শুরু হয়েছিলো গত বছরের শেষ কোয়ার্টারে (Quarter)। চলছে এখনো। শতাব্দীর ভয়াবহতম এক যুদ্ধের সাথে লড়ে গোটা মানবজাতি এখন ২০২০ এর ক্যালেন্ডারে শেষ কয়েকটা দিনের পাতায়। বিজয় অনেকটা নিশ্চিত হলেও এখনো সুনিশ্চিত মাইল ফলকে নয়!
ক্যাপশানে ছবিটা আমাদের বাসার কাছের একটি মল (Mall) থেকে নেয়া। সাজানো একটি ক্রিসমাস ট্রী (Christmas Tree)। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে একাকী! ও জানেনা এ বছর কেন তার এ অবস্থা। প্রতিবছর এ সময়টায় এখানে সুসজ্জিত একটা মঞ্চ থাকে। যেখানে কল্পিত সান্তা ক্লজ (Santa Claus, a historical character, real name as mentioned in Wikipedia and other sources was St. Nicholas, a monk who lived around 300-400 years A.D.) এর রূপে সেজে বসে থাকেন একজন লোক। আর তার সাথে ছবি তোলার জন্যে বাবা মায়েরা তাদের সন্তানদের নিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন। এবছর সে লাইন তো অনেক দূর স্বপ্নের কথা। গোটা মলেই কতোজন লোক আছে তা আঙুলের কড় গুনে বলে দেয়া যায়। কারনটা নিশ্চয়ই পাঠক বুঝতে পেরেছেন। প্রসঙ্গক্রমে, বর্তমান সময়ে আমাদের সব ধর্ম, ধর্মীয় তথা মানবিক মূল্যবোধ, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে শিল্প-সংস্কৃতি, সবকিছুই পুঁজির বাজারে এক পণ্য হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। বেনিয়াদের সুবিধায় না আসলে এর কোনটারই হয়তো আর কোন অস্তিত্ব থাকতো না। বলাবাহুল্য এই সান্তা চরিত্র ও পশ্চিমা বিশ্বে ক্রিসমাসের সময় এক বড় পণ্য হিসেবে বিভিন্ন বাজার, বিজ্ঞাপন এবং মাধ্যমে বিক্রি হয়। এ চরিত্রের পণ্যায়নে আমাদের আত্মিক শুদ্ধির চেয়ে ব্যাবসায়িক দিকটিই এখন বেশী গুরুত্ব বহন করে বলে মনে হয়। একই কথা এখন প্রথাগত ধর্মগুলো সম্পর্কেও বলা যায়। সময়ের পরিক্রমায় এগুলো যতোটা না আমাদের আত্মিক উন্নতিতে সহায়ক হয়েছে তার চেয়ে অনেকগুন বেশী এনেছে বিভাজন। এখন কোন রকমে তা জোড়াতালি দিয়ে চলার ব্যার্থ চেষ্টা চলছে! এটি আমার আজকের নিবন্ধের মূল বিষয় নয়। সুতরাং প্রসঙ্গটিকে আর টানছি না।
মল গুলো যমজমাট না হলেও, শহরের যে সব বাসিন্দারা তাদের বাসাগুলোকে এই সময় আলোক সজ্জায় সজ্জিত করেন তারা বরাবরের ধারাবাহিকতা ঠিকই বজায় রেখেছেন। গ্রেগোরিয়ান (Gregorian Calendar) ক্যালেন্ডারের পাতাটা আর কয়েকদিনের মধ্যে উল্টে যাবে নূতন বছরে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেকটা সন্তর্পণেই হয়তো। অনেকটাই বেশী ভারাক্রান্ত আজ পৃথিবীর মাটি। জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের (Johns Hopkins University) হিসেব মতে, এ নিবন্ধ লেখার সময়ে পৃথিবী ব্যাপী কোভিড-১৯ এর কারণে বৃন্তচ্যুত জীবনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সতেরো লক্ষ তিরিশ হাজার (1.73 million)। প্রকৃত সংখ্যাটা যে আরও অনেক বেশী তাতে কোন সন্দেহ নেই। নূতন বর্ষে প্রবেশের মুখে তাই শোকাবহ থাকবে পৃথিবীর নিঃশ্বাস। তবে তারও চেয়ে বেশী থাকবে শঙ্কা, উৎকন্ঠা আর এককেন্দ্রিক জল্পনা।
কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত পৃথিবীর সব মানুষের দেহে সর্বসাকুল্যে যে পরিমান জীবাণু রয়েছে ওজনের হিসেবে তা কয়েক গ্রামের বেশী হবে না। অথচ আপাতঃ অদৃশ্য এই জীবাণুই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব (স্বঘোষিত ভাবে) মানুষের কর্মকান্ডের প্রায় শতকরা তিরিশ ভাগকেই স্থবির করে ফেলেছে। জীবন ব্যবস্থায় এনেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এক বছরের মধ্যে নিয়ে নিয়েছে এতোগুলো জীবন। ভবিষ্যতে আরও নিবে তাও অনুমান করতে কোন সমস্যা হয় না। এই ভাইরাসটি সরাসরি প্রকৃতি থেকে আগত না এর সৃষ্টিতে মানুষেরও কিছুটা ভূমিকা আছে সে বিতর্ক আপাততঃ নয়। প্রকৃতি তার সবচেয়ে বুদ্ধিমান সন্তান ‘মানুষ’ এর অপব্যবহারের শিকার হতে হতে নিজস্ব আত্মরক্ষার জন্যেই এই জীবাণুকে নিয়ে এসেছে এমন ভাবনারও কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। মোদ্দা কথা এগুলো শুধু জল্পনাকল্পনা, কথার কথা। সত্যটা হলো এমন বিপর্যয় তো এই প্রথম নয় এবং বলা যায় শেষ ও নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এমন একটি বিপর্যয় থেকে আমরা কি শিক্ষা নিলাম? অথবা আদৌ কোন শিক্ষা নিলাম কি?
এই নিবন্ধ যখন লিখছি তখন পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে পূর্ব প্রতিষেধক (Preventive Measure) হিসেবে কোভিড–১৯ এর ভ্যাকসিন মানব দেহে প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। ইতিহাস মতে এর পূর্বে কোন ভাইরাসের প্রতিষেধকই এত দ্রুত আবিস্কৃত হয়নি। কোন কোন ক্ষেত্রে তীব্র এলার্জিক রিয়েকশন (Allergic Reaction) ছাড়া আর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। সুখবর নিশ্চয়ই। তবে পাশাপাশি আর একটি বড় দুশ্চিন্তার খবর হলো ব্রিটিশ মুলুকে ইতিমধ্যে এই ভাইরাসের মিউটেশন (Mutation) হয়ে এর আর একটি ভার্শন (Version) তৈরী হয়ে গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। এটা কোভিড-১৯ এর ই একটি ভ্যারিয়ান্ট (Variant) এবং মানুষের দেহে এই ভাইরাসটি সংক্রমণের দ্রুততা কোভিড-১৯ এর তুলনায় ৭০% বেশী বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর কারণে কানাডা সহ ইউরোপের বেশীর ভাগ দেশ এখন ইংল্যান্ডের সাথে আকাশ যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। যে ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না তারাই আজ সাময়িক হলেও অনেকটাই একঘরে হয়ে পড়েছে! বিষয়টা আমরা দেখলাম এবং দেখছি। কিন্তু কতোটা ঠিক উপলব্ধিতে নিতে পেরেছি তা অবশ্য প্রশ্ন সাপেক্ষ। আত্ম স্বার্থে আমাদের বিভোরতা এবং আত্ম অহংকারের কথাই আমি বলছি। তবে বিষয় যা-ই হোক, ভ্যাকসিন আবিস্কৃত হলেও কোভিড-১৯ এবং এর পরবর্তী ভার্শন এর সাথে যুদ্ধটা যে সহসা যাচ্ছে না তা প্রায় নিশ্চিত। সুতরাং এর কারণে পৃথিবীর জন জীবন এবং অর্থনীতিতে আরও যে কতোটা ধস নামবে তার অংক কষার সময় এখনো আসেনি বলা যায়। তারপরও এ যুদ্ধে মানুষের জয়ই যে নিশ্চিত এ বিশ্বাস পৃথিবীর শতভাগ মানুষই হয়তো রাখেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো মানুষের এই জয়ে মানবতার জয় কতোটুকুন হবে সেটাই এখনো দেখার বিষয়।
বিষয়টির একটুখানি গভীরে তাকালে আমরা কি দেখতে পাই? যে কয়টি দেশ এখন পর্যন্ত মানব দেহে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করেছে তাদের সবগুলোই উন্নত বিশ্বের সারিতে অথবা প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক ভাবে উন্নত। পক্ষান্তরে আফ্রিকা, এশিয়া তথা অনুন্নত ও গরীব দেশের সাধারণ মানুষেরা এই ভ্যাকসিন সেবা কবে পাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এখনো তা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না। সুতরাং হিসেব পরিস্কার। উন্নত বিশ্বের মানুষের (কিংবা অনুন্নত বিশ্বের ধনী ব্যাক্তিদের) জীবনের মূল্য অনুন্নত বিশ্বের মানুষের জীবনের চেয়ে অনেক বেশী এটা আমাদের এই সভ্যতা আবারও প্রমাণ করলো! মুখে এবং কাগজে কলমে আমরা যা-ই আওরাই না কেন প্রকৃত বাস্তবতা এটাই। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা, অর্থাৎ স্বার্থপরতা! এবং অন্য পশুদের মতো এটি আমরাও যে আমাদের জিন ক্রোমোজমের মাঝে বয়ে বেড়াই এটা তো বৈজ্ঞানিক সত্যই। কিন্তু প্রশ্ন হলো কতোটা? এই যে হাজার বছর ধরে নিজেদেরকে সভ্য এবং সৃষ্টির সেরা জীব বলে দাবী করে আসছি, আক্ষরিক অর্থেই তার প্রমাণ আমরা কতোটুকু রাখতে পারছি? সেই পরীক্ষা দেয়ার সময় এখন কোভিড-১৯ আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। উন্নত বিশ্বের যেকোন একটা পোষা প্রাণীও যে অনুন্নত বিশ্বের একটা শিশুর চেয়ে উন্নত জীবনের সুবিধা ভোগ করে আসছে তাতো আমাদের অজানা নয়। কিন্তু এখনকার সংগ্রাম যে সরাসরি বাঁচা-মরার। আপন জনের বিদায়ে শোকের অংক যে দুই বিশ্বেই সমান এ নিয়ে তো কোন বিতর্ক থাকার কথা নয়। তাহলে কি আমাদের সভ্যতার বুলি আওরানো কেবলই ফাঁকা। একমাত্র পুঁজিই কি প্রকৃতপক্ষে এর সবকিছুর নিয়ন্ত্রক!? উত্তরটা কার কাছে চাইবো?
টরোন্টোর একটি জনপ্রিয় খবর মাধ্যম (CP24) এবং ইউরো নিউজ (Euro News) এ জানলাম, গত ৭০ বছরের মধ্যে এই প্রথম ইউনিসেফ (UNICEF) ইংল্যান্ডের স্কুল গুলোতে তাদের বাচ্চাদের জন্যে জরুরী খাবার সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছে। অবশ্যই স্বাগত জানাই এ উদ্যোগকে। কিন্তু খবরটি মস্তিষ্কের সীমান্তে দুই ভাবে নাড়া দেয়। প্রথমতঃ খবরটি দিয়ে আমরা সহজেই ধারণা করতে পারি কোভিড-১৯ ইতোমধ্যে পৃথিবীর অর্থনীতিকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, স্বাভাবিক ভাবেই যে প্রশ্নটি মাথায় আসে তা হলো, অনুন্নত বিশ্বে বছরের পর বছর, শতবছর ধরে নিজ গৃহেই শিশুরা না খেয়ে পুষ্টিহীনতায় মারা গেছে এবং এখনো যাচ্ছে। তাদের সহযোগিতায় ইউনিসেফ এর অতীত এবং বর্তমান ভূমিকা কি? পূর্ব ইতিহাসের সূত্র না হয় না-ই টানলাম। বর্তমান সময়েও তো এইসব দেশগুলোর যেকোনো ধরণের আঞ্চলিক সংঘাতে উন্নত বিশ্বই মোড়লের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং সেক্ষেত্রে নিজেদের সুবিধাটুকুর কানাকড়িও তারা ছাড় দেয় না। আর সাম্প্রতিক সমগুলোতে তো বড় কন্ঠে বিশ্বায়নের শ্লোগান তুলে যাচ্ছে। তাহলে এখন তারা এ দেশগুলোতে কোভিড-১৯ এর সেবা দিতে তেমন সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসছে না কেন? এমন একটি সন্ধিক্ষণে তাদের প্রতি এই বিমাতা সুলভ আচরণে কোন্ মানবতার নিদর্শন দেখছি আমরা? অন্তত সেবার পেশায় যারা নিয়োজিত, সেই সম্মুখ সমরের কর্মীদের জন্যেও তো কিছু ভ্যাকসিন এই দেশগুলো পেতে পারে?
কোভিড-১৯ ও একদিন ইতিহাস হবে। সেই ইতিহাসে লেখা থাকবে অনেক কিছুই। আমাদের সংগ্রাম, আমাদের যুদ্ধ, আমাদের ভোগান্তি, সাফল্য অনেক কিছুই…। কিন্তু যা লেখা থাকবে না তাহলো আফ্রিকার ইরিত্রিয়া বা এশিয়ার বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ভ্যাকসিন আবিস্কার হওয়ারও কতোটা পরে এর সেবার সুবিধা পেয়েছিলো কিংবা আদৌ কখনো পেয়েছিলো কিনা। আর এটাই হলো আমাদের শুধুমাত্র মুখবাদী সভ্যতার সত্যিকার রূপ! প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এভাবেই তো আমরা লিখে এসেছি আমাদের জয়ের আংশিক সত্য কিংবা কিছুটা ভুল, এবং কেবল বিজয়ীদেরকেই সময়ের নায়ক হিসেবে তুলে ধরার ইতিহাস! আর সে কারনেই আমি বারবার বলে আসছি আজকে যে ইতিহাসগুলো থেকে আমরা শিক্ষা নেই তার কতোটুকু সত্য, কতোটুকু পূর্ণ এবং বস্তুনিষ্ঠ তা আরেকবার ভেবে দেখা দরকার? তা নাহলে প্রকৃত মানবতা যে সবসময়ই পৃথিবীর ধুলোয় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে! এখন যেমন আছে!
_______ফরিদ তালুকদার… / ডিসেম্বর ২৩, ২০২০