দিবা নামের একটা মেয়ের কাছে সে প্রায়ই যেত । মুডি ও মেঘের মত থম থমে কখনও কখনও, আবার শূন্য মাঠের উছল হাওয়ার মত অতি বেশী ছটফটে , হাসি ,খুশী , বাচাল । কোনদিন কোন রূপ তার কেবল গেলেই জানা যেত।
সাদা ফকফকে রাজহাঁসের মত ছিল সে। চেহারাটি সুন্দর তবে খুব খাটো। আর একটু লম্বা হলেই পারতো , অন্তত চাঁদ দেখতে পেতো সহজে । যাক গে , বড় লোকের বখাটে মেয়ে আমার কি আসে যায় ?
চারতলার ওপরে একটা সুন্দর ফিটফাট সাজানো এপার্টমেন্টে সে থাকতো। বাবা মা বাড়ীতে থাকতো কিনা মনে পড়েনা। কাউকে দেখিওনি। সম্ভবত তারা ব্যবসা বা ভ্রমণ নিয়ে ব্যস্ত থাকতো । অথবা …
কে জানে ?
ঘরে হয়তো দাসী বাদী থাকতো। সে ছিল অনেকটা নিশি পাওয়ার মতই, প্রায়ই নি:সঙ্গ ও বিষন্ন এবং আমার বন্ধু যেত ওকে সঙ্গ দিতে ।
আমি বলতাম ,”যাও কেন?”
“আমরা কি মানুষের সেবা করার প্রতিশ্রুতি দেইনি? এই মেয়ের আমাদের সাহায্যের দরকার, নইলে সে মরে যাবে।”
সুন্দর মেয়েদের মরে যেতে দিতে নেই। ওই মেয়ে যাতে আত্মহত্যা না করে আমরা তাকে তাই পাহাড়া দিতাম , অন্তত আকবর বাদশা তাই আমাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল। প্রকৃত পক্ষে আমার কাজ সামান্যই, ওর সাথে যাওয়া আর দিবার বিষন্ন চোখ ভেদ করে জানালা ও ব্যালকনি দিয়ে সুন্দর সুর্যাস্ত দেখা ছাড়া । এত উঁচু বিল্ডিং থেকে সুর্যাস্ত দেখার সৌভাগ্য সবার সব সময় হয়না।
প্রায়শই ওরা নীচু গলায় টুকটাক কথা বলতো। প্রেম ট্রেম মনে হয়নি, তাহলে ওর আমাকে না নিয়ে যাবারই কথা । নিরিবিলিতে ভালোবাসার কথা বলা সহজ এবং বন্ধুও ফুল নয় যে সাথে করে প্রেমিকার কাছে যেতে হবে।
পেটে ক্ষুধা না থাকলে বা শরীরে কোথাও ব্যথা না করলে মানুষের আর কি কস্ট থাকতে পারে আমি জানতামনা । ওর অভাবটা কি ছিল তাও ধারণার বাইরে, তবে ক্ষুধা বা ব্যথা যে নয় তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। অবশ্য কিভাবে তা এখন আর মনে নেই । মানুষের অপ্রাপ্তিজনিত কষ্ট গুলো মিটে গেলে অতিপ্রাপ্তি জনিত কিছু ক্ষুধামান্দ্য রোগ হয়, যাকে বলা হয় ডিপ্রেশন। আমাদের ভাষায় এই রোগটির সঠিক কোন নাম নেই , রোগটি আমাদের দেশে নুতন। মনের কোন মানচিত্র নেই , তা বলে মন যে একটা যুদ্ধক্ষেত্র হতে পারে তা গরীব দেশের মানুষ কি করে জানবে ? বিশেষ করে সেই সব প্রাগৈতিহাসিক প্রিমিটিভ যুগে , যখন ভাত কাপড়ের অভাবে ছিল দেশের প্রায় দুই তৃতিয়াংশ মানুষ ।
খাটো কিন্তু সুন্দর সেই মেয়েটি আমাকে পছন্দ করত । না করার কারণ নেই , সব সত্ত্বেও আমি ছিলাম ওর বন্ধুর বন্ধু এবং শহরে আমার মেধাবী ছাত্র হিসেবেও নাম ছিল । তখনও ব্যক্তিকে ব্যক্তি হিসেবেই চেনা যেত এবং সেই ব্যক্তি হবার অনুভূতিটা ছিল সংখ্যা হবার অনুভূতির চেয়ে বেশ ভিন্ন।
আমি ব্যক্তি ছিলাম ।
চলবে