ফ্লোরিডা থেকে:-

প্রথম পর্বের পর
ওর একটা সাইকেল ছিল । প্রতিটি সাইকেলের চাকায়ই অনেক ইতিহাস ইমপ্রিন্টেড হয়ে থাকে। ওরটিতেও ছিল আমাদের একসাথে অতিক্রান্ত অনেক পথের গল্প।
ও সাইকেল চালায় ,আমি পেছনে বসে শহর ঘুরে বেড়াই , শহরের বাইরে যাই । ওর ছিল অসুরের শক্তি ,আমি লিকলিকে বাতাসের আগায়। ওর সাইকেলের পেছনে চড়ে এই প্রথম আমি আমাদের শহর ও শহরের বাইরে বিস্তীর্ণ এলাকা দেখার সুযোগ পাই। একবার সে আমাকে নিয়ে যায় পরিচিত জগতের বাইরে ফতুল্লা ছাড়িয়ে কত দূরে! দুইপাশে বিস্তীর্ণ ধানের ক্ষেতের বুক চিরে চলে গেছে মাটির সড়ক , সেই সড়ক তারপরে বুক ছুয়েছে কোথাকার কোন মাতুয়াইল গ্রামের । সেখানে ছিল অনেক গাছপালায় ঢাকা এক বিশাল পুকুরওয়ালা বাড়ী। ওর বন্ধুর বাড়ী । আমরা সেখানে ওর বন্ধুর সাথে কাটিয়েছি এক চমৎকার দিন। মাছ ধরেছি পুকুরে , তারপরে সেই বন্ধুর মায়ের মধু হাতের রান্নায় পেট পুরে আবার রওনা দিয়েছি দীর্ঘ পথ। সাইকেলের ঝাঁকুনির শব্দগুলো মিলিয়ে যাচ্ছিল বিস্তীর্ণ মাঠে কোনরকমের প্রতিধ্বনি না তুলে। ও বক বক করে বলছিল কত কথা ,কত দর্শন ও অদর্শন, শ্রেনী সংগ্রাম ও শোষন মুক্তি, কান্টের বিগ্ ব্যাং ইত্যাদি ইত্যাদি। গল্প গুলোর গভীরতার চেয়ে প্রশ্বস্থতা ছিল বেশী , আমি নিশ্চয়ই তার গল্পে অংশগ্রহন করেছিলাম , তা নইলে সেই গল্প থেমে যাবার কথা ছিল, কিন্তু স্পস্ট মনে আছে গল্প ছিল নদীর মত বহতা ও বাঁকময় । আমার চোখ ধান ক্ষেতের দিকে, পাকা ধানের ছড়া গুলো বাঁকা হয়ে মাথা নীচু করে আছে, মৃদু বাতাস দুলিয়ে যাচ্ছে তাদের দেহ। বাদামী ও সুন্দর । আর আকাশে ছুটছে মেঘ ছোট , বড় ত্বরাহীন যুবতী মেঘ।

একজন মানুষের জীবনের পরিমাপ হয় দশকে । কিন্তু দেশের জীবনের পরিমাপ হয় শতক ও সহস্র বছরে । দেশ হল মাটি, এর জনগোস্ঠী, ইতিহাস, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্র হল দেশকে শাসনকারী একটি সংগঠন, যাকে এক কথায় চিহ্নিত করা যায় “ক্ষমতা” বলে। দেশ কখনও কখনও এর স্বাধীন সত্ত্বা হারায়, কখনও কখনও ঘৃন্য শত্রু ক্ষমতা দখল করে বসে। তারপর এই ঘৃন্য শত্রু-দানব নিজেকে দেশ বলে চালিয়ে দিতে চায়। তাকে সমালোচনা করলে সে সমালোচককে দেশদ্রোহী বা দেশের শত্রু বলে চিহ্নিত করে। তাই একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিকের পরিচয়টিও কখনও কখনও অজ্ঞাত রয়ে যেতে পারে। ক্ষমতা ও দেশপ্রেম একসাথে কথা কয় খুবই কম। কবি ওভিদ ছিল অগাস্টাসের দেশের শত্রু, মেন্ডেলস্টাম ও প্যাস্টেরনাক স্ট্যালিনের।

আমাকে যদি একহাজার বছর পরে জাগিয়ে দিয়ে চোখের সামনে পৃথিবীর মানচিত্র তুলে ধরা হয় আমি কি দেখতে চাইবো ?
আমার দেশ ?
আমার রাস্ট্র ?
রাস্ট্র মানে রাজনীতি , শত্রু , মিত্র , শ্রেনী, শোষক, শাসিত ,হিন্দু ,মুসলমান কত কিছু। রাস্ট্রের কোন অনুভূতি নেই ।
অথচ দেশ ? দেশ একটা পবিত্র অনুভূতি , কোমলতার কিংখাবে ঢাকা। আর কিচ্ছু নয়।

আমি খুঁজবো বাংলাদেশ নামের ভূখন্ডটি মৃতের থেকে জেগে উঠে ,কে তার ক্ষমতায় এক বিন্দুও ভাববোনা ।
তুমি প্রেমের কথা বলো ? এই হলো আমার প্রেম।

সের্গেই ইয়েসিনিনের “আন্না স্নেগিনা” কবিতাটিতে কি আছে ? আন্না স্নেগিনা ছিল স্থানীয় জমিদার কন্যা। কবিতার যে নায়ক, একজন কবি, ভালোবাসতো আন্নাকে। দেশে বিপ্লব সাধিত হয়েছে ,সে বিপ্লবের পক্ষে । এবং যেহেতু আন্না জমিদার কন্যা সে শ্রেনী শত্রু। তাই অন্যান্য অনেকের মতই সর্বস্ব ফেলে তাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। যেই দেশে তার আবহমান কালের শিকড় সেই শিকড় গুলো উৎপাটন করা হয় জবরদস্তির এস্কাভেটরে। যে শত্রু, তার দু:খ দু:খ নয়, তার কষ্ট কষ্ট নয়। তাকে গৃহহীন করার নাম বীরত্ব। আবহমান মানব সভ্যতার তাই হল ‘কোড অব এথিকস’।
ততদিনে গৃহযুদ্ধ শেষ হয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন দৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড়িয়েছে। এখন সোভিয়েত জাহাজ চলাচল করে আন্তর্জাতিক নৌপথে । অথচ আন্না ভুলতে পারেনি তার মাতৃভূমির কথা, রিয়াজানের মাঠ, গাছ , পাখীদের কথা। সে ছুটে ছুটে যায় পোর্টে যেখানে সোভিয়েত জাহাজ এসে ভীড়ে । অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মাতৃভূমি থেকে আসা জাহাজের দিকে যেখানে পত পত করে উড়ছে বিপ্লবের লাল পতাকা, যেই বিপ্লব তাকে চিরতরে ছিন্নমূল করে দিয়েছে কিন্তু কেড়ে নিতে পারেনি বুকের গহীনে লালন করা কোমল ও পবিত্র অনুভূতিকে ।

২য় মহাযুদ্ধের সময় যখন হিটলার আক্রমন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন , বিপ্লবের কারণে দেশ থেকে চলে যাওয়া “সাদা অভিভাসীরা” বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসে প্রতিদিন খোঁজ নেয় যুদ্ধের গতিবিধির, মনের অজান্তেই একটিই খবর তাদের উন্মন করে রাখে কি হচ্ছে তাদের ফেলে আসা মাতৃভূমিতে ? একদিকে মানবতার শত্রু হিটলার ,আর অন্যদিকে তাদের দেশ ছাড়া করেছে যে বিপ্লব সেই বিপ্লবের লৌহ মূর্তি স্ট্যালিন ,অথচ তারা সর্বসত্ত্বায় কামনা করে মাতৃভূমির বিজয়। যেই বাংগালীকে দেশ ছাড়া করা হয়েছে তার মনের গহীন গাঙের ঢেউ কেউ কি মেপেছে কোন দিন?

রাস্ট্র নাগরিকের শত্রু বা মিত্র হতে পারে কিন্তু দেশ চিরকালই দেশ , মানুষের আপন অন্তরের অন্তস্থলের পবিত্র সিন্দুকে লুকানো যার সোনার চাবি ।

আমি আকবর বাদশার সাইকেলের পিছনে বসে যা দেখেছিলাম , সেই দেশ, সেই মাটি , সেই অনুভূতি উদ্বেলিত শৈশবের ল্যান্ডশাফ্ট, আমি তার গভীরতার
কিচ্ছু বুঝি নাই ।

রাজনীতি, শ্রেনী, শোষক ,শাসিত, বিপ্লব এত কিছু চিন্তা মাথায় কিলবিল করছিল যে অপরিণতির আতসী কাঁচে স্বপ্ন দেখেছি একটি রাস্ট্র যেখানে মানুষ মানুষকে শোষন করবেনা, প্রতারণা করবেনা, সব মানুষ সুখী হবে, ইওটোপিয়ার এক দিগন্ত বিস্তৃত সাম্রাজ্য হবে এই পৃথিবী!

আই , আই, আই ।
চলবে

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন