যায় দিন ভালো যায়। এটা কি কথার কথা? নাকি সত্য কথা? বাংলাদেশে থাকতে মুরুব্বীদের আফসোস করতে শুনেছি। তাঁদের আগেকার সময়গুলো কতটা ভালো ছিল! সুজলা, সুফলা দেশ। পুকুরে মাছ। নদীতে মাছ। খোলা মাঠে ছোটাছুটি। এখনকার সময়ে এসবের কত অভাব। ছেলে মেয়েরা খেলার মাঠ পায় না। আধুনিক সব ডিভাইস-ই এখন তাদের মাঠ। সারাদিন সেখানে ছোটাছুটি করে।
মনে মনে পরিবর্তন আশা করলাম। বিদেশে পাড়ি দিলাম। প্রথমে কানাডা। ল্যান্ডিং করে চলে গেলাম লাইবেরিয়া। পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ। বাবার সাথে কথা হলেই ফোন করে বলতেন, বাবা তুমি কানাডায়-ই থাকতা। লাইবেরিয়া গেলে কেন? সেখানে বিদ্যুত থাকে না। নিরাপদ পানির অভাব। নিরাপত্তার অভাব। গরীব দেশ। ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমি বলতাম, বাবা আমাদের এখানে কোন অসুবিধা নাই। চব্বিশ ঘন্টা নিরাপত্তা প্রহরী। জেনারেটরে ২৪ ঘন্টা বিদ্যুত। ফিল্টার করা পানি। নদী থেকে তোলা তরতাজা মাছ। আমাদের দেশের মত দেশী মোরগ/মুরগী। বাজারে তরতাজা সব্জি। বাসার পাশে আটলান্টিক মহাসাগর। বিকেল বেলা সমুদ্রের পাড় ধরে ঘোরাঘুরি। আমাদের এখানে কোন অসুবিধা নাই। তারপরও মনে মনে বলতাম, মাত্রতো দুই বছর। চাকুরি শেষে চলে যাব আবার কানাডা। চুক্তি নবায়নের দরকার নাই। যাহোক ‘ইবোলা’র প্রাদুর্ভাবে একবছর পর চলে এলাম। আবার যাওয়ার কথা থাকলেও কানাডা থেকেই চাকুরির ইস্তফা দিলাম।
কানাডায় প্রবাস জীবন শুরু করলাম। এখন আমি আর আমার বউ মাঝে মধ্যে লাইবেরিয়ার কথা ভাবি। কত মজার ছিল সেই দিনগুলি। নদীর টাটকা মাছ। দেশী মুরগি। সমুদ্রের হাওয়া। আহা! সেই দিনগুলি। বাংলাদেশের ফেলা আসা দিনগুলোর কথাতো সারাক্ষণই মনে থাকে। বৃষ্টি থেকে শুরু করে গরম। ট্রাফিক জ্যাম থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অস্থিরতা। যেসব কারণগুলো অনেকের বিদেশে পাড়ি জমানোর কারণ। এখন সেসময়কার কথা ভেবে মনে হয় “আগে কী সুন্দর দিন কাটাতাম”। আহা কতদিন সেই টিনের চালে শব্দ করা বৃষ্টির আওয়াজ শুনি না। ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ। কানাডায় কনকনে শীতের দিন আসলে মনে হয়, কোনটা ভালো: গরম দেশ? না শীতের দেশ? প্রবাসীদের কাউকে কাউকে ট্রাফিক জ্যাম আর বাংলাদেশের রাজনীতি মিস করতে শুনি। জ্যামের মধ্যে রিক্সায় বসে হাওয়া খাওয়া। উত্তেজনাকর ও নাটকীয় সব দেশি রাজনীতির খবরা-খবর অনেক প্রবাসীর নিত্যদিনের চাওয়া।
চাকুরির সুবাদে এক সময় দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতাম। প্রতি বছর গড়ে ৬/৭ বার অন্য দেশে যেতাম। এক সময় দেশের ঘোরাঘুরিতে বিরক্ত লাগা শুরু হলো। বিদেশ ভ্রমণে ক্লান্তি আসত। মনে হতো পরিবর্তন দরকার। আর ভালো লাগে না। এখন মনে হয়ে, কত আনন্দের ছিল সেই দিনগুলো! দেশের প্রায় সবগুলো জেলায় গিয়েছি। নতুন নতুন দেশ দেখা হতো। হয়তবা আরো কত জায়গায় যেতে পারতাম।
কানাডার এক প্রশিক্ষণে সিরিয়ান এক ব্যক্তির সাথে পরিচয় হয়েছিল। তিনি আমার কাছে দুঃখ করেছিলেন। বলেছিলেন তাঁর ফেলে আসা দিনগুলির কথা। কত আনন্দের ছিল সেই দিনগুলি। কানাডায় এসে তাঁর অনেক কষ্ট হচ্ছে। সিরিয়ায় তাঁর বাড়ি, গাড়ি, সম্পদ সবই ছিল। যুদ্ধের মধ্যে মানুষ ভালো থাকে কিভাবে? ভেবিছিলাম প্রশ্নটা করি। সাহস হয়নি।
আসলে কি যায় দিন ভালো যায়? না কি আমরা নস্টালজিক হই? বর্তমান সময়টা যখন অতীত হবে তখন কি আবার বলব আহারে আগের দিনগুলো কত ভালো ছিল। কোনটা করা উচিত: অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করা? না কি বর্তমান কে অর্থবহ করা?
এস এম জাকির হোসেন
টরন্টো, সেপ্টেম্বর ১, ২০১৯।