প্রবাসে অর্থাৎ টরেন্টোতে এ মুহর্তে সামার প্রায় জেঁকে বসেছে। প্রায়দিনই সকাল থেকে বিকাল অবধি চক চোকে সোনালী রোদ্দুর। গরমের পাশা পাশি বিকালে দিকে হালকা বাতাস, ঘুড়ে /বেড়ানোর জন্য চমৎকার পরিবেশ। এরই মধ্যে আবার কোরবানির ঈদ হচ্ছে রবিবার। অর্থাৎ উইকেন্ড। এতে প্রবাসী সবার মধ্যেই বেশ চাপা উত্তেজনা। গত কয়েকদিন ধরে প্রবাসী ভাইয়েরা যখন স্ত্রীদের বায়না রক্ষার্থে ঈদ মেলা ঈদ বাজার ঘুরে ঘুরে শাড়ি/সেলোয়ার-কামিজ, গয়নার পাশা পাশি বাচাদের জামাকাপড়, নিজেদের বাহারি পাজামা/পাঞ্জাবি ইত্যাদি কেনাকাটায় ব্যাস্ত, ততক্ষনে দবির উদ্দিন সাহেবের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরেছে। প্রবাসজীবনে লেপ্টে থাকা বেশ কিছু বন্ধু/বান্ধব আগে থেকেই বলে রেখেছে “দোস্ত এবার সবাই মিলে তোর বাসায় ঈদ সেলিব্রেট করবো । সকালবেলা নামাজ পরে সোজা তোর বাড়ি। তারপর সারাদিন হৈহুল্লোড়, ব্যাক-এয়ার্ডে বারবিকিউ , বিকালে কাছাকাছি পার্কে বেড়ানো , রাতে ডিনার সেরে নিজ নিজ বাড়ি ফেরা” । দবির উদ্দিন একেবারেই হতবাক। আইডিয়াটা আসলে তারই দেওয়া। কিভাবে কিভাবে যেন বুমেরাং হয়ে তার কাছেই ফিরে এসেছে। একেইবলে কপালের নাম গোপাল। দবির উদ্দিন কিছুটা আজান দিয়ে চলা ফেরা করা টাইপের মানুষ। প্রায় প্রতিবারেই পরিবার সহ এবারই/ওবাড়ি করে লাঞ্চ/ডিনার কমপ্লিট করে থাকেন ; এবারে একেবারে বেকায়দা। শুক্রুবার রাতে দবির উদ্দিন স্ত্রী সহ খাওয়া/দাবার আইটেমের কেনা-কাটার একটা লিস্ট করে ফেললো. ১. টিল ডা চাল-৯ ডলার (walmart ) ২, গরুর গোস্ত -সর্বোচ্চ ২০ ডলার – কাবুল ফার্ম , (শুধুমাত্র দুপুরের জন্য, সন্ধ্যা নাগাদ প্রতিবেশী আফসার সাহেবের কোরবানির খাসির মাংস চলে আসবে ) ৩. এক ব্যাগ আলু-৪.৯৯ ডলার (nofrills সেল ) ৪. এক ব্যাগ পিয়াজ ৫ ডলার .(foodabasic ), অদা/রসুন – ৫ ডলার ৫. দুই কেস ডিম্ ৮ ডলার ৬. টক দই ১ টি – ৩ ডলার ৭. চিংড়ি মাছ দুই প্যাকেট -৮ ডলার (Chinese দোকান) ৮. দুই বোতল কোক, দুই বোতল স্প্রাইট, এক বোতল পেপসি- ৫ ডলার ৯. মসুরের ডাল ৫ ডলার (বিকালের নাস্তার জন্য পিঁয়াজি বানানো হবে , ছোলা বুট, মুড়ি বাসায় আছে )। . এই যা বারবিকিউ -এর চিকেন বাদ পড়েছে! ৩০ ডলারের চিকেন লেগ। রান/ থান একসাথে (দুই পিস করতে হবে ) । সব যোগ করলে দাঁড়াচ্ছে ১০৩ ডলার। ডেজার্ট আইটেম নিয়ে স্ত্রী ঝর্ণার সাথে দবির উদ্দিনের কিছুটা কথা কাটাকাটি চললো। স্ত্রীর কথা হচ্ছে ঈদের দিন হাতে বানানো দই/মিষ্টির ঝামেলার মধ্যে কিছুতেই যাওয়া যাবেনা। জর্দা সেমাই, লাচ্ছা সেমাই যথেষ্ট। খুব বেশি হলে হাতে সময় থাকলে ফিরনি-পায়েস করা যেতে পারে।কিন্তু, দবির উদ্দিনের কথা হলো, বাড়িতে বানানো বড় বড় রসগোল্লা ছাড়া ঈদ কিছুতেই যোমবে না। যাহোক, ঈদের আগে বেশি মাথা গরম করা যাবেনা। আপাতত রসগোল্লার চিন্তা মাথা থেকে দবির উদ্দিনের ঝেড়েই ফেলতে হলো।
সমস্যা বেঁধেছে অন্য জায়গায়। শনিবারে ঈদের সব কেনাকাটা শেষ করে রাতে শোয়ার আগে দেশ থেকে আনা পাঞ্জাবি চেক করতে যেয়ে দেখে পেটের দিকে হলুদ রঙের ঝোলের দাগ। ওদিকে স্ত্রীর আরো বড় সমস্যা। গত উইকেন্ডে ডানফোর্থ এলাকা থেকে যে শাড়ি কিনেছিলো তার সাথে ম্যাচিং করে যে ব্লাউজ বানানো হয়েছিল সেটা কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।সম্ভবত হুমায়ন আহম্মেদের কোনো উপন্যাসে দবির উদ্দিন পড়েছিল ” সমস্যারা হচ্ছে বেশ কয়েক ভাই/বোন। এদের মধ্যে এতো মিল যে এরা সব সময় একসাথে চলাফেরা করে”। দবির উদ্দিন সাবের বেলায় তাই ঘটলো । রাতে প্রায় সাড়ে নয়টা নাগাদ বন্ধু চয়ন ফোন করে জানালো , ” দোস্ত তোকে বলতে ভুলে গেছি, গত পরশু আমার শ্বশুর- শ্বাশুড়ি দেশ থেকে এসেছে ওরাও কিন্তু আমাদের সাথে আসবে”। প্রায় আধা ঘন্টা খানিক পরে আরেক বন্ধু জামাল ফোন করে জানালো “মামু, মন্ট্রিয়ল থেকে আমার শালা, শালার বৌ এই মাত্র এসেছে এবার টরেন্টোতে ঈদ করবে। ওরাও কিন্তু আমাদের সাথে আসছে। ওদের সঙ্গে ওদের তিনটি টিন এজেড ছেলে আছে “। দবির উদ্দিন শুখনা মুখে আচ্ছা ঠিক আছে বলে ফোন রেখে প্রমাদ গুনলো। গরুর গোস্ত কেনা হয়েছে মাত্র ২০ ডলারের। আগের হিসাব অনুযায়ী ছেলেমেয়ে সহ প্রায় ৩০/৩৫ জনের জন্য যা কিনেছিলো টেনে/টুনে চলে যাওয়ার কথা। এখন এবার বাড়তি ৭ জন। ফোন রেখে দবির উদ্দিন ভাবতে থাকে স্ত্রী ঝর্ণার সাথে বিষয়টি নিয়ে ভাবলে কেমন হয়? বেড রুমের দিকে এগুতেই দেখে ঝর্ণা মেয়ের হাতে নিপুণভাবে মেহেদী দিচ্ছে। চোখে মুখে বিপুল উৎসাহ নিয়ে মেয়ে নিপা মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মা/মেয়ের নিচু গলায় কথা চালা/চালি চলছে। মায়ের কি কোথায় বাচ্চা মেয়েটি হেসে কুটি কুটি। দবির উদ্দিন নিঃশব্দে দূরে দাঁড়িয়ে মা/মেয়ের কথোপকথন উপভোগ করে।
ঈদের মেহমানদারির রাজ্যের চিন্তা মাথায় নিয়ে দবির উদ্দিন রাতে প্রায় পৌনে বারোটার দিকে বিছানায় শুতে যায়। ঝর্ণা আগেই শুয়ে পড়েছে. দবির উদ্দিন একশো ভাগ নিশ্চিত ঝর্ণা এখনো ঘুমায়নি, ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে। মেয়েদের এই ভান করার ব্যাপারে সৃষ্টিকর্তা মেয়েদের বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছেন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে দবির উদ্দিন ভাবতে থাকে পরের দিনই ঈদ। হালাল মাংসের দোকান সারা দিন বন্ধ থাকবে। কেন যে এত কম টাকার গরুর গোস্ত কিনেছে ভাবতেই নিজের চুল ছিড়তে হচ্ছে। ভাবতে গিয়ে দবির উদ্দিন একটি আইডিয়া পেয়ে যায়। আচ্ছা মাংসের মধ্যে বড় বড় করে আলুর টুকরা দিলে কেমন হয়? ঝর্ণার কোথায় কিছুটা হকচকিয়ে ওঠে দবির উদ্দিন।
: এই ঘুমাচ্ছ?
: না
কি এত ভাবছো?
না মানে,..
কি এত নাম মানে করছো, সরাসরি বলে ফেলো।
দবির উদ্দিন সাহস করে বাড়তি মেহমানের কথা বলে ফেলে।
ঝর্ণা: এ নিয়ে কি এত ভাবার আছে? চিকেন বারবিকিউ থাকবে। কিছু ভর্তা/তোরটা করা যেতে পারে. ডিম্ দিয়ে আলুর চপ থাকবে. কলিজা দিয়ে বুটের ডাল রান্না করা হবে। চিংড়ির প্ল্যান টাও একটু চেঞ্জ করা যেতে পারে। আগের প্লান অনুযায়ী চিংড়ির রেজালা করার কথা ছিল। এ পরিস্থিতিতে চিংড়ির সাথে জুকিনি, বেগুন দিয়ে একটি সবজির আইটেম করা যেতে পারে”.
ঝর্ণার বুদ্ধিমত্তায় অভিভূত হয় দবির উদ্দিন। প্রবাস জীবনে সারা দিনের ব্যাস্ততায় অনেক দিন ঝর্ণার সাথে তেমন গল্প করা হয়ে উঠেনা। কাল ঈদ. দবির উদ্দিন, ঝর্ণা দুজনেই আগে থেকেই ছুটি নিয়ে রেখেছে. আগামীকাল ভোরে উঠার কোনো তাড়া নেই। ঝর্ণা ঈদের রান্নার অনেক খানি সেরে ফেলেছে। সামারে বাচ্চাদের স্কুলও ছুটি। আজ অনেক রাত অবধি পুরানো দিনের কথা বলতে বলতে একসময় ঘুমিয়ে পরে আমাদের প্রবাসী দবির উদ্দিন-ঝর্ণা দম্পতি. (চলবে)