ফ্লোরিডা থেকে:-
নদী নামের আমার যে হাঙর তাকে আমি পড়াতাম। গরীব ভালো ছাত্রের সবচেয়ে কমন কাজ ছাত্র ছাত্রী পড়ানো । আমার সমান ক্লাশের , ততদিনে পড়ানো শেষ , মেট্রিক পরীক্ষা দেয়া হয়ে গেছে । তারপরে ওর কাছে ফাঁক পেলেই যেতাম। কারণ ছিলনা , অকারণেই যেতাম। ওই বয়সে অকারণে কোন মেয়ের কাছে যাওয়াটা ছিল অসুস্থতার লক্ষণ। আমি অসুস্থ ছিলাম। আর আকবর বাদশা আমার ঘনিষ্ট বন্ধু , সে দূরে থাকে কি করে ? নিজের বান্ধবীকে নিজের বন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে সেই সব দিনে কিছু জটিলতা হত ,বিশেষ করে সেই বন্ধুর যদি কোন জটিল রোগের জন্য অনেক ঔষধ খেতে হয় এবং সেই ঔষধের সাইড এফেক্ট হয় পাগলামী। ভালো ছাত্র হওয়া মানে এই নয় যে এই সামান্য কমন সেন্সটুকুও থাকবেনা। আসলে মানুষের কমন সেন্স হয় আছে ,নয় নেই , এর মাঝামাঝি কোন অবস্থান হয়না। এবং সংসারে কমন সেন্স নেই এমন মানুষই সংখ্যা গরিষ্ঠ।
অনেক পরে জেনেছিলাম আকবর বাদশা ঐ বাসায় খুব ঘন ঘন যেত ,বিরক্ত করতো, বিশেষ করে আমি যখন শহর ছেড়ে গিয়েছি এবং একটি বিশাল রিখ্টারের ভূমিকম্প আমার মনে আকবর বাদশার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছিল।
আমার পরিবারে ধর্ম কর্মের জবরদস্তি ছিলনা। আমার স্বশিক্ষিত অশিক্ষিত বাবা নামাজ রোজা করতেন কিন্তু আমাদের পড়াশুনো করে মানুষ হওয়ার ওপরে বেশী জোর দিতেন। সংখ্যা গরিষ্ঠের বিপরীতে শিক্ষার আলো পেয়ে সেই আলোয় অন্যকে আলোকিত ও সাহায্য করে বেহেশতে যাওয়ায় বেশী বিশ্বাস করতেন । ঈশ্বরের পরে যার স্থান ছিল দ্বিতীয় এই পৃথিবীতে, সে ছিল তার “মা” । তিনি নিজে মাকে অন্ধের মত ভালোবাসতেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এবং আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়েছেন।
তার কাছে তৃতীয় ছিল “কাছের মানুষ”। পরিবার এবং প্রতিবেশী হচ্ছে কাছের মানুষ।
“বাপ, তোর প্রতিবেশী যদি না খেয়ে থাকে তোর হজ্জ্ব কবুল হবেনা।”
এই ছিল পিতার ধর্মশিক্ষা । আনপ্র্যাকটিকাল এবং আধুনিকতার ছোয়া হীন । অশিক্ষিত মানুষ , এর বেশী ধর্ম তার জানাও ছিলনা , প্রয়োজন ও ছিলনা।
আকবর বাদশার সাথে টই টই করে মানুষের সেবা করে একদিন যথারীতি ওর বাসায় গিয়েছিলাম। ওর মা আমাকে হাত বুলিয়ে বলেছিল ,”বাবা, আমার ছেলেটা পাগল, কিন্তু মনটা খুব ভালো, তুমি ওকে একটু বুঝিও যেন পাগলামীটা ছাড়ে।”
মা যখন আমার সাথে কথা বলছিল, আকবর বাদশা ঘরের ভেতরে মায়ের টাকার থলি খুঁজছিল, না পেয়ে এগিয়ে এসে মায়ের কাছে টাকা চাইল। মা টাকা দিতে অস্বীকার করল, “তুই খালি টাকা নিয়ে অপচয় করিস, আমার কাছে টাকা নেই, আমি টাকা দিতে পারবো না”
আকবর বাদশা ঠাস করে মায়ের গালে এমন একটি চড় বসিয়ে দিল যে , সেই বৃদ্ধা , লিকলিকে মহিলা, আমার পিতার আল্লাহর পরে যার স্থান , মেঝেতে পড়ে যেতে শুরু করলো। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে পতন থেকে ঠেকাতে সক্ষম হলাম।
আমার অন্ধ চক্ষু হাট করে খুলে গেল।
আমি জীবনে বহু ভুল করেছি । আমি আমার ভালোবাসার মেয়েটির পেছনে ঘুর ঘুর করেছি কিন্তু মুখ ফুটে বলতে ভুলে গেছি যে আমি তাকে ভালোবাসি। আমি টমাস মুর, সান সিঁমো, রবার্ট ওয়েন, কাম্পানেল্লার সমাজতন্ত্রকে ইওটোপিয়া বলেছি অথচ স্ট্যালিনের সমাজতন্ত্রে আপাদ মস্তক নিমজ্জিত হয়ে রয়েছি।
”মানুষ মেরে মানুষের মুক্তির শ্লোগান” যে মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় ধাপ্পা তা বুঝতে বুঝতে ভুল করেছি। কিন্তু সেই দিন আমি নির্ভুল ভাবে আকবর বাদশার বাড়ী থেকে বের হয়ে এসেছিলাম, আর ফিরে যাইনি ।
এই ঘটনার পর পরই ৮০ দশকের প্রথম দিকে আমি ঢাকায় পড়াশুনো করতে চলে গেলাম। সবচেয়ে সেরা কলেজে নাম লিখিয়ে পড়াশুনো করতে লাগলাম ঢাকার রাজপথে। মিছিল মিটিং ,শ্লোগান , “ভিভা মার্কসবাদ লেনিনবাদ , আর সব মুর্দাবাদ।” এই চিৎকারে ঢাকা শহরের সবগুলো কাক, চিল আর বাদুর তাড়াতে ব্যস্ত হয়ে রইলাম।
চলবে
শাহাব আহমেদ