একুশ এর সাথে ইংরাজীর কোনো বিরোধ নেই, একুশ এর জন্ম হয়েছিল উর্দুর একচ্ছত্র অন্যায় আধিপত্যের বিরুদ্ধে। এসব পুরানো কথা আমরা সবাই জানি, কিন্তু আমার মনে হয় কোথায় যেন আমাদের উপলদ্ধির জায়গায় একটু ঘাটতি আছে । তাই, আজ এই একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার জন্য সকল শহীদ এর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, সম্মান জানিয়ে আমার আজকের লেখা শুরু করছি ।

আমাদের সময়, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভর্তি পরীক্ষা ইংরেজিতে হতো । আমি যখন স্থল সেক্টরের সকল ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তখন এক বন্ধুর বড় ভাই পরামর্শ দিলেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভর্তি-র ব্যাপারে । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যেহেতু পরীক্ষাটি হবে ইংরেজিতে, তাই নতুন করে বই-এর পাতা উল্টিয়ে ইংরেজি টার্ম গুলি দেখতে লাগলাম । আমরা এতদিন শিখে এসেছি, খাঁটি বাংলায় “পড়ন্ত বস্তুর সূত্র, ‘আর্কিমিডিসের সূত্র, ফ্যারাডের দক্ষিণ হস্তের সূত্র” ইত্যাদি । যাহোক আদা- জল খেয়ে এবার ইংরেজিতে এসব আওড়াতে শুরু করলাম । অবশেষে, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভর্তি পরীক্ষা কোনো কারণে দেওয়া হয়নি , তবে ভর্তি হলাম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে ।

এবার, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি অনুষদে ভর্তি হয়ে দেখলাম, প্রতি বছরে অসংখ্য সাবজেক্টে পড়াশুনা করতে হয় যেমন: কৃষি বিজ্ঞান (এগ্রোনোমি) , মৃত্তিকা বিজ্ঞান ( সয়েল সায়েন্স), রসায়ন (কেমিস্ট্রি), গণিত (ম্যাথ), জীব বিজ্ঞান (বায়োলজি), অর্থনীতি (ইকোনমিক্স), সমাজ বিজ্ঞান ( সোসোলজি) ইত্যাদি । আমি যদি আমার সেই সময়ের সহপাঠীদের জিজ্ঞাসা করি আমি যে সাবজেক্ট গুলির কথা এখানে উল্লেখ করলাম আমরা কতজন সত্যিকার ভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এসব বাংলা শব্দ প্রয়াগ করে কথা বলতাম ! আমরা কি ব্র্যাকেটের ভিতরের শব্দগুলি অহরহ ব্যাবহার করতাম না! এটাকি এক ধরণের হটকারিতা না ! আমি সয়েল সায়েন্স পড়ার সময় একটি টার্মের সাথে জীবনের প্রথম পরিচিত হলাম, সেটা হচ্ছে “মৃত্তিকা ক্ষিতিজ”. অথচ ইংরেজিতে সয়েল প্রোফাইল বললে মোটামুটিভাবে সহজেই একটু ধারণা পাওয়া যায় । তাই বলে মৃত্তিকা ক্ষিতিজ! আমি, সেকেন্ড ইয়ার থেকে ইংরেজি ভাষা -র যথাযত গুরুত্ব অনুধাবন করে ফাইনাল এয়ার পর্যন্ত সকল সাবজেক্ট ইংরেজিতে নিলাম। প্লিজ, আমাকে ভুল বুঝবেননা । আমার এই সব সাবজেক্ট ইংরেজিতে নেওয়া মানে এই না আমার মধ্যে স্বদেশ প্রেমের কোনো ঘাটতি ছিল। আমি মনে করে, একাডেমিক ক্ষেত্রে, বাংলা কে ভালোবাসি বলেই, বাংলাদেশকে ভালোবাসিবলেই, নিজেকে বিকশিত করতে হলে, বাংলা-র পাশাপাশি আমাদের ইংরেজি শিক্ষার প্রতিও সমান গুরুত্ব দেয়া উচিত ।

এবার আসি, প্রবাসের কথা। এখানে, কোনো না কোনো অধিবাসী সে নিজে অথবা তাঁর বাবা মা অথবা তাঁর বাবা মা বা তাঁর পূর্ব পুরুষ এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা বা কোননা কোনো মহাদেশ বা দেশ থেকে এসে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করছে । সবাই কোননা কোনোভাবে সেই অর্থে ইমিগ্রান্ট । অথচ, গর্বভরে নিজেকে এঁরা কানাডিয়ান বলতেই বেশি সাচ্ছন্দ বোধ করে । এঁরা নিজেদের কানাডিয়ানবললেও তাদের কথাবার্তায় বিশেষকরে এক/দুইটি জেনারেশনে কিছুটা পূর্ববর্তী দেশের একসেন্ট থাকে । থাকতেই পারে, এটাকে আমি দোষ দেখি না । কিন্তু এখানে জন্মগ্রহণ করা কিছু কিছু মানুষ এমনকি নিজের ছেলে/মেয়ে মাঝে কথার মাঝে যখন বলে ,”এক্সকিউজ মি” ” ক্যান ইউ সে এগেইন প্লিজ ” নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা মনে হয় । একবার , গাড়ির ইঞ্জিন অয়েল চেঞ্জ করার জন্য ডিলারের কাছে গ্যারেজে গেলাম , ব্যাটাকে কিছুতেই অয়েল শব্দটি বুঝতে পাচ্ছি না । অবশেষে, কাগজে লিখে দিতে হলো। ইটা একধরণের ডেস্ক্রিমিনেশন । অনেকে সত্যিকারভাবে যেমন আমাদের কিছু একসেন্ট বুঝতে পারে না, আবার অনেকে ইচ্ছা করেই আমাদের পটেটো, টমেটো উচ্চারণ বুঝেও না বোঝার ভান করে আমাদেরকে উপহাস করে।

আবারো আসি একুশ প্রসঙ্গে । একুশের মধ্যে এক বিশেষ ধরণের দেশপ্রেম লুকিয়ে আছে। আমরা প্রবাসীরা অনেকেই আমাদের নিজ নিজ কাজের জায়গায় যদি ইন্ডিয়ান বা পাকিস্থানী কলিগ পাই তাহলে আমাদের হিন্দি ফ্লিম থেকে শেখানো বিদ্যা জাহির করে উনাদের সঙ্গে অনর্গল হিন্দিতে কথা বলা শুরু করি । এখানেই আমার আপত্তি । এটাকেই কিছুতেই দেশ প্রেম বলা যায়না । উনাদের যদি বলে ” আমি হিন্দি জানি না” উনারা বলে “সে কি তোমাদের দেশের অনেকেইতো হিন্দি জানে এবং হিন্দিতে কথাবলে”। আমি তখন বুক চেতিয়ে বলি ,”তুমি কি বাংলা জানো? হয় ইংরেজিতে কথা বোলো না হয় বাংলা শিখে আমার সাথে কথা বলতে এসো, হিন্দি বা উর্দুতে না। “

যাহোক, মোদ্দাকথা হচ্ছে স্বদেশ প্রেম। আর, ফেব্রুয়ারি মাসে স্বদেশ প্রেম নিয়ে কথা বলা মানেই একুশ নিয়ে কথা বলা। আমার এই লেখা আমার বাংলাদেশের পাঠক ও প্রবাসের পাঠক সবার জন্যই। প্রথমে, বাংলাদেশের পাঠকদের বলবো, ছোটোবেলাথেকেই বাচ্চাদেরকে একাডেমিক পড়ালেখার সময় প্রতিটি একাডেমিক বাংলা শব্দের ইংরেজি টার্ম শিখতে উৎবুদ্ধ করুন না হলে কখনো যদি দেশের বাহিরে স্থায়ী যাবে বসবাসের জন্য যান তবে বাচ্চাদের পোড়ানোর সময় আমার মতো ইন্টারনেট ঘেটে “ল সা গু , গ সা গু , অনু,পরমাণু ” ইত্যাদি শব্দের সঠিক ইংরেজি জানার জন্য ইন্টারনেট ঘাট ঘাটি করতে হবে।

বাংলাদেশে অনেক বাচ্চারাই এখন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছে । বাংলাদেশের তথাকথিত হাই-সোসাইটিতে এবং আমাদের এই প্রবাসেও অনেক মা বাবাদের বলতে শুনেছি “আমার বাচ্চারা বাংলা লিখতে বা পড়া তো দূরের কথা বলতেই পারেনা” । এবং , এটা বলার মধ্যে দিয়ে আমরা এক ধরণের মিথ্যা গর্ববোধ করি। এক্ষেত্রে আমার আপত্তি । আমার বাচ্চাদের সঠিক বাংলা না জানাটা লজ্জা ছাড়া কখনোই অহংকার হতে পারেনা ।

ভালোকরে , খেয়াল করবেন, আমি আমার লেখায় একদিকে এমন বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি শিখতে অনুপ্রাণিত করছি, আবার সেই আমিই আবার, ইংৰেজির পাশাপাশি বাংলা শেখার জন্য উৎসাহ দিচ্ছি । এটাকে সুক্ষভাবে বোঝার ব্যাপার আছে। আমি যদি আমার দেশ বাংলাদেশকে ভালোবাসি, অন্য জাতির কাছে আমাদের ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরতে চাই আমাকে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে সঠিক ইংরেজিতে । আমাকে যদি , প্রবাসে মাথাতুলে ভালোভাবে চলতে হয় এখানে অফিস /কাজের জায়গায় সর্বত্র সঠিক ভাবে ইংরেজি তে কথা বলতে হবে । এদেরমতো করে হয়তো একেবারেই হবে না তবে চেষ্টা করতে হবে । এতে করে , আমাদেরই মর্যদা বৃদ্ধি পাবে । আবার ওপর দিকে , তথাকথিত হাই সোসাইটির অথবা প্রবাসী মা/বাবাকে বলবো বাচ্চারা স্কুলে বা বন্ধুদের সাথে যথেষ্ট সময় পায় ইংরেজিতে কথা বলার, ওরা যতক্ষণ আমাদের সাথে থাকবে, বাসায় থাকবে, আমরা যেন তাদের সাথে বাংলায় কথা বলি ।

আমাদের যুদ্ধ বাংলা বনাম ইংরেজি নহে আমাদের যুদ্ধ সকল অপসংস্কৃতির বিপক্ষে
আমার কাছে, এই হচ্ছে একুশের শিক্ষা।

(সৌজন্য:-google)
পূর্ববর্তী নিবন্ধচলে যায় এইসব দিনরাত্রিঃ
পরবর্তী নিবন্ধসমাজ বিভ্রাট***
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন