“মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে” শিরোনামে কয়েকটি পর্ব লিখেছিলাম। ভেবে দেখলাম শিরোনামটিতে সত্যের একটু ঘাটতি রয়েছে। আসলে ঘুমই যদি না আসে তাহলে ভাঙবেটা কি? আমার বর্তমান অবস্হাটা যে এমন-ই। বর্তমান বলছি কেন? কখন-ই বা ঘুমিয়েছি? যখন ঘুমোনোর সুযোগ ছিলো বা ঘুম আসতো তখনতো ঘুমোই নি। আর এখন ঘুমোতে চাচ্ছি কিন্তু ঘুম আসে না। জীবনটাই হয়তো এমন। পুরোটাই এক অসময়ের বেলা। যা হোক এইসব বিবেচনায় ভাবলাম শিরোনামের নামটা পাল্টে “পেছনের সারি” দেই। আমাদের নেতা নেত্রীরা যদি কারণে অকারণে অহরহই এতো দল পাল্টাতে পারেন তাহলে আমার লেখার এই শিরোনাম পাল্টানোতে নিশ্চয়ই দোষের কিছু নেই!
বলে নেয়া ভালো, আমার কলেজ বন্ধু শহিদুলের কন্ঠের সাথে তাল মিলিয়েই এমন একটি নাম। এক সময়ে শহীদুল, আমি, আমরা কয়েকজন ক্লাসে পেছনের সারির ছিট গুলোর জন্যে রীতিমতো যুদ্ধে অবতীর্ণ হতাম। কারণ? সুবিধে বহুবিধ, অসুবিধা মাত্র একটা বা দু’টা। এই দু’একটা অসুবিধার মধ্যে একটা হলো অনেক সময় ব্লাকবোর্ডের লেখাগুলো ভালোভাবে দেখতে না পাওয়া। তা ব্লাকবোর্ডের লেখা পড়ে কে কবে কি হয়েছে? খুবই ধৃষ্টতাপূর্ণ প্রশ্ন। না না অনেকেই অনেক কিছু হয়েছে। তবে তার বেশ একটি সংখ্যাই যে আবার প্রলেপে মার্জিত অমানুষ হয়েছে তাও সত্য। তবে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ নেই এখানে। পেছনের সারির আমরাও যে জীবনে এমন কিছু করে ফেলেছি তাতো নয়। তবে অনেক সময়ই সময়ের সদ্ব্যবহার করেছি। যেমন পেছন ছিটের অনেকগুলো সুবিধের একটি হলো খুনটুসি দুষ্টুমি করা। তো একদিনের কথাই বলি, আপাদমস্তক বেরসিক ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক রহিম স্যার ক্লাস নিচ্ছেন। আলফ্রেড টেনিসন ( Alfred Tennyson ) এর ইউলিসিস ( Ulysses ) কবিতাটি। দীর্ঘ কবিতা। পড়ছেন আর ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড শুধু প্রতিটি লাইনের বঙ্গানুবাদ করে যাচ্ছেন! পেছনের বেঞ্চে অনেক বেশী মনোযোগে আমাদের শয়তানি চলছে। স্যার ঐ দিন একটু বেশীই ক্ষেপে গেলেন। শহীদুলকে বললেন দাঁড়াও। আড়মোড়া ভাঙার মতো করে ধীর তাল লয়ে শহীদুল দাঁড়াতেই স্যার বললেন ‘তুমি সব সময় পেছনে বসো কেনো? কাল থেকে তুমি সামনের বেঞ্চে বসবে’। নির্বিকার কন্ঠে শহীদুল উত্তর দিলো ‘স্যার আমি খাঁটি বাঙালী বলে পেছনের বেঞ্চে বসি’। উত্তর শুনে মনে হলো স্যার সপ্ত আসমানের উপর থেকে ভূপাতিত হলেন! বললেন, পেছনে বসার সাথে বাঙালিত্বের কি সম্পর্ক? প্রশ্ন শুনে শহীদুল একটুখানি আশ্চর্যান্বিত হবার ভাব নিয়ে বললো, কেনো স্যার..? আপনি অলিম্পিক বা অন্য যে কোন প্রতিযোগিতায় দেখেন না, আমাদের প্রতিযোগীরা সব পেছনে পড়ে থাকে। মূল প্রতিযোগিতায় তো আসতেই পারেনা। হিটেই পেছনের সারি রিজার্ভ করে ফেলে! আমিও তো তাদের মতোই…। হো.. হো.. করা গোটা ক্লাসটাই আবার চুপ হয়ে গেলো স্যারের কন্ঠের বজ্রপাতে। ফাজলামো করার আর জায়গা পাওনা.. যাও.. বেড় হও আমার ক্লাস থেকে। শহীদুল একটু ইতস্তত করছে দেখে বললাম সুযোগটা ছাড়িস না, বেড় হয়ে যা। প্রশ্রাবের কথা বলে একটু পড়ে আমিও আসছি। ক্লাস ছেড়ে শহীদুল বেড়িয়ে গেলো নিঃশব্দে। বলাবাহুল্য, কবিতার শিরোনামে ইউলিসিসের চরিত্রটি গ্রীক কবি হোমারের (Homer) এর বিখ্যাত মহাকাব্য ওডিসি (Odyssey) এর প্রধান চরিত্র ওডিসিয়াস (Odysseus) কে ই টেনিসন তার কবিতায় রূপায়ন করেছেন। এই কবিতার একটি লাইন.. ‘আমি আমার জীবনের শেষ পানপাত্র পর্যন্ত পান করবো’ (I will drink life to the lees)। এখানে জীবনটাকে মদের গ্লাসের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এবং ইউলিসিস সেই গ্লাসের শেষ তলানিটুকুও পান করতে চান। প্রথম যেদিন ইউলিসিস পড়েছিলাম সেদিন থেকে একদিনের জন্যে ও এ লাইনটা আমি ভুলিনি।
আমার মতে এই কবিতাটি পড়াতে যাওয়ার আগে ইউলিসিস কে? সেটা ব্যাখ্যা করার জন্যেই কমপক্ষে একটা ভূমিকা ক্লাস নেয়া উচিত। এটিকে ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড বঙ্গানুবাদ করে গেলে কবিতার মূল রস আস্বাদনের কিছুই হয় না। এবং ঐ ক্লাসে তা হয়ও নি। শহীদুলের বহির্গমণের একটু পরে আমিও বেড় হয়ে আসি। ইউলিসিস কবিতার স্বাদ হয়তো এখনও ঐ বইয়ের পাতায়ই পড়ে রয়েছে!
লিখতে বসলে প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক যেকোন ভাবেই হোক না কেন একটি বিষয়ের সাথে আর একটি বিষয় জুড়ে দেয়া আমার কলমের একটা সমস্যা ই বলতে হয়। আজ তার কোন অভিপ্রায়ই ছিলো না। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাস বলেই কথা। যদিও একুশের চেতনা, গর্ব, ক্ষোভ, দুঃখকে উৎসর্গ করে একটি কবিতা (এ কোন্ স্বদেশ–এ কোন্ কলম) ইতঃপূর্বে পোস্ট করেছিলাম। তারপর ও এখানেও কিছু কথা বলার দায়বদ্ধতা অনুভব করছি।
দেশ, বিদেশ, পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে যে অবস্হায়ই থাকি না কেন, এই মাসটি আসলেই মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অন্যরকম বাতাস বইতে থাকে। একটা গর্ব, একটা সুখানুভূতির সঞ্চার হয়। বুকের পেশীতে প্রচ্ছন্ন একটা টান টান ভালোবাসার অনুভূতি হয়। জীবন যুদ্ধের ব্যস্ততাকে পাশে ফেলে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসাটা যেন আবারও নবায়িত হয়। মাকে মা বলে ডাকার স্বাধিকারের নবায়ন। তার মাটির গন্ধ আবারও নিঃশ্বাসের কাছে চলে আসে। এবং সেকারণেই আমাদের গর্বের এই একুশকে নিয়ে দেশে-বিদেশে যারা কাজ করে যাচ্ছেন তাদের প্রতি আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা নিবেদন করেই আমার পরের লেখাটুকুতে আসছি। চলবে….
মাঝে মাঝেই আমার মনে প্রশ্ন জাগে একুশের চেতনার বাস্তবায়ন আমরা আমাদের বিবেকের কোন্ পর্যায় পর্যন্ত প্রতিফলিত করতে চাই? প্রশ্নটি আমি বিশেষ করে যারা নিজেদেরকে জাগ্রত বিবেক বলে মনে করেন, দেশ প্রেমিক বলে মনে করেন বা দাবী করেন, সর্বোপরি বাংলা ভাষাকে যারা ভালোবাসেন তাদের সবার কাছে রাখতে চাই। এই যে, বইমেলা, প্রভাতফেরী, সংগীত–সাহিত্য, শহীদ স্মৃতিতে পুষ্পার্পণ, বাংলা ভাষা তথা পৃথিবীর তাবৎ মাতৃভাষার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা এগুলোতো আমরা সেই ১৯৫২ সাল থেকে করে আসছি এবং নিশ্চয়ই আবহমান কাল ধরে করে যাবো। প্রসংগত, ভাষা শহীদদের অবিস্মরণীয় সেই আত্মত্যাগ এবং তার ধারাবাহিকতায় এতোটা বছর ধরে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২১শে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিশাল অর্জন। আবারও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি এ নিয়ে যারা বিশেষ ভাবে কাজ করেছেন। তবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সাথে ২১শে ফেব্রুয়ারির সরাসরি একটা যোগসাজশ থাকলেও এই বিশেষ দিনটি আমাদের বাঙালী জাতীর অন্তরে একটি ভিন্ন আবেগের মাত্রায় স্হাপিত। এ দিনটি আমাদের জাতিসত্তাকে সমুন্নত রাখার আন্দোলনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ দিনটি আমাদের আত্ম পরিচয়ের এক অমূল্য স্মারক। তাই সবার কাছে আমার প্রশ্ন, আমাদের এই চেতনাকে কি শুধু এমন উদযাপনের মধ্যেই সীমিত রাখব না এর বাস্তবায়নকে আমরা আর এক ধাপ উপরে নিয়ে যাবার জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবো? এই যে একমাস বা একদিন, যেভাবে আমরা এটিকে স্মরণ এবং উদযাপন করে আসছি তাতে বিশ্বের দরবারে একে বাঁচিয়ে রাখা যাবে কিন্তু আরও উপরে তোলা সম্ভব হবে কিনা সে নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সে কাজটি করতে হলে আমাদের মেধা, কর্ম, নিষ্ঠা এবং সততা দিয়ে গোটা জাতিটাকেই উপরে তুলে নিয়ে আসতে হবে। আর এটা একদিন বা একমাসের আবেগ নয়। আমাদের ধমনী স্রোতে এটি নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বহন করে নিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা কতটুকু সফল? এর মূল দায়িত্ব প্রথমতঃ কাদের উপরে বর্তায়? প্রশ্ন দুটো মূলতঃ আমি বাংলাদেশীদের কাছেই রাখছি। ১৯৭১ থেকে ২০২০, একটা জাতিকে বিশ্বের দরবারে সমুন্নত মস্তকে তুলে ধরার পথে আমাদের সফলতা কতটুকুন? আজকের এই লেখাটাকে রাজনৈতিক বিতর্কের বাইরে রাখার চেষ্টা করছি। তারপরও কিছুটা গন্ধ থেকেই যেতে পারে।
একটা জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রাথমিক দায়িত্বটি মূলতঃ তার প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিগন এবং সুশীল সমাজের উপরে ই বর্তায়। সেই ১৯৭১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের মাটিতে যতগুলো প্রশাসন ক্ষমতায় এসেছে তাদের কর্মকান্ডে এখন একটা বিষয় পরিস্কার, এবং তা হলো, দেশ প্রেমের চেয়ে নিজেদের গদির খুঁটি মজবুত করাই হলো এদের মূখ্য উদ্দেশ্য। সুতারং স্বাভাবিক কারনেই তাদের কৃত কর্মের বেশীরভাগই থাকে ঋণাত্মক টেরিটোরির আঁধারে। এক্ষেত্রে আমাদের সুশীল সমাজ তথা বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কি? পৃথিবীতে এর চেয়ে গা বাঁচানো সুশীল সমাজ আর কোন দেশে আছে কিনা তা নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। প্রকৃতপক্ষে “সুশীল” শব্দটির সঠিক সংগায় ফেললে আমাদের দেশে এরা আছেন কিনা সেটাই প্রশ্ন। পাওয়া গেলেও তা আঙুলের করে গুনে বলা যাবে। এর পিছনেও হয়তো কারন আছে। দু’একজন যা ও সুস্হ, সৎ চিন্তা ও মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠেন, ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষ থেকে পৃষ্ঠপোষকতা তো দূরের কথা, তাদের স্রোতে যোগ না দিলে কিংবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের তোষামুদি না করলে তার যে আর কোন মূল্যই থাকে না তা ই নয়, অস্তিত্ব ই টিকিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়ে। বর্তমান সরকারের সময়ে এই বিষয়টি খুবই প্রকট ভাবে চোখে পড়ে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, শান্তি নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী (যদিও নোবেল পুরষ্কার এখন অনেকটাই একটি বিতর্কিত বিষয়), ডঃ মুহম্মদ ইউনুস এর কথা। এই পুরস্কারটি জিতে দেশের মুখকে যে তিনি বিশ্বের দরবারে উজ্জ্বল করেছেন এটা নিশ্চয়ই সবাই স্বীকার করবেন। অথচ বর্তমান সরকারের কাছ থেকে তার এই বিরল কৃতিত্ব অর্জনের স্বীকৃতি কি? বরং বলা যায় কোন না কোন কারনে তিনি এক প্রকার প্রতিহিংসার স্বীকার হয়ে নিজ দেশেই এখন কোনঠাসা! চমৎকার আমাদের সরকারের উদারতা, চমৎকার আমাদের সরকারের মানসিকতা!! একটার পর একটা এমন সরকার ব্যবস্হা পালাবদল করে সেই স্বাধীনতার পর থেকেই যে দেশের ঘাড়ের ওপর ভূতের মতন চড়ে যাচ্ছে তার জন্যে দায়ী কে? আমার আপনার মতো আমজনতা নিশ্চয়ই। দুঃখ জনক হলেও সত্যি, এমনই এক আমজনতা আর সরকার চক্রের মধ্যে পরেই জন্ম থেকে এতোগুলো বছর কেটে গেছে এবং যাচ্ছে দুখিনী বাংলাদেশের এমন জীবন পরিক্রমা। কে তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসবে? যাবতীয় দুর্গন্ধের আঁধার হলেন বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা। বাকী থাকেন দেশের সুশীল সমাজ তথা বুদ্ধিজীবীরা। কিন্তু পালাবদলের সাথে সাথে তারাও তো দেখি এ পক্ষ ও পক্ষ নিয়ে এই দুর্গন্ধময় রাজনীতিবিদদের ই তোষামুদি করে যান নির্বিকার ভাবে! আর এটা করে যাচ্ছেন তারা সজ্ঞানে, গভীর সত্যকে পাশ কাটিয়ে শুধু নিজের পকেটটাকে স্বাস্হ্যবান রাখার জন্যে! তাহলে জাতির উত্তরণ কোথায়? কাদের হাত ধরে দেশমাতা পাবে তার আরাধ্য পরিত্রাণ?
আবারও বলছি, আমার নিজস্ব বোধে একুশের চেতনা শুধু বাংলায় কথা বলা, গান-কবিতা লেখা, একদিন শহীদদের স্মৃতিসৌধে ফুল দেয়া নয়। নিজেদেরকে একটি সৎ, পরিশ্রমী শ্রদ্ধাশীল জাতি হিসেবে বিশ্বের উন্নত সোপানে নিয়ে যাওয়ার একান্ত নিষ্ঠা। আমাদের কৃষ্টি, আমাদের সংস্কৃতিকে সেই স্তরে তুলে ধরা। আমাদের বুদ্ধিজীবি সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে দলমত নির্বিশেষে দেশের সাধারণ জনগনকে সেই বোধে উদ্ভুদ্ধ করা। শুধু ক্ষমতাসীনদের জন্যে স্তুতি বাক্য নয়। সম মতাদর্শের সরকার হলেও যদি সে ভুল সিদ্ধান্ত নেয় তার প্রতিবাদ করা। যেটা আমদের দেশে আমরা কদাচিত ই দেখতে পাই।
বর্তমানে বাতাসে একটি গুঞ্জন উড়ছে এবং তা হলো, হালে বাংলাদেশের পাঠ্য বইগুলো থেকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে রবীন্দ্রনাথ সহ সব অমুসলিম লেখকদের লেখা সরিয়ে সেখানে মুসলিম লেখকদের লেখাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। UHC বাংলা নামে একটি ব্লগে এ নিয়ে একটি নিবন্ধ ও পড়লাম। এখন কথা হলো, সময়ের সাথে পাঠ্য বইয়ের সংকলন গুলোতে পরিবর্তন আসতেই পারে। কিন্তু এই পরিবর্তনের উদ্দেশ্য যদি বইকে আরও উন্নত অবয়ব দেয়ার লক্ষ্যে না হয়ে অন্য একটা হীন স্বার্থকে বাস্তবায়নের জন্যে হয় তাহলে তা নিয়ে বিজ্ঞ মহলের প্রতিবাদ করা উচিত। কারণ এমন একটা মানসিকতা চরিতার্থ হলে তা আমাদের সংস্কৃতির মূলধারার পথটিকে ধ্বংস করে দিবে বা বিকৃত করে ফেলবে। এ নিয়ে এখনও কোন বিজ্ঞজনের লেখা চোখে পড়েনি বা এর সত্যতাও পুরোপুরি যাচাই করা সম্ভব হয় নি। প্রসংগত কয়েকদিন পূর্বে একুশ নিয়ে বর্তমান সময়ের সুপরিচিত একজন লেখকের একটি নিবন্ধ পড়লাম। সেখানে তিনি একটু আক্ষেপের সাথে বলেছেন যে, একুশে ফেব্রুয়ারির পুষ্পার্পণ রাত ১২টা একমিনিটে শুরু হওয়ায় তার প্রাইম সময়ে তিনি যে সকাল বেলার প্রভাতফেরীতে সামিল হতেন, বর্তমানের প্রভাতফেরীতে সেই ভাব, গম্ভীরতা, আবেগ, অনুভূতি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ১২টা একমিনিটের পুষ্পার্পণের এই পদ্ধতির মাঝে তিনি একটি পাশ্চাত্য ধাঁচের গন্ধ ও খুঁজে পান। তার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, রাত ১২টা একমিনিটেই একুশের প্রথম প্রহরটা শুরু হয়। এর মধ্যে পাশ্চাতীয় করনের গন্ধ খুঁজতে যাওয়া মনে হয় ঠিক নয়। প্রতিটা প্রজন্ম ই নিজেদের সময়টাকে তাদের মত করে উপভোগ এবং অনুভব করে। বাস্তবতার কারনে অনেক বছরই হলো শহীদ মিনারের পথে সেই প্রভাতফেরীতে আমার যোগ দেয়া সম্ভব হয় না। আর হলেও সেই সময়ের অনুভূতি হয়তো আর এখন ফিরে পাওয়া যেতো না। এটা সত্যি। দেশে না থাকলেও আমার বিশ্বাস শহীদ মিনার, আজিমপুর গোরস্থানের পথে প্রভাতফেরী এখনও হয়। এবং এখনকার প্রজন্মেরা তাদের হৃদয়ের অনুভূতিতেই শ্রদ্ধাবনত হয়। সর্বোপরি, ১৯৫২, ১৯৭১ এর তুলনায় ঢাকা শহরের জনসংখ্যা এখন অনেক অনেকগুন বেশী। সেই হিসেবে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণের সময়টা দীর্ঘ পরিসরে হওয়ায় শুধু ভালোই হয় নি হয়তো প্রয়োজন ও ছিলো।
যতোটুকু লিখবো ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক দীর্ঘ হলো নিবন্ধ। জীবনের ছোট্ট পরিসরে দীর্ঘ আমার ভবঘুরেপনার মতো। আমার কলম আমার চেয়েও আর এককাঠি সরেশ। শুরু করে দিলে আমাকেই যেন টেনে নিয়ে যায়। তবে এই শুরু করাটাই কঠিন। এবং সেটাই এখন খুব জরুরী আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির জন্যে। পরিশেষে, এ লাইনটি আমার অনুধাবন হলেও কোটেশন এ উল্লেখ করতে চাই.. “শুধুমাত্র ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা বা তাকে বিশ্ব মঞ্চে নিয়ে আশার চেষ্টা করলে তা হয়তো কতকটা পথ এগোবে কিন্তু তা একটা জাতিকে টেনে তুলতে পারবে না। কিন্তু একটা জাতি যদি বিশ্ব মঞ্চে নিজেকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে তাহলে ভাষা তার সাথে এমনিতেই উঠে আসবে। মাতৃভাষার জন্যে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার এর আত্মত্যাগের চেতনার মধ্যে দিয়ে আমাদের সেই উপলব্ধিতেই পৌঁছান দরকার। এবং সেখান থেকেই শুরু করা দরকার এ জাতির নূতন বিনির্মাণ। ব্যর্থতায়.. দু’দিনে শুকিয়ে যাওয়া অর্ঘ্যের এই ফুলের সঠিক মূল্যায়ন আর কখনোই হবে না”!
ফরিদ তালুকদার / ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২০