আব্বার হাত ধরে কবে থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করি মনে নেই. মনে থাকার কথাও নয়। কিন্তু দিন বদলের আশা নিয়ে যখন বাংলাদেশ ছেড়ে কানাডায় পাড়ি জমাই, সেই দিনটির কথা মনে আছে। মনে আছে নতুন দিনের স্বপ্নে বিভোর সন্তানের সামনে নিরুপায় বাবা মার ব্যাকুল হৃদয় আর সজল চাহনি। একদিকে সন্তানের কাছে থাকার প্রচ্ছন্ন বাসনা আর অন্যদিকে তার সুখে সুখী হবার প্রাণান্ত চেষ্টা । এই অসম টানাপড়েনে সন্তানই সব সময় জয়ী হয়। আমার বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি ।
টরোন্টোতে এসে প্রথমদিকে কর্মজীবনের স্বপ্ন বলা যায় অনেকটাই থমকে দাঁড়ায় । অনেকের মতো পেশাগত সংগ্রামের পথ এতটা মসৃন ছিল না । লক্ষ্য স্থির ছিল যদিও অবস্হা এবং অবস্থান কোনোটাই অনুকূলে ছিলনা । কিন্তু হাল ছাড়িনি । বাবা মায়ের দোয়া এবং স্ত্রীর নিরন্তর সহযোগিতায় অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এখনকার অবস্থানে আসতে হয়েছে । সেজন্য নতুন অভিবাসী যারা কানাডায় এসে নিজের পছন্দের কাজ না পাওয়ার আক্ষেপ করেন, তাদের দুঃখ খুব সহজেই বুঝতে পারি । অনুভব করি নিজের অপছন্দের কাজ করে জীবনের ভার বয়ে বেড়ানোর মতো কষ্টকর আর কিছুই নেই । কিন্তু শুধু আক্ষেপের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে না রেখে লক্ষ্যে স্থির থেকে আত্মপ্রত্যয় নিয়ে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলে দুঃসহ এই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটবেই । আমাদের চারিপাশে এর অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে । কোনো না কোনো স্বপ্ন নিয়েই আমরা অভিবাসনের যাত্রা শুরু করি – তা নিজেকে নিয়েই হউক বা সন্তান, পরিবারের জন্যই হউক । এর বাস্তবায়নে সব বাধা বিপত্তি অগ্রাহ্য করে দৃঢ়তার সাথে, একনিষ্ট ভাবে না লেগে থাকতে পারলে এই দেশ স্বপ্ন ভঙ্গের দেশে পরিণত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয় ।
আশা এবং স্বপ্ন নিয়েই মানুষ বাঁচে. বলা যায় এই দুটো জিনিসই মানুষকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জোগায় । মানুষের কিছু মৌলিক স্বপ্ন বংশ পরম্পরায় একই রখম থেকে যায় । মানুষ বদলায় কিন্তু স্বপ্ন বদল হয়না । আজ থেকে অনেক বছর আগে আমার বাবা মার চোঁখে ছিল আমাদেরকে ভালো মানুষ, সুশিক্ষিত এবং প্রতিষ্টিত দেখার স্বপ্ন । সময়ের বিবর্তনে একই রকম প্রত্যাশা এখন আমিও করি । আমাদের ছেলে মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করি তাদের সমৃদ্ধ ভবিষ্যত, তাদের স্পর্শে আমিও অনুভব করি নুতন দিনের হাতছানি ।
শুধু নিজের জীবন বা অভিবাসী জীবন নিয়েই না, আমরা রঙিন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি নিজের মাতৃভূমিকেও নিয়ে । ডানফোর্থের বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টে বসে চায়ের কাপে বাংলাদেশের রাজনীতির তুফান উঠলেও এর পেছনে লুকিয়ে থাকে মাতৃভূমির প্রতি নীরব এক মমত্ববোধ । রাজনীতি নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও তা ছড়িয়ে পরে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ নিয়ে । সব কিছু ছাপিয়ে প্রবল হয়ে উঠে শিখড়ের টান । হৃদয়ের গহীন কোণে তখন অনুভব করি অদ্ভুত এক শূন্যতা । কল্পনার জাল বুনতে শুরু করি এমন এক শান্তিময়, নিরাপদ বাংলাদেশকে নিয়ে যেখানে খুন, গুম, সন্ত্রাস আর সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ভয়াল দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে বেড়াবে না কাউকে । রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ন বন্ধ হয়ে যেখানে প্রতিষ্টিত হবে আইনের শাসন, নিশ্চিত হবে সাধারণ মানুষের সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন যাপনের পরিবেশ, শান্তিতে-স্বস্তিতে কাটবে মানুষের জীবন । হয়তোবা সেই দিন বেশি দূরে নয়. হাজার হাজার মাইল দূরে বসে আমরা অপেক্ষায় থাকি নতুন সূর্যোদয়ের, দেখি দিন বদলের স্বপ্ন, প্রতীক্ষার প্রহর গুণি সেই দিনের আশায় ।
সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে