আমরা বাঙালী ,নিজেকে নিয়ে গর্ব করি , আমরা বীরের জাতী।
কিন্তু স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও এই দেশের মাটিতে এমন মানুষও আছে যারা স্বাধীনতা যুদ্ধকে স্বীকার করেনা। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকে “গন্ডগোল ” এর সময় বলে ডাকে ।
ভাবতে অবাক লাগে এই দেশের মাটিতে এমন মানুষও আছে যারা আজ পাকিস্তানকে মনে প্রাণে ভালোবাসে। তাইতো আজও দেখতে পাই ক্রিকেট খেলার গ্যালারিতে দাড়িয়ে পাকিস্তান বনাম বাংলাদেশের খেলাতে অনেক বঙ্গ ললনা শাহীদ আফ্রিদির শয্যাসঙ্গীনি হতে কাকুতি মিনতি করে । তখন প্রশ্ন জাগে “এরাই কি পাকিস্তানী সেনাদের রেখে যাওয়া সেই সাচ্চা পাকিস্তানী “?
মাঝে মাঝে নিজের প্রতি ঘৄনা হয় এই ভেবে আজ ওদের সাথে নিজের “জাতীয় পরিচয় ” ভাগ করে নিতে হচ্ছে। আজকাল বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে অনেককে বলতে শুনি “আমি পাকিস্তানিদের পক্ষে ছিলাম , আমরা আসল দেশপ্রেমিক ছিলাম কারন তখন আমাদের দেশ ছিলো পাকস্তান।। ” তখন মনে হয় টুটি চেপে ধরে বলি “তুই রাজাকার “। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নেই , সমাজিকতার ভয়ে।
যতটুকু ঘৄনা করি পাকিস্তানি হানাদারদের তার চাইতেও বেশি ঘৄনা করি এইসব পাকিস্তানিদের রেখে যাওয়া ” সাচ্চা পাকিস্তনীদের “, এরাই তারা যাদের পরিবার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় খান সেনাদের কোলে বসে “মনোরঞ্জনের ” জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিল ।
তিন লক্ষ নাকি তিরিশ লক্ষ – আজ আমরা শহীদের এই সংখ্যা নিয়ে মারামারি করছি, আর সেইসব পাকিস্তানীর বংশধররা এই সুযোগে নিজেদের জায়গাটাকে আরো পাকা করে নিচ্ছে। দুর্ভাগ্য সেই সব শহীদের রক্তের – যার মূল্যায়ন আমরা আজও করতে পারলাম না। শহীদরাতো মরার সময় এইটা চিন্তা করেনি যে তিন লক্ষ বা তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের প্রয়োজন ” মুক্তির ” জন্য। তারা শুধু এইটাই জানতো যে স্বাধীনতার জন্য রক্তোর প্রয়োজন। যে রক্তের কোনো গ্রুপ নাই – হোক না সে কৃষক, মজুর , ছাত্র বা সৈনিকের রক্ত।
১৯৭১ সালের মার্চের শেষ বা এপ্রিলের প্রথম দিকের কোনো একটি দিন। দিন বা তারিখ এতো বছর পরে আজ আর মনে নাই। ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম। অনেক রাতে মা আমাদের সব ভাই বোনদের ডেকে তুললেন। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারিনি , মা বললেন ” আজ রাতেই আমাদের এখন থেকে পালতে হবে”। কোথায় যাচ্ছি জানিনা, মা কিছুই বললেন না । মার হাত ধরে বেরিয়ে পড়লাম, হাটতে হাটতে পৌঁছে গেলাম নদীর পাড়ে। চারিদিকে অন্ধকার। বাবা দাড়িয়ে আছেন একটা নৌকার কাছে। আমরা নৌকায় উঠলাম কিন্তু বাবা উঠলেন না। বললেন ” আমি আসতে পারবো না , তোমরা পালিয়ে যাও, বাঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।” শুরু হলো ৯ মাসের ভাসমান জীবন। এক এক সময় এক এক জায়গায় , আজকে শহরে কাল হয়তো অন্য গ্রামে। কোথাও দীর্ঘ দিন থাকতি পারিনি। দিনের পর দিন পালিয়ে বাড়িয়েছি।
৯ মাস “বাবা” বলে ডাকার কেউ ছিলোনা। লোকমুখে শুনেছিলাম আমার বাবাকে পাকসেনারা মেরে ফেলেছে। তার অপরাধ মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেয়া। অনেকে তার লাশও নদীতে ভাসতে দেখেছে। অনেক দিন মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে , শুনতাম মা লুকিয়ে লুকয়ে কাদছে। মা লুকিয়ে কাঁদতো তার কারণ, না হলে সবাই বাবার কথা জানতে পারবে। তখন হয়তো এখান হয়তোএখান থেকেও পালিয়ে যেতে হবে । অনেকদিন পর জানতে পেরেছিলাম আমাদের রেখে আসা আমার মায়ের ২৫ বছরের সংসারের সব কিছু পাকিস্তানী সেনারা বাড়ী সহ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।
আমিতো মুক্তিযুদ্ধ করেনি , আমার তো তখন যুদ্ধে যাবারও বয়স হয়েছিল না। কিন্তু আমিতো হারিয়েছি অনেক । ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ আমার কাছ থেকে অনেক কিছুই কেড়ে কাছে। আপনারা আমাকে কোন দলে দাঁড় করাবেন ?
আজ যারা স্বাধীনাতর পক্ষ আর বিপক্ষ নিয়ে লড়াই করছেন , তাদের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন “আমি কোন দলের” ? উত্তর চাই।
“এই দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নয় – রাজাকারের তালিকা চাই।“