গত কয়েক দিন থেকে রেবেকা জ্বরে ভুগছে। রহমান সাহেব রেবেকাকে ডাক্তার আজমলের চেম্বারে নিয়ে যেতে চাইলে রেবেকা বলে আমার বিছানা থেকে উঠতেই অনেক কষ্ট হইতেছে । রহমান সাহেব ডাক্তার বাসায় ডেকেছেন এবং ডাক্তার আজমল বাসায় এসে বলে রহমান তুমি আমাকে এই সকাল সকাল কেন ডাকছো?
কাল রাত রেবেকা ঘুমায় নি, অনেক জ্বর । ডাক্তার আজমল বলে কোনো ঔষুধ দিয়েছো কি?
প্যারাসিটামল দিয়েছি, কিন্তু কাজ হয় নি । সে বেড রুমে গিয়ে সালাম দিয়ে বলে দেখি ভাবি তোমার টনসিল ও টেম্পারেচার । হ্যাঁ, জ্বর আছে এখনো । আমি কয়েকটা ঔষুধ লিখে দিলাম, নিয়ে এসে খেতে দাও । ঠান্ডা জনিত জ্বরের জন্য কিছু ঔষুধ দিয়েছি, জ্বর ভালো হয়ে যাবে। কিমো কি নেয়া হচ্ছে নিয়ম মতো?
হ্যাঁ ।
রেনু সাকিলার বিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর চিটাগাং ফিরে যায়নি। সাকিলা চলে যাওয়ার পর মায়ের দেখা শুনার দায়িত্ব একমাত্র রেনুর উপর। রহমান সাহেবের একার পক্ষে অসুস্থ রেবেকাকে সামলানো ঝুঁকি পূর্ণ । রহমান সাহেব রাতে ঘুমাতে পারেন না, আজকাল প্রায়ই রাতে দুঃ স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যায়।রাতে ঘুম না হলে সে উঠে এ ঘর সে ঘর একা একা পাঁয়তারা করে ।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাজের মেয়ে হাসু বেড রুম গুছিয়ে কিচেনে গিয়ে সবার জন্য সকালের ব্রেকফাস্ট তৈরী করে । এর পর সকালে বাজার নিয়ে আসলে গুছিয়ে রান্না করে দুপুরের জন্য। সারা দিন তার কোনো বিশ্রাম নেই । এই একটি মাত্র কাজের মেয়ের উপর সবার ভরসা ।
রহমান সাহেব প্রতি সপ্তাহে এক দিন রেবেকাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হয় তার চেকিং এর ন্য। কিমো দিলে রেবেকা আজকাল অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে।
রেবেকা রেনুকে বলে তুমি আমার জন্য কেন নিজের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলবে। তোমার শ্বশুর এবং হাসু আছে আমাকে দেখার জন্য। রেনু বলে মা তোমাকে এ অবস্থায় ছেড়ে আমি যেতে পারি না।
রেবেকা টেলিফোন উঠিয়ে বলে মজিদ তুমি রেনুকে এখানে রাখবে না। সব মানুষ রোগী হওয়ার কি প্রয়োজন?
আম্মু, তুমি বুঝতে পারছো না, সাকিলার বিয়ে হয়েছে , সে তার নিজের ঘর সংসার নিয়ে থাকুক। আব্বু তোমাকে টানতে গিয়ে রোগী হয়ে পড়বে। আমরা চাই না আব্বু শেষ বয়সে মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ুক। আজিজ শিকাগো উনিভার্সিটিতে পড়াশুনা নিয়ে আছে, ওর এমবিএ শেষ করতে আরো এক বৎসরের বেশি সময় লাগবে। ওর কোনো রকম পড়াশুনার ক্ষতি হোক এটা কেউ আমরা চাই না। তুমি জানো সে অনেক দুর্বল, এবার ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় তোমার জন্য অনেক কান্না কাটি করেছে। আমি তদবির করে হলেও ঢাকা চলে আসবো। সাকিলা বলেছে রেনুকে ওর স্কুলে টিচার হিসাবে দিতে পারবে। দিনার পড়াশুনা ও বাসায় আসলে ভালো হবে। তুমি চিন্তা করো না আম্মু আমার জন্য।
রহমান সাহেব পীর সাহেবের নিকট থেকে পানি পড়া ও তাবিজ এনে রেবেকাকে জোর জবরদস্তি করে বলে এতে আল্লাহর কালাম, কখনো অবজ্ঞা করো না। আল্লাহ কাকে কি ভাবে ভালো করে তুমি বলতে পারবে না। সাকিলার জন্য তদবির করেছি , আমরা তার ফল পেয়েছি। সে এখন ভালো।রেবেকা বলে আমি মরে গেলে ও পীরের তদবির নেবো না। রহমান গোপনে রেবেকার খাবার ও গোছলের পানিতে পীরের পানি পড়া মিশিয়ে দিয়ে পীরের দেয়া তাবিজ বিছানার নিচে রেখে দিয়েছে । এক দিকে ডাক্তারি চিকিৎসা আর এক দিকে পীরের চিকিৎসা সমানে সমানে চলছে। কিন্তু কোনটাই সঠিক উপকারে আসছে না।
রহমান সাহেব পীরের নিকট গিয়ে বলে হুজুর আমি আমার স্ত্রীকে আপনার তদবির সঠিক ভাবে দিতে পারছি না। তাই লুকিয়ে লুকিয়ে গোছল ও খাবার পানিতে মিশিয়ে দিতেছি। পীর সাহেব বলেন আপনার বাড়িতে জ্বিনের আছর আছে ।আমি আপনাকে আগেই বলেছি দুটা জ্বিন কোহকাফ থেকে এনে আপনার বাড়ির উপর আছর করানো হয়েছে। বড়ো দুষ্ট প্রকৃতির জ্বিন, আপনার মেয়ের উপর ওদের আছর ছিল, আমি তদবির করে সরিয়েছি। এখন তদবির লাগবে বাড়ি থেকে জ্বিন সরাতে। রহমান সাহেব হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে এবং বলে হুজুর আপনি আমার প্রতি একটু নেক দৃষ্টি রাখুন। রহমান সাহেব মানি ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে পীর সাহেবকে দিয়ে বলে হুজুর আপনি একটু দয়া করুন। পীর সাহেব বলে তিন দিন পর আসবেন,এর মধ্যে আমি মোরাকাবা করে জ্বিন দের সঙ্গে কথা বলবো। ওরা কি চায় আমার জানতে হবে। আচ্ছা হুজুর আপনার কাশ্ফ খোলা, আপনি সবই দেখেন এবং বুঝেন, আমার উপকার টুকু করুন।
পীর সাহেব বলেন, রহমান সাহেব আর একটা কথা বলি,” ভক্তিতে মুক্তি।” ভক্তি না থাকলে মুক্তি পাওয়া যায় না। যে কোনো তদবির যেমন কবিরাজি, এলোপ্যাথি বা হোমিওপ্যাথি যাই কিছু হোক, ভক্তি শ্রদ্ধার সঙ্গে চিকিৎসা নিতে হবে। আমি আপনাকে তার বেশি কিছু বলতে পারছি না। রহমান সাহেব বলে হুজুর আপনি আমার স্ত্রীর জন্য খাস দিলে দোআ করেন এতে ও ভালো হয়ে যেতে পারে। প্রতিবারই পীরের নিকট গেলে কিছু টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলে পীর সাহেব মুখ খুলে কিছু বলেন না।
রহমান সাহেব পীরের খানকায় মাগরিব ও এশার নামাজ পড়ে ঘরে ফিরে আসলে রেবেকা বলে তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
আমি খানকায়ে গিয়ে মাগরিব ও এশার নামাজ পড়ে ঘরে আসতেছি। তুমি কারো কথা শুনো না, আমি বা আমার ছেলে মেয়ে এমন কি রেনু ও পীর, ফকির কেরামতি এসব বিশ্বাস করে না। তোমাকে বার বার বলতেছি পীরের বাড়ি যাবে না। কিন্তু তুমি শুনো না। তুমি পানি পড়া, তাবিজ এ সব ঘরে নিয়ে এসো। রেবেকা, আল্লাহর কালাম নিয়ে কোনো কথা বলবে না! সাকিলাকে পীর সাহেব তদবির করে কি ভাবে ভালো করলো তুমি দেখো নি ?
রেনু বলে বাবা তুমি কি নিয়ে কথা বলছো ?
আমি পীরের বাড়ি যাই তোমার মা পছন্দ করে না। বাবা আমরা এ সব বিশ্বাস করি না । তুমি অযথা এ সব নিয়ে ইমান নাড়া ছাড়া করবে না । ঠিক আছে মা, আমি আর যাবো না। রেবেকা বলে তুমি বলো, কিন্তু পীরের বাড়ি না গিয়ে থাকতে ও পারো না।
রাতে রেবেকা রহমান সাহেবকে ডেকে বলে আমার কাছে বস, আমি তোমাকে কিছু বলবো।কি বলবে বলো?
দরজা বন্ধ করো আমি তোমাকে আস্তে আস্তে কথা বলবো যাতে রেনু না শুনে । রহমান সাহেব রুমের দরজা বন্ধ করে কাছে এসে বলে কি বলবে?
শুনো,তোমার এবং আমরা চাকুরী নেই,তুমি সামান্য পেনশন পাও এ দিয়ে সংসার চলে না । রহমান সাহেব বলে এখন আমি কি করবো?
রেবেকা বলে তোমাকে কাজ করার জন্য বলছি না । তুমি এই অভাবের সংসারে রোজ রোজ পীরের বাড়ি গিয়ে তদবির করালে পয়সা দিতে হয় কি না ?
বেশি না , তবে কিছু দিতে হয় । প্রতি সপ্তাহে আমাকে কিমো নিতে হয়, আমার চিকিৎসার খরচ মজিদ বহন করে, এ দিকে তুমি পীরকে পয়সা দিতে যাও । সংসারের খরচ আছে, তার উপর আমার চিকিৎসা । তুমি কি এ সব বন্ধ করবে ?
আমি তোমাকে কোনো কাজ করার জন্য বলছি না, তুমি বিনা প্রয়োজনে পীরের বাড়ি যাবে না এবং পয়সা খরচ করবে না । ঠিক আছে রেবেকা আমি আর যাবো না ।
আর একটা কথা শুনো, সাকিলাকে বিয়ে দেয়া হয়েছে যেন তেন করে । সীমা ও মাসুদ সাহেব এগিয়ে এসে সব কিছু করেছে আমাদের জন্য । সাকিলা আমাদের একটি মাত্র মেয়। তারা আগামী দিন সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে আসবে এবং এখানে একদিন থাকতে বলবো । নুতন জামাই তাকে কিছু টাকা দেবে এবং বলবে পছন্দ মতো যা কিছু কিনে নেবে । আমাদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হবে না, তাই বলে মেয়ে জামাই আসলে সামনে একটু ভালো খাওয়া দিতে হয় । কি কি বাজার করতে হবে কাল সকালে বাজারে গিয়ে নিয়ে আসবে । রহমান বলে, আবিদ জ্ঞানী ছেলে, সে আমাদের অবস্থা বুঝে শুনেই বিয়ে করেছে । তাছাড়া আমরা আজকাল গরিব না । আমাদের সবই আছে, মজিদ ভালো চাকুরী করে এবং আজিজ আমেরিকা থেকে ডিগ্রী নিয়ে দেশে আসলে ভালো চাকুরী করবে।সাকিলা হয়তো সরকারি কলেজে চাকরি পেয়ে যাবে । নিজের বাড়িতে থাকি এবং পেনশন পাই । রেবেকা তুমি এ সব নিয়ে চিন্তা করবে না । তুমি তোমার শরীরের চিন্তা করো ।
রেবেকা তুমি কি জানো সাকিলা ও আবিদ কাল কটার দিকে এয়ারপোর্ট পৌঁছবে ?
আমি শুনেছি ওরা ৪টার দিকে এয়ারপোর্টে পৌঁছবে । এয়ারপোর্ট কে যাবে?
সীমা বলেছে ওরা গাড়ি পাঠাবে, আবিদের ছোট ভাই খুরশিদ ওদের রিসিভ করতে যাবে । আমি বলেছি আমাদের বাসায় আসতে । সীমা না করে বলেছে ওর ওখানে খাবার ব্যবস্থা করবে এবং খাবার পর বাসায় চলে যাবে । তাদের আর ও তিন দিন ছুটি আছে এর মধ্যে আমাদের এখানে এবং খানিকটা ঘুরা ফেরা করে কাজে যোগ দেবে ।
সাকিলা ছোটকাল থেকেই এ সংসারে কোনো শখ স্বাধ পায় নি । আমাদের টানা হেচড়ার সংসারে মানুষ হয়েছে । কোনো দিন বলতে পারবে সে কোনো কিছুর আবদার করেছে ?
না, ঠিকই বলছো, আমার ছেলে মেয়েরা পরের ছেলে মেয়ে পড়িয়ে পয়সা রোজগার করে নিজের খরচ চালিয়েছে । এদিক থেকে আমরা সুখী যে ছেলে মেয়েদের মানুষ করতে পেরেছি । তা ছাড়া রেবেকা এটা তোমার অবদান যে তুমি সাইন্স পড়েছো বলে ওদের জন্য কোনো দিন বাহিরের টিচার রাখতে হয় নি । নতুবা আমি এদের প্রাইভেট টিচার দিয়ে কোনো দিন পড়াতে পারতাম না । তুমি আর আমি এটুকু শান্তি নিয়ে আছি যে ছেলেমেয়েরা কারো মুখাপেক্ষি না । ওরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যেটুকু করেছে তার জন্য আনন্দিত ।
সীমা খুরশিদকে টেলিফোন করে না পেয়ে কাজের ছেলেকে তার বাসায় পাঠিয়েছে । খুরশিদ ওকে দেখে বলে কি খবর নিয়ে এসেছো?
সে বলে দাদু আপনাকে বলেছে টেলিফোন করার জন্য । ও টেলিফোন করে সালাম দিয়ে বলে আন্টি আপনি আমাকে কি জন্য টেলিফোন করতে বলেছেন?
সীমা বলে কাল আবিদ ও সাকিলা সিঙ্গাপুর থেকে বিকেলের দিকে আসবে । তুমি কি ওদের পিক আপ করতে যেতে পারবে?
জ্বি পারবো। তুমি আমাদের পাঠানো গাড়ির সঙ্গে কালকে এয়ারপোর্ট যাবে এবং আবিদ ও সাকিলাকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসবে এবং বিকেলে এখানে ডিনার করে যাবে । তুমি তিনটার দিকে আমাদের অফিসে যাবে এবং তোমার আংকেল গাড়ি দেবে । ঠিক আছে আন্টি ।
পর দিন কলেজে ক্লাস সেরে খুরশিদ সরাসরি আবিদের অফিসে গিয়ে রিসেপশনে দেখা করলে মাসুদ সাহেব ওকে ভিতরে ডেকে পাঠান । মাসুদ সাহেব টেলিফোন ছেড়ে ড্রাইভার ডেকে বলে তোমরা এয়ারপোর্ট গিয়ে ওদের নিয়ে বাসায় আসবে । খুরশিদ এয়ারপোর্ট পৌঁছে খোঁজ নিয়ে জানে প্লেন ল্যান্ড করেছে । সে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখে প্যাসেঞ্জার ভিতরে আসতেছে । সে বাহিরে ওদের জন্য অপেক্ষা করে এবং আবিদ ও সাকিলা কাস্টম ক্লিয়ার করার পর বাহিরে এসে খুরশিদকে পেয়ে হাঁসতে হাঁসতে বলে তুমি কখন এসেছো?
খুরশিদ বলে বড়ো জোর আধ ঘন্টা । সাকিলা বলে আমাদের বাসায় সবাই ভালো আছে?
খুরশিদ বলে, আমি গত সপ্তাহে গিয়েছি, সবাই এক রকমই আছে । সাকিলা বলে আমরা এখন কোথায় যাবো?
আবিদ বলে সীমা আন্টি বলেছেন, আমাদের বিকেলে ওনার বাসায় ডিনার করতে । খুরশিদ বলে আমাকে ও তাই বলেছেন তোমাদের নিয়ে যেতে, রাত খাওয়া দাওয়া করে চলে যাবো । সাকিলা বলে আচ্ছা ঠিক আছে চলো ।
মাসুদ সাহেব বিকেলে ছাদে ফুলের গাছে পানি দিয়ে এক কোনে বসে পত্রিকা পড়ে ও চা খায় এবং সীমা ও ছেলে মেয়েদের সঙ্গে গল্প করেন । এটা তাঁর চিরাচরিত নিয়ম এবং এর ব্যাতিক্রম হবে না । আজ ও তাই । সীমা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সাকিলাও আবিদের জন্য অপেক্ষা করছে । ওদের গাড়ি দেখে নিচে নেমে এসে হাঁসতে হাঁসতে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ায় । সাকিলা গাড়ির দরজা খুলে আন্টিকে জড়িয়ে ধরে বলে,” তুমি কেমন আছো, আন্টি ?”
আমরা ভালো আছি, তোমরা কেমন আছো?
ভালো আছি । আবিদ নেমে এসে সালাম দিয়ে বলে আন্টি গাড়িতে আমাদের লাগেজ থাকবে ?
না, এগুলি নিচে আমাদের স্টোর রুমে রেখে দাও এবং এই চাবি নিয়ে দরজা লক করে দাও । সাকিলা বলে আংকেল কোথায় ?
তোমার আংকেল ছাদে বসে পেপার পড়ে । চলো আংকেলকে সালাম দিয়ে আসি । না, তোমরা নিচে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে তৈরী হয়ে নাও, আমরা বাহিরে খেতে যাবো । আন্টি আমরা ঘন্টা খানিক আগে প্লেনে লাঞ্চ করেছি । আমি এক মুষ্টি ও খাবো না , আবিদ তুমি খাবে?
স্যার, রাগ করবেন না খেয়ে গেলে। সাকিলা বলে আন্টি বাসায় ডাল ভাত খেতে ইচ্ছা করে। সীমা বলে তা হলে বাসায় যা আছে খেয়ে যাও। ঠিক আছে, তোমরা হাত মুখ ধুয়ে আরাম করো,আমি তোমার আংকেলকে বলে আসি।
মাসুদ সাহেব বাড়ির ছাদ থেকে নিচে নেমে এসে বলে, কি খবর সাকিলা ও আবিদ তোমরা ভালো ভাবে ফিরে এসেছো? ওরা সালাম দিয়ে বলে, জ্বি । সীমা বলে ওরা আজ বাহিরে যেতে চায় না । মাসুদ সাহেব বলেন , বাহিরে খাওয়াবে কি ঘরে খাওয়াবে তোমার ব্যাপার । আমি এ ব্যাপারে কিছু বলবো না । ঘরে যা যা ছিল সব বের করে কাজের মেয়ে বলে আপনারা খেতে আসেন । টেবিল ভর্তি খাওয়া দেখে সাকিলা বলে এত খাওয়া ফেলে বাহিরে কেন যাবো?
সীমা বলে তোমরা নুতন মেহমান । সাকিলা বলে আন্টি ছোট সময় থেকেই আমি আপনার বাসায় খাওয়া দাওয়া করি । মাসুদ সাহেব বলেন ঠিক আছে আর একদিন বাহিরে খাওয়া যাবে ।
খেয়ে দেয়ে সাকিলা ব্যাগ থেকে ওদের জন্য কিছু গিফট বের করে বলে আন্টি এই শাড়ি আপনার জন্য, এই শার্ট,প্যান্ট ও টাই আংকেলের জন্য এবং আরও দুই একটা কিছু আমার ভাই বোনদের জন্য এনেছি ।
সীমা বলে সাকিলা তোমার জন্য এই শাড়ি এবং আবিদের জন্য এই শার্ট ও এই শার্ট খোরশেদের জন্য রেখেছি । সীমা বলে লম্বা জার্নি করে তোমরা ক্লান্ত, আজ বেশি দেরি করো না । কাল বা পরশু তোমার আম্মুকে দেখে এস । সাকিলা ও আবিদকে বিদায় করে দিয়ে গেট বন্ধ করে বলে মাসুদ তুমি একটা ভালো কাজ করেছো । মাসুদ বলে আল্লাহ জানেন কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ । আমি চেষ্টা করেছি । সীমা বলে ওদের হাসি খুশি দেখে ভালোই লাগলো ।
রাত ১০টার দিকে খোরশেদ ওর মেসে নেমে যাওয়ার পর সাকিলা ও আবিদ নিজেদের বাসায় পৌঁছে । সারা দিনের লম্বা জার্নির পর ওরা ক্লান্ত এবং সকাল সকাল শুয়ে পড়ে । আরও তিনদিন ওদের ছুটি আছে,বিশেষ তাড়া নেই । সকাল ৯টার দিকে ঠুনকো মহিলা রুটি,ভাজি ও ডিম তৈরী করে টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে। সাকিলা ও আবিদ উঠে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করে বলে আজ কি প্রোগ্রাম করা যায় ?
সাকিলা বলে আম্মুকে সকালে কল দিয়েছি । আবিদ বলে মায়ের শরীরের অবস্থা কি রকম ?
আজ সকালে আম্মুকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে কিমো দেয়ার জন্য রেনু ও আব্বু হাসপাতালে এসেছে আম্মুকে নিয়ে। আবিদ নাস্তা করে বাজারে গিয়ে কিছু কেনা কাটা করে এনে কাজের মহিলাকে দিয়েছে। সাকিলা তৈরী হলে ওরা হাসপাতালে চলে যায় ।
গেট থেকে উঠতেই রেনুর সঙ্গে দেখা, ও হেঁসে বলে তোমরা কেমন আছো?
সাকিলা বলে আমরা ভালো আছি , আম্মু কোথায় ?
আম্মু ইমার্জেন্সি রুমে এবং আজ কিমো দেবে । সাকিলা রুমে ঢুকে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলে । আব্বু এক নজরে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে । রেবেকা বলে আমি ভালো আছি , আমার জন্য দুশ্চিন্তা করার কিছুই নেই । রুমে লোকজন বেশি,সে জন্য রেনু,সাকিলা ও আবিদ ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ।রহমান সাহেব একমাত্র রুমে আছেন এবং ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করছেন । রহমান সাহেব বাহিরে এসে বলেন তোমরা সবাই চলে যাও, আমি রেবেকার সঙ্গে থাকবো। বিকেলে রেবেকাকে ছেড়ে দিলে বাসায় নিয়ে যাবো। রেনু বলে তোমরা বিকেলে বাসায় আসবে এবং খাওয়া দাওয়া করবে । সাকিলা বলে আমি আম্মুর কাছে থাকতে চাই । রেনু বলে এত লোক এখানে থাকার দরকার নেই । তোমরা লং জার্নি করে এসেছো, তোমাদের রেস্টের দরকার । বাসায় গিয়ে তোমরা ঘুমিয়ে বিকেলে আসবে,ততক্ষনে মা বাসায় চলে আসবে । ঠিক আছে ভাবি, আমি একবার আম্মুর সঙ্গে কথা বলে আসি । কামরাতে ডাক্তার আছে এখন যাওয়া ঠিক হবে কি ?
ঠিক আছে আব্বুকে একবার বলে আসি , যাও গিয়ে দেখো যদি নার্স এলাও করে বলে চলে এস । সাকিলা রুমের বাহিরে দাঁড়াতেই রহমান সাহেব বাহিরে এসে বলে সাকিলা তোমরা বিকেলে বাসায় আসবে,ততক্ষনে তোমার আম্মু বাসায় চলে যাবে । ঠিক আছে আব্বু এই বলে সাকিলা,আবিদ ও রেনু বাহিরে এসে রিক্সা নিয়ে যার যার পথে চলে যায় । আবিদ বলে বাহিরে ঘুরবে , না বাসায় চলে যাবে?
না, বাসায় গিয়ে দুপুরের খাওয়া ও রেস্ট নেবো । সন্ধ্যার দিকে দুই জনে তৈরী হয়ে একটা বেবি ট্যাক্সি নিয়ে বাসায় গিয়ে ঢুকতেই দিনা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলে ফুফু তুমি এসেছো?
হ্যাঁ এসেছি । তুমি কেমন আছো ?
হ্যাঁ, আমরা ভালো আছি । তোমাদের জার্নি কেমন হলো?
অনেক ভালো হয়েছে । সাকিলা রুমে ঢুকে দেখে আম্মু ঘুমিয়ে আছে । সে এক নজর দেখে ড্রয়িং রুমে গিয়ে আবিদকে বলে ব্যাগটা দাও ?
আবিদ ব্যাগ এগিয়ে ওর হাতে দিয়ে একটা পত্রিকা নিয়ে বসে পড়ে । রহমান সাহেব রুমে ঢুকলে আবিদ সালাম দিয়ে বলে বাবা তুমি কেমন আছ্?
আমরা ভালো আছি, তোমার শ্বাশুড়ির শরীর ভালো না সে জন্য একটু পেরেশানিতে আছি । তা বুঝতে পারছি ।
পীর সাহেব তিন দিন পর যাইতে বলেছেন, পীরের সঙ্গে বেয়াদবি করা যায় না । আজ পীরের খানকায় আছর নামাজ পড়তে গেলে রহমান সাহেবকে দেখে পীর সাহেব বলেন আপনার জন্য কিছু নুতন খবর আছে। নামাজের পর পীর সাহেবকে সালাম দিলে বলেন “এ বড়ো ফাজি জ্বিন,” ওদের সঙ্গে আমার অনেক তর্ক বিতর্ক হয়েছে। ওরা আপনার বাসা ছেড়ে যেতে চায় না, আপনার ক্ষতি করার জন্য তৈরী , তাছাড়া আমি তদবির করেছি, এ নিয়ে আমার উপর রাগ, পছন্দ করে না । পীর সাহেব বলেন আপনাকে একটা কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হবে বলে জ্বিন জানিয়েছে । হুজুর কি স্যাক্রিফাইস করতে হবে?
একটা সাদা গরু কম পক্ষে এক বৎসর বয়স হতে হবে । হুজুর একটা গরু স্যাক্রিফাইস করতে হবে?
চিন্তা করে কিছু হবে না, আপনাকে জট পট করতে হবে, নতুবা ওরা আপনার ক্ষতি করবে বলে জানিয়েছে । কথা শুনার পর,খানকা থেকে বের হয়ে আসার পথে একজন মুসল্লি জিজ্ঞেস করে পীর সাহেব আপনাকে কি বলেছেন?
রহমান সাহেব বলেন আমার স্ত্রী অসুস্থ,তাই হুজুরকে বলেছি একটু তদবির করতে । উনি মোরাকাবা করে জেনেছেন জ্বিনের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য একটা সাদা গরু স্যাক্রিফাইস করতে হবে । সে বলে আপনি এ সব বিশ্বাস করেন?
না বিশ্বাস করে কি করবো? মানুষের তো অসুখ বিশুখ হতেই পারে। আপনি আপনার স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাচ্ছেন, ওটা নিয়েই থাকেন ।
ঘরে সাকিলা ও আবিদ এসেছে, এ দিকে দেরি হয়ে গেলো , জোরে জোরে পা ফেলে ঘরে গিয়ে দেখে ওরা এখন ও না খেয়ে বসে আছে । সাকিলা বলে আব্বু তুমি নিশ্চয় পীরের বাড়ি গিয়েছো, সে জন্য দেরি হয়েছে । হ্যাঁ, মা আমার একটু দেরি হলো । সাকিলা ও আবিদ সিঙ্গাপুর থেকে সবার জন্য গিফট এনেছে । রহমান সাহেবকে একটা শার্ট ও প্যান্ট দিয়ে বলে এ গুলি তোমার জন্য । ওরা ডিনার শেষ করে রাত অফিসের গাড়িতে বাসায় চলে যায় ।
রাতে সাকিলা ও আবিদ চলে যাবার পর রেবেকা বলে তুমি আমাকে বলেছো আর পীরের বাড়ি যাবে না । এ দিকে ঘরে মেয়ে ও নুতন জামাইকে রেখে পীরের বাড়ি গিয়েছো । ওরা না খেয়ে এতক্ষন তোমার জন্য বসে আছে । তুমি কি দিনের পর দিন বাচ্চা ছেলে হয়ে যাচ্ছো?
রেনু বলে বাবা পীরের বাড়ি গিয়ে কোনো লাভ হলে আমরা মাকে ডাক্তারের কাছে না নিয়ে পীরের বাড়ি নিতাম । তুমি এর পিছনে আর সময় দেবে না । মা, আমি তোমাদের কথা শুনবো।
ক্রমশ :