সকালের নাস্তার টেবিলে সতীশ বাবু,বন্ধুর ছেলে পরিমলকে বললেন, ভার্সিটি বন্ধ, সারাদিন পই পই করে কোথায় ঘুরে বেড়াও ? না কি আবার তুমিও ওই রাজাকারদের সাথে মিলে আন্দোলন/ফান্দোলন করে বেড়াচ্ছ ? আমার বাসায় থেকে কিন্তু মোটেই এসব করা যাবে না, বুঝেছো ? পরিমল রুটি ছিঁড়ে প্লেটের ফুলকপির ভাজির একটি টুকরা রুটির ভাঁজে যত্ন করে নিয়ে মুখে পুড়ে শুধু মুচ্কি হাসলো, তবে কোনো সরাসরি উত্তর দিলো না। এই ধরণের হাসির অনেক মানে হতে পারে। একটি মানে হতে পারে, ‘কাকা কে বোঝানো যে, কি যে বলেন কাকা, আমার খেয়ে দিয়ে কাজ নেই, আমি এসব হাঙ্গামায় জড়াবো।’ অথবা আরেকটা মানে হতে পারে, ‘কাকা, খুব তো লীগের পেছনে পেছনে সারা জীবন ঘুরলেন, দেশ যে এদিকে রসাতলে যাচ্ছে সে হুঁশ আছে !’  সতীশ বাবু হয়তোবা প্রথমটি ধরে নিয়ে আস্বস্থ হয়ে নাস্তা প্রায় শেষ করে উঠতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ করে ছোট মেয়ে অর্চনার বেখাপ্পা এক প্রশ্নে ফস করে রেগে গেলেন।

অর্চনা বললো, ‘বাবা, তিনশো টাকা দিবে? আমার বান্ধবীর জন্মদিন, একটা গিফট কিনে ওদের বাসায় যাবো।’ পরিমল বাবু অগ্নিমূর্তি ধারণ করে দাঁত-মুখু খিঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, অত জন্মদিন/টন্মদিনে যাওয়ার দরকার নাই, দেশের অবস্থা ভাল না, স্কুল বন্ধ, ঘরে বসে লেখা পড়া কর, দুদিন পরে এসএসসি পরীক্ষা, এসব উশৃঙ্খল ছেলেমেদের আন্দোলন যখন ডান্ডা খেয়ে ঠান্ডা হয়ে যাবে, সুরসুর করে সবাই স্কুল কলেজে ক্লাসে ফিরে যাবে তখন তো পরীক্ষা দিতে হবে নাকি ?

কয়েক দিনের লাগাতার কারফিউয়ের কারণে পরিমল বাবু অফিসেও যেতে পারছেন না। অফিসে থাকলে কিছু রাজাকার কলিগদের দুটো কথা শুনিয়ে দিতে পারতেন। যদিও অফিসে একবার এসব কথা বলে তিনি বিবাদে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। দেশের বিশৃঙ্খলা নিয়ে রাগ মেয়ের উপর দিয়ে চালিয়ে রাগে কিড়মিড় করে সতীশ বাবু বলে উঠলেন , ‘ওরা ভেবেছে কি? রাস্তাঘাটে মিছিল মিটিং করে সরকারের পদত্যাগ করা যায় ? এই সরকারকে সরানো অত সোজা না। আওয়ামী লীগের সরকার হচ্ছে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির সরকার। যতসব রাজাকারের বাচ্চারা কাজ নেই, কি সব কোটা/ ফোটা নিয়ে আন্দোলন করছে, সেটি যখন মেনে নেয়া হলো, এখন আবার বলছে বৈষম্য দূর করবে, এদের জুতাপিটা করা দরকার।’ এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে সতীশ বাবু রাগে থর থর করে যেন কাঁপছেন। অর্চনা ভীত হয়ে দ্রুত নাস্তার টেবিল থেকে কেটে পড়লো। প্রভা রানী আগুন গরম লেবু চায়ের কাপ স্বামীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘দেশের কথা এতো ভাবার দরকারটা কি ? দেশ চলুক দেশের মতো।’

প্রভা রানী খেয়াল করেছে আজ কয়েকদিন ধরে তাঁর স্বামী অফিস থেকে ফিরে কেমন মন মরা হয়ে টিভির সামনে বসে থাকেন। যে মানুষটা খাবারদাবার এতো পছন্দ করে, সেই মানুষটির পছন্দের খাবার পরিবেশন দেখেও তেমন ভাবান্তর নেই। মাথা নিচু করে এক মনে খাবার খাচ্ছেন। কিছু একটা বললে রেগেমেগে লংকা কান্ড বাঁধিয়ে ফেলছেন। সেদিন প্রভা রানী আলু বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল রেঁধে দুপুরে পরিবেশন করেছিলেন। অন্যদিন হলে সতীশবাবু এই তরকারি দিয়ে খেতে খেতে প্রভা রানীর রান্নার প্রশংসায় ভাসিয়ে দিতেন। প্রভা রানী যখন বললেন ফ্রিজের পাল্লা ভালোভাবে লাগছে না, মিস্ত্রি ডেকে আনা দরকার। সতীশ বাবু হঠাৎ করে বললেন, মিস্ত্রি ডাকা মানে কত খরচ জানো? ফ্রিজ কীভাবে ব্যাবহার করতে হয় বাপ মা শেখায়নি? জঙ্গল থেকে এসেছো? আরও কিছু একটা বলে রেগে যেয়ে না খেয়ে টেবিল থেকে উঠে ঘরে চলে গেলেন। প্রভা রানীর চোখ ছল ছল করে উঠল। দিন দিন স্বামী চোখের সামনে দ্রুত বদলে যাচ্ছে।

আসলে শুধু সতীশ বাবু না, আরও অনেকেই দ্রুত বদলে যাচ্ছেন, অস্থিরতায় ভুগছেন। এনারা দীর্ঘবছর বিশেষ রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন অথবা প্রকটভাবে সমর্থন দিয়ে গেছেন। এনারা ইদানিং একধরণের মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। একদিকে নেতা-মন্ত্রীর বেশ বেপরোয়া কথাবার্তা,  দুর্নীতি, সরকারের অনমনীয় একগুঁয়ে সিদ্ধান্ত আবার অন্যদিকে বিএনপি ও জামাতের সমর্থনপুষ্ট কিছু ছেলেমেয়েদের সরকার বিরোধী ও নাশকতামূলক আন্দোলন। চোখের সামনে এতো বছরের পুরোনো স্বাধীনতার চেতনাবাহী এই দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে এনারা বেশ উদবিগ্ন ও উত্তেজিত হয়ে কিছুটা দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলছেন। এদিকে প্রতিদিন যাচ্ছে, আর ছাত্র-জনতার লাশের মিছিল বাড়ছে। নির্বিকারভাবে সেসব লাশের মিছিল সতীশ বাবুদের মতো বিশেষ রাজনীতির সাথে যুক্ত কিছু বাংলাদেশিদের অন্তরকে স্পর্শ করতে পারছে না ।

সতীশ বাবু চায়ের কাপ হাত নিয়ে বারান্দায় একটি চেয়ার টেনে বসে আরাম করে একটি সিগারেট ধরালেন। সতীশ বাবু সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধুম্রকুণ্ডলীর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে আজ কয়েকদিন ধরে তাদের বাসায় থাকা বন্ধুর ছেলে পরিমলের কথা ভাবলেন। প্রথম দিন থেকেই সতীশ বাবুর সন্দেহ হয়েছিল ছেলেটি নির্ঘাত এই সরকার বিরোধী আন্দোলনের সাথে হয়তো জড়িত। সকাল বেলায় হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায় আবার কারফিউ একটু শিথিল হলে সুরসুর করে ঘরে ফিরে আসে। ওর বাবা নগেনকে ব্যাপারটা জানানো দরকার। সতীশ বাবুর মাথায় একটি বুদ্ধি এল। এত বছর রাজনীতি করেছেন, কত মানুষের সাথে ওঠাবসা করেছেন আর এই পুঁচকে ছোড়ার পেট থেকে কথা বের করা যাবে না, এটা একটা কথা হলো ! তিনি মোলায়েমভাবে উঁচু গলায় ডাকলেন, বাবা পরিমল, কই গেলে বাবা, আসো এদিকে দুটা গল্প করি’।

পরিমল নাস্তা শেষ করে অর্চনাকে কিছু হোমওয়ার্ক করতে দিয়ে ডাইনিং টেবিলে ফিসফিস করে শ্যমলীর সাথে কথা বলছিল। ‘সরকারের অবস্থা একেবারেই বেকায়দা,  গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলার প্রতিবাদে কাল থেকে সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এর সমন্বয়কগণ নতুন প্রোগ্রামের ডাক দিয়েছেন, নাম দিয়েছেন ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ মানে হচ্ছে ন্যায়বিচারের জন্য পদযাত্রা, যেভাবে আন্দোলন এগুচ্ছে সরকারের গদি নড়বড় করছে। মনে হচ্ছে আরেকটু ধাক্কা দিলেই পড়ে যাবে। কথার মাঝ খানে বাজখাই গলায় সতীশ কাকার ডাকে পরিমল ধড়ফড় করে উঠে কাকার সাথে দেখা করতে বারান্দায় গেল। সতীশ বাবু বললেন:

‘তুমি আমার বন্ধুর ছেলে, মানে আমারও ছেলে। নাস্তার টেবিলে কি বলতে কি বলেছি ওসব মনে রেখো না বাবা।’ বোঝইতো বাবা, বয়েস হয়েছে, অফিস বন্ধ, সারাদিন বাসায় থেকে থেকে মেজাজটা খিঁচড়ে থাকে। তো বাবা, এই যে এখানে আছো, তোমার অসুবিধা- টুবিধা হচ্ছে না তো ? পরিমল কাচুমাচু করে বললো, ‘কি যে বলেন কাকা, অসুবিধা হবে কেন, ভালোই তো আছি।’ এবার ধূর্ত পরিমল উল্টা দিক থেকে কথা শুরু করলেন, ‘আচ্ছা, পরিমল তোমরা তো যুবক ছেলে। আমাদের সময়, আমরা যুবক থাকা অবস্থায় নব্বইয়ের এরশাদ খেদানো আন্দোলন করেছি, এরশাদের পতন ঘটিয়েছি, সরকারের অন্যায় অত্যাচার রাজপথে সরব থেকেছি, তোমাকে দেখি মিন মিন করে ঘরে বসে ছাত্রী পোড়াচ্ছ, সরকার যেভাবে কামড় মেরে ক্ষমতায় বসে ছেলে-মেয়েদের গুলি করে মারছে, এত এত মন্ত্রীরা চারপাশে আছে, সরকারকে ভালো বুদ্ধি না দিয়ে সবাই মুখে মুখে থাকছে, সাফাই গেয়ে যাচ্ছে, তলে তলে দুর্নীতি করে একেকজন দেশের বারোটা বাজাচ্ছে, তোমার কি মনে হয়, কোন দিকে যাচ্ছি আমরা বাবা?
প্রিয় পাঠক, আগেই বলেছি, জেন-জি ছেলেমেয়েরা বেশ স্ট্রেটফরওয়ার্ড। এঁরা বয়োজোষ্ঠদের মারপ্যাচ তেমন একটা ধরতে পারে না। বোকা পরিমল ধূর্ত সতীশ বাবুর ফাঁদে পা দিয়ে হড়হড় করে বললো, ‘কি যে বলেন কাকা, আমাদের ইউনিভার্সিটির ছেলে -মেয়েরাই তো এই আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারীদের কয়েকজন, আমরা সরকারের কারফিউ না মেনে প্রতিদিন রাজপথে আন্দোলন করছি। আর এই সরকার বলছেন, এই সরকার তো একেবারেই তালবেতাল অবস্থায় আছে, যে কোনো মুহূর্তেই…। পরিমল তার মুখের কথা শেষ করতে পারলো না। সতীশ বাবু সিংহের মতো গর্জে উঠে চিৎকার করে বললেন, ‘তুমি তাহলে ওই রাজাকারদের সাথে মিলে দেশদ্রোহী আন্দোলন করছো ? লজ্জা করে না, সরকারের নুন খেয়ে বেইমানি করে সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে এত সাহস কই পাও ? তোমার বাবা এসব জানে ?

সতীশ কাকার এই আকস্মিক পরিবর্তনে হকচকিয়ে চেয়ে বড় বড় চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে পরিমল। ফ্রিজ থেকে হিমশীতল খাবারের কাঁচের বাটি মাইক্রোওভেনে গরম করলে হঠাৎ উচ্চ তাপমাত্রার দ্রুত পরিবর্তনে কাঁচের বাটি ক্র্যাক হতে দেখা যায়। জেড প্রজন্মের সহজ সরল যুবক পরিমলের মস্তিষ্কেও এরকম কিছু পরিবর্তন দেখা গেল। কিন্তু, এসবে সতীশ কাকাদের কিই বা এসে যায় ! সতীশ কাকা পূর্বাপেক্ষা  আরো উত্তেজিত হয়ে নির্দয় আচরণ করলেন পরিমলের উপর। তিনি বললেন, ‘ যাও, ভাগো, আমার বাড়ি থেকে, এই মুহূর্তে ব্যাগ গোছায়ে চলে যাও, রাজাকারের বাচ্চাদের সাথে হাত মিলায়ে আন্দোলন করো, সরকারের কিচ্ছু করতে পারবে না। আমি এক্ষুনি, তোমার বাবাকে ফোন করে সব বলে দিচ্ছি ‘।

এতক্ষনে শ্যামলী, অর্চনা, প্রভা রানী সবাই বারান্দায় চলে এসেছে। ভয়ে সতীশ বাবু আর পরিমলদের থেকে খানিকটা দূরত্বে সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে এক সরকার অনুরাগী দেশপ্রেমিক সতীশ বাবুর স্বদেশপ্রেমের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এঁদের সবার চোখেই জলে টলমল করছে। পরিমল শান্ত হয়ে ঘরে যেয়ে ব্যাগ গুছিয়ে দরজা খুলে বাইরে গেল। বাইরে তখন অঝোর ধারায় ঢাকা শহরে শ্রাবনের বৃষ্টি বর্ষণ হচ্ছে। বাসার পাশেই জিগাতলার বড় রাস্তার ইলেকট্রিক তারে কয়েকটি কাক কা কা করে চিৎকার করছে। ডাস্টবিনের পাশে একটি নেড়ি কুকুর ভেউ ভেউ করছে। পশুপাখিদের ভাষা আমাদের জানা নেই। পশুপাখিরা নাকি আগাম অনেক কিছু বুঝতে পারে। তবে আজ পশুপাখিরা কি এই তথাকথিত দেশপ্রেমিক সতীশ বাবু আর দেশদ্রোহী পরিমলের কথোপকথন শুনে আগাম কোনো বার্তা টের পেয়ে চিৎকার করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে !! পরিমল শুনতে পেল যেন আকাশ থেকে ভরাট গলায় কেউ বলছে, ‘মন খারাপ করো না হে যুবক। বিরাট একটি পরিবর্তন অতি সন্নিকটে !!’

জুলাই ৩১ তারিখে সকালে নাস্তার টেবিলে পরিমল শ্যামলীকে যা বলছিলো তা আরো পরিষ্কার ভাবে শোনা যাক। পত্রিকার খবরে পাওয়া যায়, ‘মঙ্গলবার রাত সোয়া ১১টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল কাদের এই ঘোষণা দেন। দুপুর সাড়ে ১২টায় এ কর্মসূচি পালন করা হবে। কর্মসূচির ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা, গুম–খুনের প্রতিবাদে এবং জাতিসংঘ কর্তৃক তদন্তপূর্বক বিচারের দাবিতে, ছাত্রসমাজের ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দেশের সব আদালত, ক্যাম্পাস ও রাজপথে আগামীকাল বুধবার “মার্চ ফর জাস্টিস” কর্মসূচি পালন করা হবে।’ ঘোষণায় আরও বলা হয়, ‘আমরা সারা দেশের শিক্ষক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, পেশাজীবী, শ্রমজীবী ও সব নাগরিককে আমাদের কর্মসূচি পালনে সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং আমাদের দাবি আদায়ের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।’ (সমকাল, প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২৪ | ০৩:৪৭)

পরিমল বৃষ্টিতে জুবুথুবু হয়ে ভিজে রিক্সা নিয়ে হাইকোর্ট প্রাঙ্গনের দিকে রওনা হলো। আজ বুধবার সেই “মার্চ ফর জাস্টিস” কর্মসূচি।’ আজ দুপুরে সারা দেশের আদালত পাড়ায় চলবে এই কর্মসূচি। পরিমল দুপুরের আগেই হাইকোর্ট মাজার রোডে ঢুকতেই দেখতে পেলো শত শত ছাত্র-জনতা নানান রঙিন প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মুহূর্তে দেরি না করে রিকশার ভাড়া মিটিয়ে মিছিলে মিশে গেল পরিমল। আধা ঘন্টাখানিক পরেই বিশাল মিছিল এগিয়ে চলছে হাইকোর্টের দিকে স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত চারিদিক। হঠাৎ করে কয়েকটি পুলিশ ভ্যান সাইরেন বাজিয়ে মিছিলের সামনে পথ রোধ করে থামল। দ্রুত কিছু পুলিশ সদস্য ভ্যান থেকে নেমে এলোপাথাড়ি ভাবে লাঠি পেটা শুরু করল। মিছিল থেকে কিছু ছাত্র জনতা দৌড়ে সরকারবিরোধী স্লোগান দিতে দিতে আদালতের মধ্যে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল। চারিদিকে কানে তালা লাগানো গোলাগুলির শব্দ। হুট করে পুলিশের একটি লাঠির আঘাত এসে পড়ল পরিমলের মাথায়। জ্ঞান হারাল পরিমল।

৩১ জুলাই ব্যাপক ধরপাকড়ের পরে বৈষম্যবিরোধী আন্দলোনের সমন্বয়কগণ শুক্রবার সারাদেশের নিহিত শহীদদের স্বরণে দেশের সব মসজিদে বিশেষ দোয়ার আহব্বান জানালেন। এর আগে ৩০ জুলাই মঙ্গলবার সরকারিভাবে সারা দেশের নিহিতদের স্বরণে এক লোক দেখান শোকদিবস পালন করা হলো। সরকারি কর্মচারীগণ এবং সরকার সমর্থিত পার্টির নেতৃত্বে কিছু বাংলাদেশি  কালো ব্যাজ ধারণ করে শোক পালন করলেন। দেশবাসী ‘গরু মেরে যেন জুতা দান’- এর ঘটনা অবলোকন করলেন। কিন্তু আপামর ছাত্রজনতা কাল ব্যাজের বিপরীতে নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার লাল করে নিহিতদের সম্মানার্থে লাল বিপ্লবের নিশানা লাগিয়ে মাসমিডিয়া গরম করে রাখলেন।

৩১ জুলাইয়ের পরে ১ আগস্ট তারিখে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা ছয় সমন্বয়ককে দুপুরে ছেড়ে দেয়া হলো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাগণ ২ আগস্ট শুক্রবার ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি ঘোষণা করলেন। ২ আগস্ট সেই ছাড়া পাওয়া সমন্বয়ককগণ প্রকাশ্যে জানালেন যে আন্দোলন প্রত্যাহার করে ভিডিও বিবৃতিটি তারা তাঁরা স্বেচ্ছায় দেননি। জ্বলে উঠলো আপামর ছাত্র-জনতা।

আমি দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে সুদুর প্রবাসে বসে ২০২৪ এর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা জানিয়ে আমার ফেসবুক প্রোফাইলে আমাদের দুজনের রোমান্টিক ছবি সরিয়ে বিপ্লবীদের রক্তের লাল রঙে রাঙিয়ে রাখলাম। আমার দেখাদেখি ছেলে অর্নব এবং স্ত্রী মিতাকেও দেখা গেল প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করে লাল করে রেখেছেন। সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিরা লাল ও কালো রঙে বিভক্ত হয়ে পড়লেন। একে অপরকে হেয় করে ফেসবুকে পোষ্ট দিতে থাকলেন । ওপারে আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ সহস্রাধিক নিহিতদের আত্তাদের অবস্থান আমাদের জানা নেই। মৃত মানুষদের প্রতিক্রিয়া জানার বা দেখার কোনো যন্ত্র বিজ্ঞানীগণ এখনও আবিস্কার করতে পারেননি। পারলে হয়ত দেখতেন তাঁদের আত্তাগুলো ফেসবুকের লাল প্রোফাইলধারীদের পক্ষ নিয়ে সরকার পতন দেখার অপেক্ষায় ব্যাকুলভাবে তাঁদের অপার্থিব নয়নে তাকিয়ে আছেন।

আগের পর্বগুলি –
পর্ব ১-পর্ব ১
পর্ব ২-পর্ব ২
পর্ব ৩-পর্ব ৩
পর্ব ৪-পর্ব ৪
পর্ব ৫-পর্ব ৫
পর্ব ৬-পর্ব ৬
পর্ব ৭-পর্ব ৭
পর্ব ৮-পর্ব ৮

পূর্ববর্তী নিবন্ধহালচাল : তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে স্বচ্ছতার অভাব
পরবর্তী নিবন্ধহালচাল : কানাডার জীবন কঠিন তবে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন