শেষ কবে দেশে ঈদ করেছিলাম মনে নেই, ছয়-সাত বছর হবে। প্রথম যখন বিদেশে ঈদের নামাজের পর ইমাম সাহেবের সঙ্গে কোলাকুলি করে বলেছিলাম “জীবনে প্রথম ঈদের নামাজের ঈমাম সাহেবের সঙ্গে কোলাকুলি করলাম” – তিনি হেসেছিলেন।
দেশে ঈদগাহর পেছনে বসলে ঈমাম সাহেবকে চেনা যেতো না ভালো করে, একমাঠ সারি সারি মানুষ – যেন ধনী-গরীব সব ভুলে এক হয়ে যেত কিছুক্ষনের জন্য। কতদিন দৌড়ে গিয়ে নামাজ ধরেছি। দূর থেকে মাইকে শুনতে পেতাম – আল্লাহু আকবার, লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ। ঈদগায় পৌঁছে চটের ওপর অথবা ঘাসের ওপর পরিস্কার বিছানার চাদর ভাজ করে বিছাতাম – ভাইয়েরা সবাই আব্বার পাশে লাইন দিয়ে বসে যেতাম। চারদিকে আতরের গন্ধ পেতাম। অপেক্ষা করতাম কখন নামাজ শেষ হবে – বাসায় গিয়ে শুরু হবে আনন্দের সেই দিন, খুতবা লম্বা হলে উশখুশ করতাম। তেমন আনন্দ প্রবাসে নেই। বাবা-মা, ভাই-বোন ছেড়ে সেই ঈদ আনন্দ পাওয়ার কোনো কারনও নেই। আর যারা স্ত্রী-ছেলেমেয়ে দেশে রেখে এসেছেন, সকালে হয়তো দুফোঁটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে দেশে ফোনে কথা বলতে বলতে। এখানে আমাদের ছেলেমেয়েরা ঈদ বিষয়টা ঠিক উপলব্ধি করতে পারে না, আমরা যেমন অনুভব করতাম যেন ঈদের দিনটার একটা গন্ধ ছিল, রঙ ছিল। সন্ধ্যা হয়ে গেলে মন খারাপ হয়ে যেত – আরেকটা ঈদের জন্য অপেক্ষার শুরু। আমাদের ছেলেমেয়েদের সব আনন্দ যেনো টেলিভিশন, গেমস আর কম্পুটার গিলে খেয়ে ফেলেছে। বাবা হিসাবে এটা আমার কন্য কষ্টের। এ বিষয়ে পরে একদিন বলব, আজ ঈদের কথা বলি।
এখানে সারাদিন ব্যাস্ত কাটে এবাড়ি সেবাড়ি ঘুরেঘুরে। কোলাকুলি আর খাওয়া দাওয়া, আড্ডা দেওয়া, দেশে ফোনে কথা বলা, স্ত্রীর কান্নাভেজা গলায় দেশে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলতে শোনা। এই তো। অনেকে ছুটি না পেলে কাজ করেন। তবে এখানে ঈদের দিনে মানুষের কষ্ট দেখতে হয় না। দেখতে হয় না আমার মেয়ের বয়েসী আট-নয় বছরের মেয়েটিকে, যে ঈদের মাঠের পাশে হাত বাড়িয়ে বসে থাকত। দেখতে হয় না আমার ছেলের বয়েসী দশ বছরের ছেলেটাকে, যে মায়ের জন্য ঈদের শাড়ি কিনতে ঈদের আগে বখশিসের জন্য মিনতি করতো, যে ইফতারের পর চায়ের দোকানে চা নিয়ে ছুটাছুটি করতো।
প্রবাস জীবনে এই যে কষ্ট, সামর্থ্য থাকতেও আমার ছেলেমেয়েদের বয়েসী শিশু-কিশোর-কিশোরীদের জন্য করতে পারি না। হয়তো পারি, তা খুবই সামান্য। দেশে পরিবারের কাছে পাঠানো টাকা থেকে অথবা আত্মীয় আর বন্ধুদের কিছু টাকা পাঠিয়ে মেয়েটাকে একটা ফুটফুটে জামা কিনে দিতে পারি। চায়ের দোকানের ছেলেটাকে একটা লাল জামা কিনে দিতে বলতে পারি। আর একটা শাড়ী, গ্রামে ফেলে আসা ওর মায়ের জন্য। সে হয়তো তার মাকে গিয়ে বলবে – “এক স্যার বখশিস দিছে”। হয়তো সে বুক ফুলিয়ে বলবে, “মা, তুমার লাইগ্যা আনছি।” তাতে মায়ের চোখে যদি দুই ফোঁটা পানি আনন্দে গড়িয়ে পড়ে – তাই বা কম কি? তাই দেরি না করে আজই ওদের মুখে হাসি ফোঁটাই। একটি শিশুর মুখেও যদি হাসি ফোটে, একটি মায়ের চোখেও যদি আনন্দ অশ্রু ঝরে – ধরে নেব আমার এই লেখা সার্থক।
ফারুক আহমেদ
পার্থ, অস্ট্রেলিয়া