ফ্লোরিডা থেকে:-

 

ঘুমাচ্ছিলাম , ইদানীং ঘুম জুড়ে থাকে নানা অস্বস্থি,অস্থিরতা । কারা যেন ডাকল :”চল আমাদের সাথে”। চেহারা দেখলাম না, কন্ঠ চিনলাম । হাঁটতে শুরু করলাম পাশাপাশি । নীচের দিকে একটা দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে , যা নেমেই চলেছে নীচ থেকে নীচে। অনেক দীর্ঘ সময় হাঁটলাম । পিঠে একটি ব্যাক প্যাক। কোন এক জায়াগায় একটি প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে একটি গ্রুপ সেলফী তুললাম । সেখান থেকে দূরে অদ্ভুত সবুজ বন্ধুর পাহাড় ও উপত্যকা দেখা যাচ্ছিল, কিছু কিছু গাছ নড়ছিল বাতাসে , কিছু কিছু লতা আঙুর লতার মত, যেমনটা দেখেছিলাম ইতালীর তাস্কানির গিলমিনিয়ানো শহরের উচুতায় দাঁড়িয়ে । তুলনামূলক এই চিত্রকল্পটি মনে হল আসলে জেগে ওঠার পর । ঘুমের ঘোরে দেখেছি নামহীন গোত্রহীন পাহাড়ী সৌন্দর্যই শুধু , তা ইতালী না ককেশিয়া বোঝার উপায় ছিলনা । ককেশিয়ায় ধবলকেশী এলব্রুসের অধিত্যকায় দাঁড়িয়ে তৈমুর যেমন বিস্মিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছিল দিগন্ত থেকে দিগন্তে , পাহাড় থেকে পাহাড়ে , স্তেপ থেকে স্তেপে আমার দৃষ্টি ছিল সেই ভাবে বিস্মিত ।

সেলফী শেষে আবার চলতে শুরু করলাম। মনে হল পিঠে যে বোঝাটি বইছি , তা বইছি বৃথাই, যেতে হবে অনেকদূর ( নিশ্চিত নই কেন মনে হল অনেক দূর) বরং রেখে গেলে হাল্কা হওয়া যায় । নামিয়ে রাখলাম ব্যাকপ্যাকটি ,অথচ আশ্চর্য ব্যাকপ্যাক খুলে একটি পাত্র নিলাম সাথে , পবিত্র জল আনবো বলে ( স্বপ্নে কিসের পবিত্র জল , কোথাকার তার কোন তথ্য ছিল না ) । ঘুমের মধ্যে আমি ওই ভাবেই যে ভেবেছিলাম তা স্পষ্ট মনে পরে । হয়তো সঙ্গীদের কেউ বলেছিল যে আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে পবিত্র জল রয়েছে ।

যাচ্ছি তো যাচ্ছিই, নীচ থেকে নীচে, কোন এক পাতাল পুরীতে । কোন এক বিশাল বা পবিত্রের সাথে দেখা হবে এমন একটা অনুভূতি । আরও কিছুদূর যেতে বন্ধুদের গলার স্বরগুলো দূরে দূরে সরে যেতে লাগলো, আওয়াজগুলো কেমন হতে লাগলো নিচু থেকে নীচুতর, পাশে তাকিয়ে দেখলাম ওরা আর পাশে নেই।

আমি যেতেই থাকলাম । এ পর্যায়ে আমার মনে হল আমি যেখানে যাচ্ছি আমার সহযাত্রী সুহৃদদের সেখানে যাওয়ার কথাই ছিলনা, যাওয়ার কথা শুধু আমার। ওদের সাথে কিছুটা পথ ছিল কমন। তার পরে আবার মনে হল যাদের সুহৃদ ভাবছি , তারা আমার সুহৃদ হবে কেন, পাশা পাশা হাঁটলেই কি কেউ বন্ধু হয়ে যায় ? আমার মধ্যে দুটো বিপরীত মুখী চিন্তা কাজ করতে লাগল। ওরাইতো আমাকে ওদের সাথে যেতে ডেকেছিল , আবার আমরা একসাথে দাঁড়িয়ে কত আবেগের সাথে সেলফী তুললাম । তাহলে ওরা আমাকে কোন কিছু না বলে হঠাৎ অন্য দিকে চলে গেল কেন? আমিই বা কেন ওদের সাথে না যেয়ে বরাবর নীচে নামতে থাকলাম এই অন্ধকারে?

এই স্বপ্ন কি আমাদের জীবনের প্রতিফলন? আমার ঘুমের মধ্যে এই অস্বাভাবিক আপাত পারস্পরিক সম্পর্কহীন ভাবনা গুলো কেন? মেনে নিচ্ছি স্মৃতি কোন লাইব্রেরি নয় ,যেখানে তথ্য গুলো গুছিয়ে রাখা থরে থরে তাকে তাকে, ইচ্ছা করলেই আমি প্রয়োজনীয় তথ্যটি খুঁজে পাইনে যখন চাই । বরং স্মৃতি এক মস্ত বড় ম্যানফিল্ডের মত । ট্রাকে করে এনে সব জন্জাল যেমন ফেলা হয় সেখানে আমি তাইতো করেছি সারাজীবন, কারি কারি তথ্য জড়ো করেছি। প্রয়োজনীয় তথ্যের সাথে অপ্রয়োজনীয় মিশে একাকার হয়ে আছে। গ্লেইসারের প্রস্রবন যেমন গভীরের জল তুলে আনে উপরে আমাদের স্বপ্নগুলো করে কি তাই?

আমি এক ভীষন অস্বস্থি বোধ করতে থাকলাম, আমার গলার কাছে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকলো, বুকে কি একটা ভার অনুভব করতে লাগলাম, আমার হৃৎপিন্ড দৌড়াতে লাগল দুশো মাইল গতির ট্রেনের মত । গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠতে লাগলো। হঠাৎ এই অস্থিরতার মধ্যে আমি নিজেকে আবিস্কার করলাম একটি দ্বীপে , দেখতে পেলাম এক অপূর্ব রূপসী নারী । অসামান্যা রূপসী এই রাজকন্যাকে চিনতে পেলাম, অ্যারিয়েদনে, হ্যা ক্রীটের রাজা মিনোসের কন্যা সে । আলুথালু সমুদ্র হাওয়ায় উড়ছে তার চুল , সে অশ্রু সিক্ত তাকিয়ে আছে ধীরে ধীরে অদৃশ্যমান একটি জাহাজের দিকে, জাহাজটি আর দেখা যাচ্ছেনা , পাল ফুলে উঠেছে অনুকূল হাওয়ায় , জাহাজ ছুটেছে দ্রুত, পাল ও মাস্তুল দৃষ্টি থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে , আর পরিত্যক্তা রাজকন্যা অ্যারিয়েদনে কাঁদছে নি:শব্দে । ক্রীটের ল্যাবিরিন্থে মিনোটাওযের হাত থেকে সে মুক্ত করেছে তার ভালোবাসার পাত্র ট্যাসিয়াসকে । পিতার বন্দী ট্যাসিয়াস ।অথচ সে তার আবেগকে দমন করতে পারেনি , ভালোবেসে ফেলেছে , তাই অভিশপ্ত যে ল্যাবিরিন্থ থেকে কেউ কোনদিন বেড়িয়ে আসতে পারেনি , সে পথ চিনিয়ে বের করে এনেছে ট্যাসিয়াসকে , তারপর রওনা দিয়েছে গ্রীসে প্রিয়তমের হাত ধরে ভালোবাসার নীড় গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে । আমার কষ্ট হতে লাগল অস্পরী সদৃশ্য এই নারীর ক্রন্দনে । নারী ধরিত্রীর প্রতিবিম্ব , নারী যখন কাঁদে তখন বিশ্ব ব্রম্মান্ড কেঁদে ওঠে । আমি তা সইতে পারিনা , আমার মনে হয় এক লক্ষ নাৎসী বুকে পায়ের বুট দিয়ে চেপে ধরেছে রুক্ষ্ণ খসখসে এসফাল্টের ওপর। আমি ওকে শান্তনা দিতে এগিয়ে গেলাম , সে আমার কাঁধে মাথা রেখে বর্ষার মত কাঁদলো । আমি এক হাতে ওর সোনালী চুলে আঙুলের চিরুনী দিয়ে বিলি দিতে দিতে অন্য হাতে মুছিয়ে দিলাম অশ্রু ।

চলবে….

পাদটিকা:

গ্রীক বীর ট্যাসিয়াস স্বেচ্ছা-বন্ধী হয়ে যায় ক্রিটের রাজা মিনোসের ল্যাবিরিন্থে ( গোলক ধাঁধা ) স্বদেশী বন্দীদের মুক্ত করার জন্য। অর্ধ মানব অর্ধ বৃষভ অপরাজেয় দানব মিনোটাওর ছিল মাটির নীচের এই গোলক ধাঁধার পাহারাদার। মিনোসের বন্দীরা ছিল এই দানবের খাদ্য । ট্যাসিয়াসের আগে কোন জীবিত মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়নি এখান থেকে বেড়িয়ে আসা । মিনোসের কন্যা রূপসী অ্যারিয়দনে গভীর ভাবে প্রেমে পড়ে ট্যাসিয়াসের । তার সাহায্য নিয়ে ট্যাসিয়াস মিনোটাওরকে হত্যা করে বন্দীদের মুক্ত করে , তারপর সমুদ্র পাড়ি দেয় এথেন্সের পথে । থামে নাকসোস্ দ্বীপে । দেবতাদের নির্দেশে এখানে ঘুমন্ত অ্যারিয়দ্নেকে রেখে সে জাহাজের নোঙ্গর তুলে চলে যায়।

এথেন্সের রাজা পিতা এগেয়াসের নির্দেশ ছিল যদি ট্যাসিয়াস জীবিত থাকে জাহাজ এথেন্সের উপকূলে আসার পর তারা যেন কালো পাল নামিয়ে সাদা পাল তুলে দেয় কিন্তু বিজয় ও দেশে ফেরার আনন্দে তারা ভুলে যায় এই নির্দেশ। এগেয়াস্ পাহাড়ের ওপরে তার প্রাসাদ থেকে তাকিয়ে থাকতো সমুদ্রের দিকে ছেলের পথ চেয়ে। কালো পাল দেখে সে ধরে নেয় ট্যাসিয়াস মৃত। সে পাহাড় থেকে ঝাপ দিয়ে সমুদ্রে আত্মহত্যা করে। সেই থেকে গ্রীসের এই সমুদ্রের নাম এগেইয়ান সাগর ।

* গ্রীক মাইথোলজী

*Mary Renault : ঐতিহাসিক উপন্যাস “Theseus”

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন