ফ্লোরিডা থেকে:-

এক সবে বরাতের রাতে সে এবং আমাদের তৎকালীন গ্যাংটি ঝটিকা সিদ্ধান্ত নিল সারারাত বাস জার্নি করা হবে । আমি তখনও ঘরের বাইরে রাত্রি যাপন করার সাহস বা প্রিভিলেজ অর্জন করিনি। ভালো ছাত্ররা এমনিতেই অকর্মণ্য হয়। দেখা গেল বাস আসতেই তারা একে একে বাঁদরের মত হুট হাট বাসের ছাদে চড়ে গেল এবং আমাকে ডাকতে লাগলো হৈ হৈ করে। বাস চলতে শুরু করেছে, চলন্ত তো দূরের কথা থামা বাসের ছাদেও চড়িনি কখনও , কিন্ত জন তিনেক বাদুর ঝোলা হয়ে আমাকে রীতিমত টেনেই তুলে নিল বানর শাবকের মত করে। আমার যুদ্ধ শুরু হলো সেই উপরে টিকে থাকার। আমাদের দেশে বাস এত দ্রুত চলে এই প্রথম টের পেলাম। ছাদ থেকে পড়ে না যাওয়াটাই হল সারভাইভাল সংগ্রাম। গাছ পালা চলে এলে সময় মত শুয়ে পড়ে আঘাত পাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচানো জরুরী । ওদের সবার ক্ষেত্রে যা ছিল “ওয়েল অরকেস্ট্রেটেড” ,আমার কাছে ছিল সাঁতার না জেনে জলে পড়ে যেয়ে টিকে থাকার যুদ্ধ।

ওরা শুয়ে বসে স্বাভাবিক হৈ হুল্লোড় করছে, আর আমি ততক্ষণে এক স্যান্ডেল পায়ে । অন্যটি বাসের ছাদে চড়ার বিড়ম্বনা সইতে না পেরে উড়ে চলে গেছে কোথায়। তখন আকবর বাদশা চলন্ত বাসের ছাদে দাঁড়িয়ে অবশিষ্ট সবে ধন নীলমনি স্যান্ডেল টিকে অনেক জোরে ছুড়ে ফেলে আদেশ দিল অন্যটিকে খুঁজে নিয়ে আসতে ।
তখন নারায়নগন্জের বাস মিরপুর পর্যন্ত যেত, আমরা মিরপুরে পৌঁছে রাস্তায় কিছুক্ষণ একসাথে মহা হৈ হৈ করলাম । আকাশে চাঁদ আর তারারা চোখ টিপাটিপি করছিল, পাগলা হাওয়া প্রতিযোগিতা করে নাকমুখ দিয়ে ঢুকছিল । হাঙর বা নদী সে যাই হোক সেই মেয়ে বুকের গহীন ও নিঝুম কোন গোরস্থানে গোর খুদছিল। আমি তার জন্য কি এক অন্তহীন তীব্রতা অনুভব করছিলাম । বন্ধুদের সাথে থেকেও সেই রাতে আমি ছিলাম হৃদয়ে দলছুট উটের মত ভীষন ভাবে। এই রিস্কি ও অর্বাচীন স্বাধীনতার মাঠে হঠাৎ শবেবরাতের রাতের অলৌকিক ঘটনা ঘটল , আকবর বাদশা মিনিট বিশেক আগে তার জটিল রোগের যে ঔষধ গিলেছিল, তা কাজ করতে শুরু করলো এবং অপ্রত্যাশিত ভাবেই একটা বাস এগিয়ে আসতেই পুরো গ্যংটা আবার টপাটপ ছাদে উঠে গেল । একদল ওয়েল কোঅর্ডিনেটেড বানর ,আমার শৈশব অরণ্যের ।
আমি উঠতে পারলামনা। ওরা আমার কথা ভুলে গেল,
না আমাকে ইগনোর করলো বুঝে ওঠার আগেই বাস চলে গেল।
শবে বরাতের রাতের রাস্তা। তুলনামূলক ভাবে ফাঁকা । রাস্তা ধরে হাঁটছি । পায়ে স্যান্ডেল নেই, পকেটে নেই টাকা, ততক্ষণে মরার পরে খাড়ার ঘায়ের মত পেটের ভিতরে একটা তিমি নড়া চড়া করতে শুরু করেছে। আমার মাথায় তখন মিরপুরের চিড়িয়াখানা , যেখানে সব চিড়িয়াই তাদের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে । ঐ প্রানীগুলোর স্বাধীন , স্বাভাবিক ও বুনো অতীতের মতই আমার শহর, আমার ভালোবাসার নদী অনেক দূরে ।

স্যান্ডেল জোড়া নতুন ছিল। বাড়ীতে কি বলবো?
মসজিদে চুরি হয়ে গেছে?
আল্লাহ শবে বরাতের রাতে কত মহান , অন্য রাত গুলোও তারই তৈরী অথচ এই রাতটি ……?

আকবর বাদশা ,তোমাকে পেলে সেই রাতে আল্লার মত অত মহত্ত আমি দেখাতে পারতাম না । হয়তো শেষ পর্যন্ত তোমার হাতেই মার খেতাম কিন্তু আমি ঠিকই বুঝিয়ে দিতাম তুমি কাজটা অন্যায় করেছিলে।

চলবে
শাহাব আহমেদ

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন