টরন্টো থেকে:-
আল্লাহপাক অদ্ভুত এক সম্পর্কের মায়াজালে মানুষকে আবদ্ধ করে রেখেছেন। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে, অভিমানে মানুষ ঘর ছাড়ে , দেশ ছাড়ে এমনকি অনেক সময় প্রিয়জন থেকেও দুরে সরে যায় । আবার কোনো এক অদৃশ্য সুতোর টানে মানুষ ফিরে আসতে চায় ছেড়ে আসা তীরে। প্রকৃতির বিচিত্র খেলায় অনেক বছরের ব্যাবধানেও তা একেবারেই ছিন্ন হয়না কখনো। এমনি এক সম্পর্কের টানাপোড়েনের গল্প আজকের লেখার বিষয়বস্তু।
বসে আছি টরন্টো ইস্ট জেনারেল হসপিটালের (সম্প্রতি পরিবর্তিত নাম মাইকেল গেরন হসপিটাল) ছয় তলায় Psychitric ward এর ছোটখাটো একটি সম্মেলন কক্ষে, উদ্দেশ্য, এক রুগীকে নিয়ে কেস কনফারেন্স করা। মানসিক রোগ এবং আসক্তি আক্রান্ত মানুষদের নিয়ে যারা কাজ করেন তারা কমবেশি সবাই এই প্রক্রিয়াটির সাথে পরিচিত। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে রুগীর আরোগ্য লাভ বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার পথে প্রতিবন্ধকতা গুলোকে চিহ্নত করা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সবার কার্যকরী ভূমিকাকে আরো জোরদার করা। আমার উপস্থিতি রুগীর কেস ম্যানেজার হিসাবে। এই ধরনের কনফারেনসে সচরাচর মনস্ত্তবিদ, হাসপাতাল সমাজকর্মী, নার্স এবং সংস্লিষ্ট কেস ম্যানেজার উপস্তিত থাকেন। সায়মন ( সঙ্গত কারণেই ছদ্ম নামের ব্যাবহার) এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দিন কয়েক আগে। তার হাসপাতালে ভর্তি হবার পটভূমিও ভিন্নতর। প্রচন্ড রকমের বিষন্নতায় ভোগা সায়মনের সাথে দিন কয়েক আগে নর্থ অন্টারীয়র ছোট এক শহর থেকে দেখা করতে আসেন এক ভদ্রমহিলা। কোনো এক অজানা কারণে এই সাক্ষাতের পর থেকেই সায়মন বন্ধ করে দেয় তার নিয়মিত ঔষধ সেবন এবং সেই সাথে বেড়ে যায় তার মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা। সৌভাগ্যবশত সে নিজেই এম্বুলেন্স ডেকে চলে আসে এই হাসপাতালে।
প্রথম দিকে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখলেও কেস কনফারেন্স এর এক পর্যায়ে সায়মন নমনীয় হতে শুরু করে, ধীরে ধীরে কিছুটা উন্মুচিত হয় তার অতীত জীবনের কিছু অধ্যায়। সায়মন তার একমাত্র বোনের পরিবারের সাথেই বসবাস করত। পনের বছর আগে তুচ্ছ কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে বোনের সাথে তার বাদানুবাদ হয়। প্রচন্ড রাগে, অভিমানে সে ঘর ছেড়ে চলে আসে। ঘর ছাড়লেও সায়মনের প্রত্যাশা ছিল যে তার বোন তার খোজ নেবে, ফিরিয়ে নিয়ে যাবে আগের জায়গায়। কিন্তু এক মাসেও যখন কেউ তার খোজ নেয়নি, তখন সায়মন সিদ্ধান্ত নেয় যে সে আর ফিরে যাবেনা, পৈত্রিক সম্পত্তির ও দাবি নেই তার। বেছে নেয় মাথার উপর ছাদহীন এক অনিশ্চিত জীবন। বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে আসে তার, গড়িয়ে পড়ে বাধ ভাঙ্গা অশ্রু।
পরের সপ্তাহে আবার আসি একই হাসপাতালে সায়মনের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশে। হাসপাতালের নিচতলার মূল লবিতে এসে চমকে যাই। তাকিয়ে দেখি সায়মন বসে আছে টিম হর্টনে, বেশ আয়েশ করেই কফি খাচ্ছে। জিজ্ঞাস করি, ” কি ব্যাপার সায়মন, কফি খাচ্ছ একা একা, কেমন আছ?” বেশ উত্ফুল্ল কন্ঠে সহাস্যে সায়মন উত্তর দেয়, “ভালো আছি, এখন আছি এক ঘন্টার পাস নিয়ে। জানো হাসান, আমার বোন এসেছিল আমাকে নিয়ে যেতে, আমি যাইনি। ভেবে দেখলাম কি হবে ফিরে যেয়ে. জীবনের বেশ অর্ধেকটা পথ তো কাটিয়েই দিয়েছি. বাকি সময়টা না হয় এভাবেই কেটে যাক। তাছাড়া তোমরা তো আছ সময়ে অসময়ে”। এ এক অন্য সায়মন যার সাথে গত সপ্তাহে দেখা জীবনের ভারে নুয়ে পড়া সায়মনের কোনই মিল নেই।
সায়মনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, কর্তব্যরত নার্স এর সাথে আলাপ করে ডিসচার্জ প্ল্যানিং জেনে ফিরে আসি পার্কিং লটে। গাড়িতে বসে ভাবি কি বিচিত্র মানুষের মন। এক অদ্ভূত রহস্যের আধার। যে সায়মনের সাথে কাজ করছি গত তিন বছর যাবত, যার মানসিক, আর্থিক, আইনগত অনেক বিষয়ের সাথেই আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ভুলেও সেই সায়মন একবারও বলেনি তার ফেলে আসা পরিবার বা বোনের কথা। কৌশলে এড়িয়ে গেছে এই বিষয়ক সকল কৌতুহল। অনেক বছর পরে বোনকে দেখে হয়ত জমিয়ে রাখা আবেগ ধরে রাখতে পারেনি, হয়ত রক্তের টান আর অভিমানী মনের সংঘর্ষে সায়মনের পক্ষে স্বাভাবিক থাকা আর সম্ভব হয়নি। বুঝতে পারিনা কোন টানে মানুষ ফেলে আসে সমাজ, সংসার, সামাজিক প্রতিষ্টা, বেছে নেয় অনেকটাই অনভিপ্রেত জীবন ? আবার ফিরে যাবার সুযোগ পেয়েও এই জীবনের মধ্যেই মানুষ খুঁজে বেড়ায় বেচে থাকার কোন আনন্দ ? বছরের পর বছর কাজ করেও মানুষের মন এবং জটিল মানবিক সম্পর্কের কতটুকুই বা আমরা জানি ? শুধুমাত্র কিছু ঔষধ এবং মনস্তত্তবিদ্দের Diagnostic and Statistical Manual এর কোন এক Category তে ফেললেই কি এই রহস্যের উন্মোচন সম্ভব ? এসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। এত ভাবনার সময় ও হাতে নেই। ছুটতে হবে Sheppard এভিনিউ ইস্ট এর ODSP অফিসে, সায়মনের HSF (Housing Stabilization Fund) বিষয়ক জটিলতা নিরসনের জন্য। হাসপাতাল ছাড়িয়ে গাড়ি যখন Danforth এবং Coxwell এর মোড়ে এসে থামে, স্পিকারে তখন বাজছে অনেক পুরোনো এক বাংলা গান…
“মনের মাঝে যে জন বসে নিত্য বাজায় বাশি
জগত জুড়ে তারেই খুঁজে হলাম পরবাসী
বন্ধ চোখে রূপ দেখি যার, দুচোখ মেলে পাইনা খুঁজে তারে
তুমি এমনি জাল পেতেছ সংসারে”
লেখাটি অনেক ভালো লাগলো।
হাসান ভাই, আসলে মানুষ তার “দুঃখ” গুলোকে অনেক যত্নে লালন করে।
তাইতো সেটাকে সে কখনো হারাতে চায়ান।
কারন তার শেষ সম্বল ঐ “দুঃখটুকু” হারিয়ে গেলে,তার বাঁচার আর কোন অবল্বন থাকেনা।
Thanks Hasan vi for the post. I guess loneliness is relative and subjective. During my pro-gradu research in Finland I had seen most of their seniors in Scandinavia like to live alone in their later life. In fact, two of my case studies lived alone almost all life. They like to be in touch with their nearest ones but do not want to be with them. For example, my research project’s co-author used to tell that in their society parents do not feel comfortable if a grown up child live with them which is opposite in our society, we would rather like to be surrounded by our kids and grand-kids.
চমৎকার লেখা মশিউল হাসান ভাই। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। পড়তে পড়তে নিজেও কখন যেন ভাবনার জগতে চলে গিয়েছিলাম।প্রত্যেক মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতা, এককীত্ব, সাহচর্যে বিশেষত্ব আছে; আবার কখনো কখনো কিছুটা মিল খোঁজে পাওয়া যায় অন্যের অভিজ্ঞতার সাথে।আপনার কাজের সুবাধে অন্যের জীবনের গল্প নিয়ে লেখাটি নিশ্চয়ই আমাদের অনেকের জীবনের অভিজ্ঞতাকে মনে করিয়ে দিয়েছে, সমৃদ্ধ করেছে।
ধন্যবাদ হাফিজ, মুকুল এবং জাকির ভাই আপনাদের মন্তব্যের জন্য. আমাদের প্রত্যেকের জীবনই আসলে এক একটি আনন্দ বেদনার কাব্য. প্রবাসের অতি ব্যস্ত জীবনে আত্ম বিশ্লেষণের সময় আমাদের নেই. নিজেদের পার্থিব উন্নয়ন নিয়ে আমরা এতটাই নিমগ্ন, যে ভুলে যাই আমাদের চার পাশে এমন এনেক মানুষ আছে যারা জীবন সায়ান্নের আগেই ভুলে গেছে জীবনের লক্ষ্য, যারা প্রতি মুহুর্তে খুঁজে বেড়ায় বেচে থাকার প্রেরণা. আশা করছি আমার লেখা আরো অনেককেই কিছুটা হলেও অনুপ্রাণিত করবে.