পার্থ, অস্ট্রেলিয়া থেকে :
ছোট অনেক ‘স্মৃতি’ আমার মনে থাকে। আবার গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভুলে যাই। দিনক্ষণ ভুলে যাই। যেমন যে দিনটির কথা ভুলে গেলে ঘরের মেঘ কালো হয়ে ঝড়ের পূর্বাভাস দেয় তা সময় মতো মনে পড়ে না, তা হলো স্ত্রীর জন্মদিন। গুরুত্বপূর্ণ বা তাৎপর্যপূর্ণ দিনক্ষণের কথা আরেকদিন বলব। আজছোট একটা স্মৃতির কথা বলি। হয়তো তা ছোট নয়, ছোট হলে সেই স্মৃতি তিরিশ বছর বয়ে বেড়াতাম না। যাঁর কথা লিখছি তেমন মানুষদের কথা।আমাদের সমাজে কেউ সাধারণত মনে রাখে না।
খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি আর সাদা চুলের একবৃদ্ধ মফস্বলের এক বাজারে কলম সারাই (মেরামত) করতেন। বল পয়েন্ট কলম তখনও বাজারে আসেনি। বাজারটা ছিল আমাদের স্কুলের পাশে। তিনি বাজারের গলির পাশে একটা বাক্স নিয়ে বসতেন। তার বাক্সের কাচের ভেতর দিয়ে দুসারি কলম দেখতে পেতাম। নতুন কলম, পুরনো কলম, ভাঙা কলম, কলমের ক্যাপ, নিব, টিউব ইত্যাদি। তিনি কালো প্লাস্টিকের চোঙায় ফিট করা একটা লেন্স ডান চোখে লাগাতেন। কি করে তা চোখে আটকে থাকত, খুব অবাক হতাম। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের কৌতূহলের শেষ নেই, বোধহয় মেয়েদেরও।
বাজারের তিনটা সমান্তরাল গলির আড়াআড়ি আরেকটা গলি। সেই আড়াআড়ি গলিতে বৃদ্ধ বসতেন। দুদিক থেকে রিকশা এলে কলম কারিগর। চাচা তার বাক্স সরিয়ে রিকশা পাশ কাটানোর জায়গা করে দিতেন। বাজারের নাম পাঁচআনি বাজার। সেখানে প্রায় বিশ-ত্রিশটা মিষ্টির দোকান ছিল (এখনও আছে)- চমচম, রসগোল্লা, রসমালাই, পানতোয়া, জিলাপি ইত্যাদি।
বাজারের বাতাসে গরম জিলাপি ভাজার গন্ধ ভাসতো। লোভ সামলাতে পারতাম না। উপায় ছিল না। বাড়ির পাশে মুদি দোকানের কেনাকাটা শেষে যে চারআনা বা আটআনা বাঁচতো তা দিয়ে আইসক্রিম বা সিঙ্গারা খেতে পারতাম- এর বেশি কিছু না।
একদিন আমার কলমে কালি ঝরছিল। চাচার কাছে গেলাম। চাচা তার কালো প্লাস্টিকের চোঙা ডান চোখে লাগিয়ে আমার কলম পরীক্ষা করছিলেন। তাঁর বাক্সের কাচের ভেতর দিয়ে গাড় নীল রঙের একটা কলমে আমার চোখ পড়ল। আমি জিজ্ঞেস করলাম-
: চাচা এই নীল কলমটা কি নতুন?
: কোনডা?
আমি কাচের বাইরে আঙুল দিয়ে দেখালাম,
: এই যে এইটা।
চাচা চোখ থেকে চোঙা সরিয়ে বাক্সের কাচের দিকে তাকিয়ে বললেন-
: নাহ, পুরান। সকালে একজন বেইচা দিছে।
: এত সুন্দর কলম বেচে দিল!?
: কলিকাল ! কলম বেইচা হলে ঢুকছে।
: কলম বেচে কেউ সিনেমা দেখে ?
: বাবা রে, কেউ দুধ বেইচা মদ খায়। কেউ মদ বেইচা দুধ খায়।
ভাবছিলাম এ সুন্দর নীল কলমটা যদি আমি পেতাম! নিঃশ্বাস ফেলে বললাম-
: চাচা আমার কলম ঠিক হবে তো?
: ঠিক না অইয়া যাইবো কৈ? দুই টেকা লাগবো।
: কি হইছে?
: প্লাস্টিকের মাল, প্যাচ কাইটা গেছে। বদলাইতে অইবো।
: একটাকা দিলে হয় না ?
: কলিকাল। এক টেকায় কিছু অয়?
আমার পকেটে দুই টাকা ছিল। গরম জিলাপি খেতে হবে। সরল মিথ্যা বললাম-
: আমার কাছে চাচা এক টেকাই আছে।
: আইচ্ছা দেড়টেকা দিও।
: চাচা আমার কাছে নাই তো।
: আইচ্ছা আটআনা পরে দিয়া যাইও। মনে কইরা দিয়া যাইও।
এই কথাটাই শুনতে চাচ্ছিলাম। বললাম-
: কোনো চিন্তা নাই চাচা। আমি কিছু ভুলি না।
: কলিকাল! কত ছেলেপেলে কয় দিয়া যামু। পরে আর খবর থাকে না।
: আমি সেইরকম না।
চাচা মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে চোঙা ছাড়া বাঁ চোখটা দিয়ে আমাকে দেখলেন। তারপর বললেন-
: বিড়ি-সিগারেট তো এহনো ধরো নাই মনে অয়।
: জ্বি না।
: তাইলে তোমারে বিশ্বাস করা যায়।
আজ তিরিশ বছর পরও চাচার আটআনার কথা ভুলিনি। আধুলিটা এখন বুকেরভেতর খচখচ করে। আজকাল কালির কলম আর দেখা যায় না। দু-একজন হয়তো এখনও কালির কলম ব্যবহার করেন। যদি তেমন কলম দেখি আমার ভেতর থেকে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে। আফসোস করে কোনো লাভ নেই জানি, আমি চাইলেও চাচার সেই আট আনা ফিরিয়ে দিতে পারব না। তিনি হয়তো অনেক বছর আগেই জীবনের পাট চুকিয়ে ওইপাড়ে চলে গেছেন।
তোমাকে বলছি, যদি তুমি এখন স্কুল-কলেজের ছাত্র বা ছাত্রী হয়ে থাকো-কোন চাচার কাছে আট আনা বাকি রেখো না। একদিন সেই আট আনা বুকের ভেতর খচখচ করবে- হাজার গুণ ফিরিয়ে দিতে চাইলেও দিতে পারবে না।
আপনার অন্য সব লেখার মতই সুন্দর এই স্মৄতির কথা।
আপনার প্রতিটি লেখার মধ্যে একটি মানবিক বিষয় থাকে যা নাড়া দিয়ে যায় আমাদের চেতন বা অবচেতন মনকে, ফলে আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া আপাত সাধারণ বিষয়কেই আবার অন্য আঙ্গিকে ভাবি. আপনার এই লেখায়ও এর বেতিক্রম হয়নি.ধন্যবাদ ফারুক ভাই. আরো লেখার অপেক্ষায় রইলাম.