ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড, নরওয়ে থেকে:-
লন্ডন হিথ্রো এয়ারপোর্ট থেকে নরওয়েতে প্রথম যেদিন আসি সেদিন অসলোর গারদেরময়েন এয়ারপোর্টে অনেক ভিড় ছিলো, সারা পৃথিবীর নানা জাতির লোকজনের ভিড় ইমিগ্রেশন ডেস্কগুলোর সামনে। প্রায় ৪৫ মিনিট পর আমরা ডেস্কের সামনে আসলাম, আমার বৌ নরওয়েজিয়ান বিধায় পাসপোর্ট দেখিয়েই ও ডেস্ক পার হয়ে ভিতরে চলে গেলো। যাবার সময় বললো যে আমি ভিতরে আছি , চলে আসো। ও চিন্তাই করতে পারেনি আমার ক্ষেত্রে হয়তোবা অনেক সময় লাগতে পারে। আমি সামনে আসলাম, পাসপোর্ট বাড়িয়ে দিলাম ইম্মিগ্রেশন অফিসারের দিকে, উনি দেখলেন আমি একেতো বাংলাদেশী, তারপর আসছি লন্ডন থেকে আবার স্টুডেন্টও । জিজ্ঞেস করলেন কোন ইউনিভার্সিটি বা কলেজে পড়ি , কলেজ ইউনিভার্সিটি থেকে নরওয়েতে যে আসতেছি তার জন্য ছুটির অনুমতি পত্র আছে কি না ? উনাকে কলেজের কাছ থেকে নিয়ে আসা অনুমতি পত্র দেখালাম , তারপর জিজ্ঞেস করলেন এখানে নরওয়েতে কেন এসেছি ? বৌয়ের কথা বললাম, বৌয়ের নাম জন্ম তারিখ দিলাম, তখন উনি সিউর হবার জন্য আমাকে আমার বৌয়ের নরওয়ের বাসার ঠিকানা জিজ্ঞেস করলেন। নরওয়েজিয়ান ভাষায় বৌয়ের বাসার ঠিকানা উচ্চারণ করা ওই সময় সত্যি কঠিন ছিল তাই আমি উনাকে যতবার বলছিলাম ততবার উনি বুঝতে পারছিলেন না। শেষমেশ বললাম একটা কাগজ দিন লিখে দিচ্ছি। এদিকে দেরি হচ্ছে দেখে আমার বৌ ভিতর থেকে বারে বারে কল দিচ্ছে, আমাদেরকে নেক্সট ফ্লাইট ধরতে হবে বৌয়ের শহর ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড যাওয়ার জন্য। ওকে যতই বলি ইম্মিগ্রেশন অফিসার আমাকে এখনো ছাড়েনি ও কোনো মতেই বুঝতে পারছিলোনা আমাকে এতো সময় আটকিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করবার কিই বা আছে। যাই হোক শেষ মেশ সন্তুষ্ট হয়ে ইম্মিগ্রেশন অফিসার বললেন (ওয়েলকাম টু নরওয়ে )। দেশে থাকতে কম বয়সে অনেক বদরাগী ছিলাম, সামান্য কোনোকিছু এদিক সেদিক হলেই খেপে যেতাম, কিন্তু ভিসা থাকা সত্ত্বেও ইম্মিগ্রেশন অফিসারের এতো প্রশ্ন আমাকে একটুও বিরক্ত করেনি, কেননা জীবনের যত রাগ গুস্সা ইংল্যান্ড আসবার পর সব ঝেড়ে জুড়ে ফেলে দিয়েছি, তাই অযথা এতক্ষন আটকে রাখার পরও ইম্মিগ্রেশন অফিসারকে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে থাঙ্কস বলে ভিতরে ঢুকে গেলাম। পরবর্তী ফ্লাইট ধরে যখন ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড এসে পৌছালাম তখন প্রায় সন্ধ্যা, সব কিছু কেমনজানি অন্ধকারাচ্ছন্ন। বৌ বললো ওর বান্ধবী রিটা নাকি এয়ারপোর্টে আমাদেরকে নিতে আসবে তাই ওর বান্ধবীর জন্য ডিউটি ফ্রি শপ থেকে একটা ফুলের তোড়া, এক বক্স মার্লবোরো সিগারেট আর এক বোতল রেড ওয়াইন কিনলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সোজা রিটার গাড়িতে গিয়ে উঠলাম, ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড এসে রিটাকে ওর জন্য আনা গিফট এবং ধন্যবাদ দিয়ে সোজা বেডরুমে ঘুমাতে গেলাম। সারাদিনের দখল জানে-প্রাণে আর সহ্য হচ্চিলোনা।
পরদিন সকালে যখন উঠলাম, মনে মনে এক কাপ চা আশা করেছিলাম,, বাঙালির মন, সকালে চা ছাড়া কি আর চলে বলেন ?? দেখি বৌ রেডি হচ্ছে,, জিজ্ঞেস করলাম কই যাও, ও বললো রেডি হয়ে নাও শহরে যেতে হবে, অনেক কিছু কিনা কাটার আছে এবং শহরেই সকালের ব্রেকফাস্ট করে নেবো।
অতি সকালে কেই বা বলেন শহরে নাস্তা করতে যায় ?? তারপরও কষ্ট করে উঠলাম, রেডি হয়ে শহরে আসলাম,, আইসা দেখি অল্লাহ আমি কোই আইলাম ?? এইটা কি শহর ??
ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড শহর নরওয়ের পঞ্চম বৃহত্তম শহর হলেও লন্ডনের তুলনায় নিতান্তই একটা গ্রাম বলা যায়। তবে ১১ বছর আগের ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড এখনকার তুলনায় অনেক ছোট ছিল, মানুষজনও কম ছিল। যাই হোক নরওয়েজিয়ানদের ট্রেডিশনাল একটা কফি শপে বসে ব্রেকফাস্ট করতে করতে বৌকে জিজ্ঞেস করলাম এর চেয়ে ভালো কোনো কফি শপ কি এই শহরে নেই ?? ও আমার কথায় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো কেন এ কথা জিজ্ঞেস করছি ?? খাবার কি ভালো হয়নি নাকি ?? আমি বললাম না না, সব ঠিক আছে কিন্তু কফি শপটা কেমনজানি পুরোনো পুরোনো লাগছে তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি ! ও বলল যে এই কফি হাউসটা ওদের শহরের সবচেয়ে পুরোনো কফি হাউস এবং এটা ওদের শহরের ঐতিহ্যের একটা অংশ এবং আজকে যেহেতু আমার প্রথমদিন তাই ও আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আমরা বাংলাদেশিরা যে জায়গায় জাঁকজমকওয়ালা জিনিসে আকৃষ্ট সেখানে ইউরোপীয়ানরা তাদের দেশীয় ঐতিহ্য ধরে রাখবার ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন। আমার ভুলটা বুঝতে পেরে কথার মারপেঁচে বৌকে অন্য দিকে নিয়ে গেলাম। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, তো সবাই কথা বলছে, বাচ্চারা বাবা মাকে নানা জিনিস আবদার করছে, দোকানে দোকানে অনেক প্ল্যাকার্ড ঝুলছে তবে আমি সব শুনলে দেখলেও কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। নরওয়েজিয়ান ভাষা না জানলে নরওয়ের প্রথম দিকের দিনগুলোকে অসহ্য নির্মম মনে হয়।
আজ এই ১১ বছরের দূরত্বে দাঁড়িয়ে জীবনের প্রাঙ্গনে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে, এখন ইমিগ্রেশন ডেস্কের সামনে এসে ক্রিস্টিয়ানস্যান্ডের একেবারে লোকাল টুনে ( হেই সান ) বলে যখন সম্মোধন করি, তখন ইমিগ্রেশন অফিসারেরা এক নিমিষে বুঝে যায় আমি এদেশে অনেক আগে থেকে বসবাস করছি তাই পাসপোর্ট তেমন একটা চেক করতে চায়না। এই ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড শহরের প্রত্যেকটি রাস্তা, প্রত্যেকটি ব্যবসা প্রতিষ্টান, প্রায় প্রত্যেক মানুষজন আমার জানাশুনা। এখন এই শহরটাকে আগের মতো অসহ্য নির্মম মনে হয়না। এই শহরটাকে নিজের শহর মনে হয়, এই শহরের কোনায় কোনায় নানা স্মৃতি মিশে আছে। দেশে ফেলে আসা প্রাণের সিলেট শহর আর বর্তমানের বাসস্থান ক্রিস্টিয়ানস্যান্ডের মাঝে অনেক মিল খুঁজে পাই। মিল খুঁজে পাই ভালোলাগা ভালোবাসায়।
ছবি; নভেম্বর ২০০৯,, অদ্রাইয়া পাহাড়, ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড।