উদ্ভট কালার করতে পারবে না আর স্কুল বাস আছে । সমস্যা একটাই মাসে এক দিন চার্চে যেতে হবে কিন্তু কোন বাধ্যবাধকতা নেই চার্চের নিয়মাবলী পালন করার । নিজের ধর্মের প্রতি রেস্পেক্ট রাখতে হবে । আমার খুব পছন্দ হলো ওদের মানবিক দিক গুলো শিক্ষা দেবার পদ্ধতি । প্রতিদিন ক্লাস শুরুই হয় সারাবিশ্বের অবহেলিত মানুষের জীবন উন্নয়নের ধারনা দিয়ে । সোমা রাজী না কারন তার বন্ধুরা যাবে বাসার কাছের পাব্লিক স্কুলে, আমি তাকে বোঝালাম । তার বাবার সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করবে বললো, আমিও রাজী হলাম । কারন ওদের বাবার কোন ধারনাই নাই , ক্যাথলিক , পাব্লিক স্কুল সম্পর্কে !! সে একাই না বাচ্চাদের সব কিছুর দায়িত্ব ছিল বাশীর ভাগ মায়েদের । ২/৪ জন ছাড়া্। টিচার দের সাথে মিটিং থেকে শুরু করে সব কিছুই দেখতে হতো আমাকে । এখনকার জেনারেশন তো অনেক চেঞ্জ । তারা সব কিছুতেই থাকে বাচ্চাদের সাথে । আর আমাদের সাথে যারা দেশ থেকে হাজব্যান্ড হয়ে এসেছেন আরা ১০০% সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন মাশাল্লাহ ।
আমার মেজো মেয়ের ড্রিম জব ছিল গার্বেজ পিকার বা পুলিশ আর ছোট মেয়ের স্বপ্ন ই ছিল ফায়ার ফাইটার হবার ।এই জব গুলোতে আকৃষ্ট হবার কারন হলো , এপার্ট্মেন্ট বিল্ডিং এ ঘন ঘন ফায়ার এলার্ম বাজে আর কিছুক্ষনের মধ্যেই হেভী পোশাক পরে ফাইটাররা চলে আসে । এর মধ্যে অনেক মেয়েরা থাকে । আবার গার্বেজ নিতেও বড় বড় ট্রাক গূলো আসে , পুলিশ রা স্কুলে যেয়ে সেফটী বোঝায় , খুব ফ্রেন্ডলি থাকে । তাদের পোশাক দেখলেই ওদের পুলিশ হতে ইচ্ছে করে । আসলে যেটা বলতে চাচ্ছি এখানে কাজের কোন ছোট বড় নাই । কোন কাজকেই ছোট করে দেখা যাবে না । এই শিক্ষাটা ছোট বেলা থেকেই স্কুলে আর বাসায় দেয়া হয় । পরবর্তীতে যে যাই হোক না কেন এই কাজ গুলোর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই যায় । আমি মেয়েদের বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলেই সেই ড্রিম জবের কথাই বলতো । কেউ বলেনি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে , যদিও এখন এই পেশায় আমাদের ছেলে মেয়েরা আছে ।
আমার জন্ম যেমন তৃতীয় বিশ্বের ছোট্ট একটি দেশে আবার মধ্যবিত্ত পরিবারে । আমাদের দিন এখানে কিভাবে চ লছে সেই বাস্তব সত্য টা দেশে কখনো ও জানানো হয় না আর সে কারনে পরম আত্মীয়দের চাহিদা কিন্তু থেমে থাকে না । তারা ধরেই নেয় ওখানে টাকা আছে শুধু ইচ্ছে করেই কম পাঠায় ! আমি বিস্মিত হই না । এ ধারনা হয়ত আমারো হতো যদি না এতটা বাস্তবতার মুখোমুখী হতাম ।
আমি ২০ বছর আগে যে কথা শুনেছি কানাডার জব মার্কেট সম্পর্কে এখনো তাই শুনি । মাঝে রিসেসন এর কথা খুব শোনা যেত । এখন এই কথা টা শোনা যায় না ।আমি যদিও এসব কথায় কান না দিয়ে নিজের মত কাজ করে গিয়েছি । তবে এটা সত্যি এখানে একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার , বিচারপতি যেই আসুক না কেন ইয়ার পোর্টে নামার পর সবাই এক কাতারে । শত শত ডাক্তার এখানে ট্যাক্সি চালায় আবার অনেক ডাক্তার নিজের পেশায় কাজ না পেয়ে নিজেই মানসিক রোগীতে পরিনত হয়েছে । আমাদের বিল্ডিং এ থেকেছেন আমাদের এখন কার অর্থ মন্ত্রীর ভাতিজা যিনি নাকি আসামের কৃষি মন্ত্রীর মেয়েকে বিয়ে করেছেন ।সে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে রাতদিন পরিশ্রম করেছেন । দেশে সিলেটে তাদের কোটি টাকার বিজনেজ আর সুপার মার্কেট রয়েছে । আমাদের সেই প্রিয় অমায়িক বাবুল ভাইকে আমরা অকালে হারিয়েছি । জীবনে সিগারেট ফুকেন নাই কিন্তু লাঙ্গ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন ।
এত কষ্টের পরেও মানুষ প্রতিদিন আসছে আবার ফিরেও যাচ্ছে না । সুখের সংজ্ঞা একেক জনের কাছে এক এক রকম । কেউ অর্থ বিত্তে সুখী আবার কেউ বা ভালোবাসায় একটু ভালো থাকার আশায় ।আমাদের থেকে যাওয়াটা নিজেদের আর আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভালো থাকার নিশ্চয়তায় । আর দেশের আত্মীয় পরিজন তো রয়েছেই ।
একবার এক রাজনৈতিক নেতার কাছে প্রশ্ন করেছিলাম আপনি কি এদেশে থেকে যাবেন ? আর এই সুযোগে চেলা চামুন্ডাদের নিয়ে আসেন কিছু করে খাক । সে অবশ্য আমার বন্ধুর হাজব্যান্ড , উত্তরে বলেছিল এদেশ আমাদের জন্য না , পরিস্থিতি ভালো হলে দেশে ফিরে যাব । আর ওদের টাকা দিয়েও এদেশে রাখা যাবে না , এই কষ্ট ওরা সহ্য করতে পারবে না !
( চলবে )