পরবাসীর (৩য়) বর্ষপূর্তি এবং একটি শুভ খবর।

এই ব্লগের তৃতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ব্লগের কর্ণধার মিঃ হাফিজ সাহেবের আমন্ত্রণে একটি লেখার চিন্তা করছিলাম।  আমার মতো আনকোরা এবং অপেশাদার লেখিয়েদের বিষয়বস্তুর অভাব হয় না। ভাবছিলাম সময়টা বের করতে পারলে কিছু একটা লিখে ফেলবো। আজকে ঠিক অফিস থেকে বাসায় ফিরে গ্যারেজে ঢোকার সময় মিসঃ নাহিদের একটি টেক্সট মেসেজ পেলাম। ” I am very glad to tell you that they confirmed me today. I will join there on June 4, 2018….” উনার কাজটির সাথে যেহেতু কোর্ট-কাচারী, পুলিশ এবং Apprehension জড়িত তাই সঙ্গত কারণেই প্রতিষ্ঠানের নামটি উল্লেখ করলাম না। অসাধারণ একটি খবর, অন্তত আমার জন্য।  কারণ উনার Perseverance, dedication commitment সমন্ধে আমার বেশ ধারণা ছিল। আমি প্রায়ই যে কথাটি বলে থাকি যে, ১০০% এফোর্ট দিতে পারলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাফল্য আসবে এবং উনার মতো লোকেরা আমাকে অনবরত আমার সেই বক্তব্যকে বাস্তবে প্রমাণিত করে চলেছেন, তাই লেখার শুরুতেই উনাকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন।

মিস: নাহিদের সাথে আমার পরিচয়টি বেশ ইন্টারেস্টিং।  কমিউনিকেশন বা নেটওয়ার্কিং যে আপনাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে সেটা তার সাথে আমার পরিচয়ের গল্প থেকে জানতে পারবেন।এই ছোট গল্পটির পরেই আমি বলবো কিভাবে তিনি তার স্বপ্নের সিঁড়ি উত্তরণ করলেন। আমি হটাৎ একদিন আমার এক পরিচিত, গুজরাটের এক সোশ্যাল ওয়ার্কার মহিলার টেক্সট পেলাম।  সে অনুমতি চাইল আমার নাম্বারটি সে বাংলাদেশের একজন MSW স্টুডেন্টকে দিতে পারবেন কি না। সে তখন গ্রে-হাউন্ড বাসে শিকাগোর পথে।  তার সহযাত্রী মিসঃ নাহিদ।কথা প্রসঙ্গে সে মিসঃ নাহিদকে বলে “তোমাদের দেশের আমার এক বন্ধু আছে যে বর্তমানে কাজ করছে, যোগাযোগ থাকলে হয়তো কাজে লাগবে।“ মিস: নাহিদ নাম্বার নিলেন এবং তার যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ শেষে দেশে এসে নিজের পড়াশুনায় মনোনিবেশ করলেন।

প্রায় কয়েক মাস পরে মিসঃ নাহিদ প্লেসমেন্ট করতে উইন্ডসর থেকে টরোন্টোতে আসেন। সেই অফিসের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে তার পরিচয় হয় পাকিস্তানের একজনের ফামিলি কাউন্সিলর এর সাথে। আবারো কথা প্রসঙ্গে মিস: নাহিদ যখন বলেন উনি বাংলাদেশী এবং প্লেসমেন্ট শেষে সোশ্যাল সার্ভিস ফিল্ডে চাকরি খুজবেন এবং তার সাহায্য দরকার হতে পারে। ওই পাকিস্তানী বেক্তি তখন মিস: নাহিদকে বলেন, অবশই তুমি আমার সাথে কন্টাক্ট করতে পারো বাট তোমাদের দেশের আমার পরিচিত একজন আছে, যে আমাকে বেশ কিছু তথ্য দিয়ে উপকার করেছিল, আমার মনে হয় উনার সাথে কথা বলে দেখতে পারো। মিস: নাহিদ নাম জিজ্ঞেস করলেন। ওই পাকিস্তানী কাউন্সিলর তখন বললেন উনার নাম মিঃ মুকুল। মিস: নাহিদ বললেন আমি তাকে চিনি না, কিন্তু এখন আমার তার সাথে পরিচিত হতেই হবে কারণ একিই বেক্তির নাম আমি সেই শিকাগো শহরে কোনো এক বাসে একজন ইন্ডিয়ানের কাছে শুনেছি, আজকে আবার তুমি বলছো অথচ বালাদেশের অনেকের নাম জানি বা অনেকের কথা শুনেছি কিন্তু উনার কথা জানি না।  ওই কাউন্সিলর তখন আমাকে ফোন করলেন এবং বললেন উনি আমাকে একজন দেশি ভদ্রমহিলার সাথে পরিচয় করাতে চান। এর পর মিস: নাহিদকে ফোন দেন।  মিস: নাহিদ দেখা করতে চাইলেন, আমার বেস্ততায় আর হয়ে উঠে না, তবে সে নাছোড় বান্দা, অবশেষে অফিস শেষে একদিন দেখা হোলো উনার সাথে। এইভাবে পরিচয়।

উনার সাথে কথা বলে আমার বুঝতে আর বাকি ছিল না যে উনি একদিন ভালো করবেন, কারণ উনার যোগ্যতা অনেক ছিল কিন্তু এদেশে আসলে এবং সঠিক তথ্য না জানলে প্রথম প্রথম যা হয়; নিজেকে অদক্ষ, অযোগ্য, দুর্ভাগা ইত্যাদি মনে হয়।  উনার সেমনটি ছিল তাই, আমি আর বলিনি যে উনার যোগ্যতা আমাদের থেকে কোনো অংশে কম না এবং উনি আমাদের থেকে ভালো চাকরি পাবেন। শুধু বললাম, আমি উনার অবস্থানে থাকাকালীন যতটা অগ্রসর ছিলাম না, উনি তার থেকে অনেক অগ্রসর, সুতারং দুশ্চিন্তাকে একটু দূরে রেখে সুচিন্তাকে সেই জায়গাতে  স্থান দিলে উনি ঠিক জায়গায়া একদিন পৌঁছে যাবেন। এর পর পর উনি আরো একটা প্লেসমেন্ট করলেন। ডিগ্রি শেষ করলেন।  সিটিতে একটি চাকরিও পেলেন, কিন্তু উনার কাঙ্খিত চাকরি আর হসছে না। যদিও সেই চাকরির জন্য ২/৩ বার ইন্টারভিউ দিলেন। আমি যতটুকু পেরেছি সাহায্য করলাম কিন্তু আমার সাপোর্ট ফেল মারলো।  অবশেষে ওই ধরণের কাজ করেন এরকম এক জনের সাথে কানেক্ট করিয়ে দিলাম, আর হাল না ছেড়ে ক্রমাগত চেষ্টা করে যেতে বললাম। উনি তাই করলেন। আর সেই চেষ্টা আর কষ্টের সুফলটা এলো আজকে। আর আমার ভালো লাগলো, উনাকে আমি যে বলেছিলাম উনি আমাদের থেকে অগ্রসর, শুধু এই দেশের সিস্টেম এবং সময়ের বাঁকে পড়ে নিজেকে হতভাগা মনে হসছে, কিন্তু দিন একদিন আসবে, আর আমার সেই কথা প্রমানিত হলো। আমিও নতুন করে শিখলাম, Dream never dies, it may hibernate; we just have to wake it up and work on it.

 

যাহোক উনার খবরটাতে খুব খুশি হলাম।  উনার বেক্তিগত বেপারে কোনোদিন কিছু জিজ্ঞেস করিনি।  আজকে জানতে চাইলাম, কখন এদেশে এলেন এবং কেন পরিবার টরন্টো রেখে MSW করতে উইন্ডসর গেলেন।সংক্ষেপে তার উত্তর বলি। প্রায় ৬ বছর  আগে সোসিওলজিতে ডিগ্রি এবং চাকরির অভিজ্ঞতা নিয়ে এখানে আসেন।তেমন কোনো ভালো গাইডেন্স পাননি। অবশেষে একটি অফিসে  গিয়ে সেখানকার কাজ এবং পরিবেশ  উনার খুব পছন্দ হয় এবং উনি জানতে পারেন ওই অফিসে কাজ করতে হলে নূন্যতম BSW থাকতে হবে। ইয়র্ক উনিভার্সিটিতে BSW ভর্তির সুযোগও পান কিন্তু ভালো পরামর্শের অভাবে সেটি আর করতে পারেন নাই।  হাল ছাড়েন নাই উনি।  পরিশেষে ভর্তি হন উইন্ডসর উনিভাসির্টিতে MSW তে। শুরু হলো তার স্বপ্নের সিঁড়িতে উঠার সংগ্রাম। এবং এই সংগ্রামের পথ খুব মসৃন ছিল না, বরং ছিল অনেক বন্দুর। তবুও উনি চালিয়ে গেলেন, এবং কয়েক বছর পরে আজকে তার সাধ পেলেন।

এলেন এবং কেন পরিবার টরন্টো রেখে MSW করতে উইন্ডসর গেলেন।সংক্ষেপে তার উত্তর বলি। প্রায় ৬  আগে সোসিওলজিতে ডিগ্রি এবং চাকরির অভিজ্ঞতা নিয়ে এখানে আসেন।তেমন কোনো ভালো গাইডেন্স পাননি নি। অবশেষে একটি অফিসে কাজের খোঁজে গিয়ে সেখানকার কাজ এবং পরিবেশ  উনার ভালো লাগে, এবং জানতে পারেন ওই অফিসে কাজ করতে হলে নুন্নতম BSW লাগবে। তখন মনে মনে ঠিক করলেন উনি যে করেই হোক  ডিগ্রী করবেন। ইয়র্ক উনিভার্সিটিতে ভর্তিও  হলেন কিন্তু আর সেটা করা হলো না।  আবারো চেষ্টা করলেন।  এবার উইন্ডসর উনিভার্সিটিতে MSW প্রোগ্রামে।  এবং শত চ্যালেঞ্জের পরেও শেষ করলেন, এবং আজ তার ফল পেলেন।



বললেন পড়াশুনা শুরুর আগে পরিবারের প্রয়জন মেটাতে উনাকে সিকুরিটি এবং পেট্রল পাম্প থেকে শুরু করে অনেক অড জব করতে হয় এবং সেগুলি অনেক কষ্টের ছিল । পেট্রল পাম্প এর কাজ শুরু করতে হতো ভোর ৫ টা থেকে। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তার মনে হতো ওই জাতীয় কাজ তার পক্ষে বেশি দিন করা সম্ভব হবে না, তাই যত কষ্টই হোক তাকে এই বয়োসে হলেও MSW শেষ করতে হবে। বলে রাখি, আমাদের এই বয়োসে এবং পরিবারের দায়িত্ব পালন করে ওই রকম একটি FT ডিগ্রী করা চাটটি খানি কথা না। এবং মনে রাখবেন উনি একজন মহিলা, যাদেরকে এখনো দেশে একটু খাটো করে দেখা হয় কিন্তু উনি সেই sterotype ধ্যানধারণা পাল্টে দেওয়ায় অনেকের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছেন। মিসঃ নাহিদ দুটি কন্যার জননী। “Que les femmes de notre pays gagnent” জয় হোক আমাদের দেশের রমনীদের।

উপরে উল্লেখিত কমুনিকেশন এবং নেটওয়ার্কিং এর কথায় আসি। আগেকার দিনের থেকে এখন সামাজিক মাধ্যম কমুনিকেশন এবং নেটওয়ার্কিং কে অনেক সহজ করে দিয়েছে কিন্তু এখনো পর্যন্ত আমরা সেটাকে সঠিক ভাবে বেবহার করছি না। এখানে অনেক ওয়ার্কশপ, সেমিনার বা এই জাতীয় ব্লগের প্রশ্ন করার জায়গাগুলিতে এখনো পর্যন্ত আমি তেমন চাকুরী প্রাথীদের সমাগম দেখি না, অথচ পেশাগত চাকরির বেপারে হা হুতাশের কমতি নেই। মিসঃ নাহিদের এই সাফল্যের পিছনে এই কমুনিকেশন এবং নেটওয়ার্কিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, সেটা তার এই স্বপ্নের সিঁড়ি উত্তরণের কাহিনী থেকেই অনেকটা অনুধাবনীও।

আমি নিজে যেমন হোমরা চোমরা কেউ না (বরং বলতে পারেন সমাজের দুস্থ লোকদের সেবা করার একজন চাকর) তেমনি হোমরা চোমরা লোকের গল্প করতেও চাই না, কারণ উনাদের গল্প করার জন্য অনেক মাধ্যম আছে। আমার দরকার এই রকম নাহিদদের মতো ছোট ছোট বাস্তব গল্প, আর  এই জাতীয় গল্পের চরিত্রগুলিই আমার জীবনের হিরো। তাই আমি চাই আপনারাও আপনাদের জানা এই ধরণের কিছু বাস্তব গল্প এখানে তুলে ধরুন যাতে করে আমরা সবাই উৎসাহী এবং উপকৃত হতে পারি। হতাশা, দুর্দশা এবং সংকটময় জীবনের কথা অহরহই লেখা হয়ে থাকে, কিন্তু এই ধরনের গল্প খুব বেশি সামনে আসে না, অথচ এর থেকে শেখার বা জানার অনেক আছে। জাস্ট আমার কিছু দিন আগের লেখা মাহবুব আলমের গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এক ভদ্রলোক প্রায় এক জুগ পরে পড়াশুনা শুরু করেছেন। অন্তত একজনের জীবনে তো আমরা প্রভাব ফেলতে পেরেছি !

 

“…দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি –

নেই, দেরি নেই আর,

ছুটে চলো, ছুটে চলো আরো বেগে

দুর্দম, হে রানার ॥ – সুকান্ত ভট্টাচার্য

দেশ, শৈশব, আত্মীয় -স্বজন, ছোটবেলার স্মৃতি, কোকিলেএর ডাক, মাথার উপরে বাবার হাত, আর মায়ের আঁচলের ছায়া ছেড়ে একটুখানি স্বাচ্ছন্দের জীবনের খোঁজে  এই বিভুঁই বিদেশে আমরাও কি এক একজন রানার না ??? তাই রানারের মতো ছুটে চলো, ছুটে চলো আরো বেগে দুর্দম, হে প্রবাসী রানার !!

আর সমস্ত হতাশা, দুরাশাকে পিছে ফেলে দুর্দম বেগে ছুটে চলার আশা রেখেই আজ শেষ করি। মিসঃ নাহিদকে তার গল্প শেয়ার করার অনুমতি দেওয়ার জন্য এবং আপনাদেরকে সেটা পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

সবাই ভালো থাকবেন।

মুকুল
টরন্টো, কানাডা

১ মন্তব্য

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন