এদেশে হোমলেসদের নিয়ে প্রায় বছর পাঁচেক কাজের অভিজ্ঞতা থেকে প্রায়ই মনেহতো, এঁদের নিয়ে একটা গল্প উপন্যাস লিখলে কেমন হয়, সাহস করে তাই ওদের নিয়ে উপন্যাস লেখার দুঃসাহস নিয়ে কয়েক পাতা লিখে ফেললাম। ইচ্ছা আছে, পাঠকের মতামত নিয়ে পুরোটা শেষ করার ইনশা আল্লাহ..
*****************************************************************************************************************
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়। টরন্টো শহরে গাছের পাতাগুলি সবেমাত্র রং বদলাতে শুরু করেছে। শীত শুরু হতে এখনো ঢের বাকি। তবুও খুব সকালে অথবা রাতের দিকে মোলায়েম ভাবে কিছুটা হালকা ঠান্ডা-র ভাব থাকে। অনেকটা বাংলাদেশের আশ্বিন মাসের মতো। নিজাম উদ্দিনকে এই সাতসকালে দেখাগেলো হাইওয়ে ৪০০ -এর ফিঞ্চ নামক সড়কের পূর্ব দিকের এক্সজিট -এর এক পাশে জুবুথুবু হয়ে বসে আছেন। সোমবারের ব্যাস্ত সকাল। ধীর লয়ে সার বেঁধে গাড়িগুলো হাইওয়ে র্যাম্প পাড়ি দিয়ে শো শো শব্দতুলে ছুটছে উত্তর দিকে। আবার ঠিক পাশেই অন্য র্যাম্প বেয়ে উত্তর দিক থেকে গাড়িগুলো শৃঙ্খল ভাবে হাইওয়ে থেকে বের হয়ে হয়তো নিজ নিজ বাসার দিকে ছুটছে সারারাতের কাজের ক্লান্তি নিয়ে অথবা কে জানে কেউবা যাচ্ছে কাজে যোগদিতে। একেক গাড়ি চালকের একেক রকম উদ্দেশ্য।তবে নিজাম উদ্দিনের কোনো উদ্দেশ্য নেই। একরকম উদ্দেশ্যহীন হয়ে বসে থাকাটা নিজাম উদ্দিনের অনেকটা অভ্যাস হয়েগেছে। মাথায় অনেকদিনের পুরানো বিলাতি কায়দায় টুপি, গায়ে কিছুটা নোংরা বাদামি রঙের ভারী জ্যাকেট-এর ভিতর থেকে শার্টের ছেড়া কলার কিছুটা বাহির থেকে স্পষ্ট দেখাযাচ্ছে। গায়ের রং বেশ ফর্সা হওয়ায় নিজাম উদ্দিনকে এক কোথায় অবিকল এদেশের টিপিক্যাল হোমলেসদের মতো দেখাচ্ছে। নিজাম উদ্দিনের অধিকাংশ সময় এখানেই কেটে যায়। নিজাম উদ্দিন অপেক্ষায় থাকে হাইওয়ে থেকে ফেরা গাড়িগুলোর জন্য ।স্লো হয়ে আসা গাড়িগুলো র জানালার কাছে এসে মুখে মায়া মায়াভাব করে চোস্ত বিলাতি কায়দায় নিজাম উদ্দিন মাথার টুপে সামনের দিকে বাড়িয়ে দেন। আর গাড়িগুলি বের হয়ে লালট্রাফিক লাইটের সিগনালে আটকে পড়লে নিজাম উদ্দিনের জন্য বেশ আশীর্বাদ বয়ে আনে। এক্ষেত্রে নিজাম উদ্দিন নিজের দারিদ্রতা, অসহায়ত্ব গাড়িচালকদের ভালোভাবে বুঝানোর সুযোগ পেয়ে থাকেন বেশি সময় নিয়ে। তাতেই সফলতা আসে। কখনো ভাংতি পয়সা কখনো পাঁচ ডলারের নোট , কখনোবা পানির বোতল ইত্যাদি। একসময় প্রতি মাসের শেষ সপ্তাহে সরকার থেকে তিনি নিয়োমিত বেকারভাতা পেতেন। বেকারভাতা দিয়ে মোটামুটি ভাবে নিজাম উদ্দিন সাহেবের একজনের সংসার প্রায় বছর সাতেক হলো নির্ঝঝা ট ভাবে চলছিল । একেবারেই যে নির্ঝঝাট তা হয়তো বলা ঠিক হবেনা । এই যেমন বছর পাঁচেক আগে বেকার ভাতার পুরো টাকা তুলে ডাউন টাউনের এক মদের দোকানে গলা অবধি ছাইপাশ গিলে একেবারে বেহুশ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। পরে শুনেছিলেন, বেহুস অবস্থায় পুলিশের সহাযতায় হাসপাতালে ছিলেন দেড় দিন। এই দেড়দিন নিজাম, উদ্দিন মোটামুটি ভালোই খাতির যত্নের মধ্যে কাটিয়েছেন। তিন বেলা নিয়মিত খাবার, থাকার জন্য উষ্ণ বেড। সন্ধ্যার দিকে এক হাসপাতালের নার্স, ডাক্তার-এর পাশে খাটো মতো এক ভারতীয় যুবক নিজাম উদ্দিনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন হ্যান্ড সেকের জন্য এবং খাঁটি বাংলায় জিজ্ঞাসা করলেন :
“কেমন আছেন নিজাম সাহেব?”
বেশ কিছুক্ষন বিস্ময়ের ঘোর কেটে নিজাম উদ্দিন সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, ” ভালো’।
“আপনার পকেটে পাওয়া হেলথ কার্ড দেখলাম। এতো অনেক বছর আগেই মেয়াদ শেষ হয়েছে, রিনিউ করেন না কেন?”
নিজাম উদ্দিন ফ্যাল ফ্যাল করে উদাস ভাবে জানালা-র দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এই যুবকের প্রশ্নের তার কাছে কোনো উত্তর নেই। হেলথ কার্ড রিনিউ করতে হলে একটি নির্দিষ্ট এড্রেস দরকার হয়। নিজাম উদ্দিনের তো কোনো এড্রেস নেই। স্বৃতি-র পাতা থেকে ভেসে উঠে ছোটবেলায় বেড়ে উঠা বাড়ি-র ছবি। জামালপুর শহর থেকে অদূরে রেললাইন ঘেঁষে অনেকটা জমিদার বাড়ি-র আদলে গড়া দোতালা দালান বাড়িটি-র কথা মনে হতেই বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠে। ডাক্তারের পাশে থাকা ছেলেটি-র কোথায় সম্বিৎ ফিরে পায় নিজাম উদ্দিন। “আপানে চাইলে আপনাকে আমরা একটি শেল্টারের ব্যাবস্থা করে দিতে পারি । থাকা-খাওয়া-র কোনো চিন্তা করতে হবেনা। আপনার চিকিৎসাও চলবে” । এবার, নিজাম উদ্দিন চোয়াল শক্ত করে জবাব দিলেন, “না”। শেল্টারের কথা শুনলেই রাগে শরীর জ্বলে যায়। সেবার প্রায় সপ্তাহ দুয়েক হলো নিজাম উদ্দিন টরন্টো ডাউন টাউনের একটি শেল্টারে ছিল। এক মাঝবয়সী যুবক প্রায়ই জ্বালাতন করতো। একদিন সেই যুবক, গাঁজা খেয়ে মাতাল হয়ে নিজাম উদ্দিনের কাছে সিগারেট চাইতে এসেছিলো। সিগারেট না দিতে চাওয়ায় কথা কাটাকাটি, এক পর্যায়ে হাতাহাতি হয়েছিল। নিজাম উদ্দিনের ঠোঁট কেটে একেবারে রক্তারক্তি অবস্থা। পরে, শেল্টারকর্মীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিনে আসে । এছাড়া, শেল্টারের নিয়মে বাধা জীবন নিজাম উদ্দিনের তেমন পছন্দ নয়। এই যেমন, এমপ্লয়মেন্ট কাউন্সেলিং ক্লাসে নিয়মিত এটেন্ড করা, শেল্টার কর্মীর সাথে নিয়মিত বৈঠক, শৃঙ্খলিত জীবন-যাপন ইত্তাদি নিজামুদ্দিনের পছন্দ না। সে চায় স্বাধীন ভাবে নিজের মতো করে থাকতে। তারপরেও নিজাম উদ্দিন প্রায় মাস সাতেক ছিল ওই শেল্টারে। তারপরে ছোট্ট একটি ব্যাগ নিয়ে ওই যে বেরিয়ে পড়লো শেল্টার থেকে আর ফেরা হয়নি। তাই শেল্টারের কথা নিজাম উদ্দিন তেমন শুনতে চায় না। হাসপাতালের সোশ্যাল ওয়ার্কা যুবকটির কোথায় আবারো নড়েচড়ে ওঠে নিজাম উদ্দিন। “কিন্তু আপনার সুগার লেভেল অনেক বেশি, ব্লাড পেসারেও স্বাভাবিক না।” নিজাম উদ্দিন নিরুত্তর থাকে। নিজাম উদ্দিন ভালো করেই জানে, এসব দেশে জোর-জবরদস্তি করে রোগীকে কোনো সিদ্ধান্ত এরা চাপিয়ে দিতে পারেনা । “হাসপাতাল থেকে বের হয়ে কোথায় যাবেন, কিছু ঠিক করেছেন ?” নিজাম উদ্দিন আবারো চুপ চাপ থাকে। আবারও কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে উঠে নিজাম উদ্দিন । এই ১০/১৫ বছর আগেও এই টরন্টো শহরে তার কতোইনা বন্ধু -বান্ধব ছিল।সবই এখন কেবল অতীত। অবশেষে, নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে, চোয়াল শক্ত করে দুপ দুপ করে পা ফেলে ডাক্তার, নার্স, সোসাল ওয়ার্কের সবাইকে পাশ কাটিয়ে হন হন করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পরে নিজাম উদ্দিন। খানিকটা এগিয়ে ট্রাফিক সিগনালে ধীর স্থির ভাবে রাস্তা পার হয়ে, ওভার ব্রিজের নিচে একপাশে পিঠ থেকে হ্যান্ড ব্যাগ নামিয়ে রেখে সবুজ ঘাসের উপর বসে পরে নিজাম উদ্দিন। হাইওয়ে ৪০০ ও ফিঞ্চের কাছে ওভার ব্রিজের নীচে এ দিকটা কিছুটা নিরিবিলি। আসে পাশে বাঙালিদের আনাগোনাও বেশ কম। জায়গাটা বেশ ভালোই লাগে নিজাম উদ্দিনের। সেই থেকে আজ অবধি বছর দুয়েক হলো সেই যে এই দিকটায় শিকড় গেড়ে বসেছে নিজাম উদ্দিন আর কোথাও তেমন যাওয়া হয়ে ওঠেনি। প্রচন্ড শীতের সময় তাপমাত্রা যখন শূন্য ডিগ্রি-র অনেক নিচে চলে যায় নিজাম উদ্দিনের বেশ বেকায়দায় পরে যায়। স্থানীয়ও হোমলেস দেড় মতো মাঝারি সাইজের কম্বল গায়ে জড়িয়ে মাথার নিচে হার্ডবোর্ড দিয়ে রাস্তার পাশে ঘুমিয়ে পড়ার এখনো তেমন অভ্যাস হয়ে ওঠেনি। তাই, খুব শীতের সময় নিজাম উদ্দিনকে টিমহর্টন, এ, টি, আমি মেশিন বুথ অথবা হাসপাতাল চত্বরে রাত কাটাতে হয়। সামারের সময় কোনো কথাই নেই। ওভার ব্রিজের নিচে গায়ে মাথায় চাদর মুড়ে দিয়ে শুয়ে দিব্বি সারা রাত চমৎকার ঘুমে কাভার করা যায় । এই যেমন গতরাতে ওই ওভার ব্রিজের নিচের এক কোনায় মোটামুটি ভালোই ঘুম দিয়েছিলো নিজাম উদ্দিন। এমনকি শেষ রাতের দিকে একটা স্বপ্নও দেখে ফেললো। আজ এই সকালবেলা বসে বসে গত রাতের স্বপ্নের কথা ভাবতে থাকে নিজাম উদ্দিন । “দেশ থেকে নতুন বিয়ে করা স্ত্রী ‘রুপা’কে নিয়ে টরেন্টো এয়ারপোর্ট থেকে ভাড়া করা ট্যাক্সি নিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্কে বাড়ি যাচ্ছে নিজাম উদ্দিন। বন্ধু বলতে ছেলেবেলার বন্ধু একরামকে বলেছিলো এয়ারপোর্টে আসতে।শালা ফোন করে বলে কিনা “দোস্ত, মাফ করে দে , কাজ পড়ে গেছে , আসতে পারবোনা। আসলে ব্যাটা ফাজিলের ফাজিল। ফ্যাক্টারিতে শনিবার বিকালে আবার কাজ কিসের? হাইওয়ে ৪০১ এর উপর দিয়ে প্রচন্ড বেগে ট্যাক্সি যাচ্ছে সোজা পূর্ব দিকে। সন্ধ্যা ও রাতের সন্দিক্ষনে পরিষ্কার আকাশে প্রকান্ড চাঁদের ফালি। ঝকঝকে আকাশে কোটি কোটি তারা চিক চিক করছে ।সারি বেঁধে গাড়িগুলো শো শো শব্দ করে ছুটছে দুই দিক থেকে। একই দিক থেকে যাওয়া গাড়িগুলির পিছনদিকের লাল আলো আর বিপরীত দিক থেকে আশা গাড়ি গুলোর হেড লাইটের হলুদাভ আলো , কি অদ্ভুত দেখাচ্ছে ।সকল আলো ছাপিয়ে আনন্দিত, উৎসুক চাহুনিতে রুপার মুখের হাসি যেন লক্ষ কোটি পাওয়ারের বাতি-র চেযেও দীপ্তময় জ্যোতি ছড়াচ্ছে। আর বালিকার মতো কি যে একের পর এক অদ্ভুত প্রশ্ন:
“এই এখানকার মানুষরা কি ভাত খায়? শুনেছি এখানে মেয়েছেলের নাকি প্রায় উলঙ্গ হয়ে বাহিরে ঘোরাফেরা করে। আমাকে কি শার্ট/প্যাণ্ট পড়তে হবে? নায়েগ্রা জলপ্রপাতএখান থেকে কতদূর?” নিজাম উদ্দিন অসীম ধর্য্য নিয়ে একনাগাড়ে উত্তর দিতে থাকে। ভাগ্যিস ট্যাক্সি ওয়ালা বাংলা জানে না। না হলে কি যে কেলেঙ্কারি ব্যাপার হতো কে জানে। এটি কেবলিই স্বপ্ন। নিজাম উদ্দিনের জীবনে এ ঘটনাটি কখনই ঘটেনি। এটি নিছক মনগড়া কল্পনা মাত্র যা নিজাম উদ্দিনের মনের অনেক গভীর হয়তো বাসা বেঁধে আছে বহু বছর আগে থেকে । আর তাই, এই স্বপ্নটি নিজাম উদ্দিন মাঝে মাঝে দেখে । এই প্রথিবীতে কত রহস্যই না ঘটে। বাস্তব জীবনে নিজাম উদ্দিন এয়ারপোর্ট থেকে বন্ধু একরামের সাথেই ওর ভ্যানে করে বাসায় এছেছিলো। মাঝপথে লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে রুপা বললো,”এই, গাড়ি থামাতে বোলোতো , বাথরুমে যেতে হবে। অগত্যা একরামকে হাইওয়ে থেকে দ্রুত এক্সজিট নিয়ে কাছাকাছি একটি পিৎজ্জা-র দোকানের সামনে গাড়ি পার্ক করতে হলো। একরাম মহা আঁনন্দে একটি এক্সট্রা লার্জ পিৎজা অর্ডার দিলো সাথে তিনটি কোকের ক্যান। নিজাম উদ্দিন বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে, একরাম বিপুল উৎসাহ নিয়ে রুপাকে পিৎজা-র মহাত্ম বর্ণনা করছে আর রুপা মন্ত্র-মুগ্ধ হয়ে একরামের কথা গোগ্রাসে গিলছে । কি কোথায় যেন দুজনেই হেসে গড়াগড়ি। ওদের হাসির শব্দ তরঙ্গায়িত হয়ে কোনো এক অজানা আশংকায় নিজাম উদ্দিনের বুকে কোথায় যেন খচ করে উঠলো। ছিঃ, কি যা তা ভাবছে, পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে নিজাম উদ্দিন রুপার মুখোমুখি বসে। রুপার কিছুটা গা ঘেঁষে গপ গপ করে পিৎজা খেযে চলেছে একরাম। প্রায় ছত্রিশ বছর আগের কথা অথচ এখনো চোখের সামনে পরিষ্কার দেখতে পায় নিজাম উদ্দিন। আজ এই ভোরে কে জানি স্বপ্নটি দেখার পর থেকে ঘুরে ফিরে কেবলি রুপার কোথায় মনে হচ্ছে। বিয়ের আগে নিজাম উদ্দিন একরাম সহ আরো কিছু বাংলাদেশী ব্যাচেলর যুবকদের সাথে মেস টাইপের একটি এপার্টমেন্টে থাকতো। বেড প্রতি মাত্র মাসে ৩০০ টাকা ভাড়া । একটি কমন বাথরুম ও কমন কিচেন।কাজ শেষে বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা।দিনগুলি ভালোই চলছিল নিজাম উদ্দিনের। বিয়ের পরে নিজাম উদ্দিনের আর একরামদের সাথে মেসে ফেরা হয়ে উঠেনি। ভিকটোরিয়া পার্ক এবং ডানফোর্থ ইন্টারসেকশনের কাছাকাছি হাইরাইজ বিল্ডডিং -এ রুপাকে নিয়ে একটি দুই বেড রুমের ভাড়া করা এপার্টমেন্টে ওঠেছিল নিজাম উদ্দিন। কি ব্যাস্ততার মধ্যেই না কেটেছে দিনগুলি। সম থেকে শুক্রবার , একটানা ফ্যাক্টারীর রাতের শিফ্টের কাজ। তারপর উইকেন্ডে বন্ধুদের সাথে আড্ডা। একবার শনিবারের রাতে একরামদের মেসের সবাইকে বাসায় দাওয়াত করেছিল নিজাম উদ্দিন। শনিবার সকাল সকাল রুপাকে নিয়ে বাংলাদেশি গ্রোসারি থেকে বাজার করে হরেক রকমের রান্নার আয়োজন। গরুর মাংস রান্না করে অনেকটা কোরবানির মাংসের মতো করে বেশি করে পিঁয়াজ রসূন-এর কুচি দিয়ে ভাজি ভাজি করা, মৃগেল মাছের দোপেঁয়াজা, মৃগেলের মাথা আর মুগডাল দিয়ে মুড়িঘন্ট, পটল লম্বা লম্বা ফালি করে ভেজে ওর উপরে পিয়াজের বেরেস্তা বিছিয়ে দেওয়া, খাসির রেজালা, আর কত রকমের যে ভর্তা। খাবারের পরে আবার জম্পেশ আড্ডা। খাবার শেষে রুপা আব্দারকরলো মিষ্টি পান খাবে। একরামের সে কি আগ্রহ। মাঝরাতে ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়লো পানের খোঁজে। প্রায় ঘন্টাখানিক পরে একরাম সত্যি সত্যিই মিষ্ট পান এনে হাজির। রুপার সে কি আন্নন্দ। নিজাম উদ্দিন খেয়াল করে , একরামের হাত থেকে পান নিতে যেয়ে আনন্দে আত্মহারা রুপা বোধ হয় একটু বেশি সময় নিলো। রুপার এই আনন্দ মুখ শুধুই কি এই মিষ্টি পানের জন্য নাকি পান নিতে যাওয়ার সময় হয়তো কে জানে একরামের হাতের কিছুটা স্পর্শএর জন্য। পান খেয়ে আবারো আড্ডা। একরাম একেকটা জোকস বলছে, আর সবাই হেসে গড়াগড়ি। আর রূপাতো একেবারে হেসে কুটি কুটি। পান খেয়ে রুপার ঠোঁট লালচে হয়ে আছে। অতিরিক্ত হাসার কারণে রুপার ফর্সা গাল বেয়ে পানের রস গড়িয়ে পড়ছে। এই মাঝরাতে রুপাকে দেখতে অবিকল হিন্দুদের দেবীর মতো মনে হচ্ছে। রুপার সেই পান খাওয়া উজ্জ্বল মুখ এখনো নিজাম উদ্দিনের মনে গভীর ভাবে গেথে আছে। দেশ থেকে সদ্য আসা সরল বালিকাবধূ কত সহজেই না নতুন কিছুতে আকৃষ্ট বোধকরে. এই আকর্ষণে হয়তো কোনো পাপ নেই, কেবল শুধুই সরলতা। কিন্তু, এই বিচিত্র পৃথিবীতে একরামদের মতো অনেক লোভী মানুষ আছে যারা এই সরলতাকে পুঁজি করে অদ্ভুত ধরণের এক আনন্দ পায়।
এভাবে কেটে যায় আরো কিছু বছর। মাঝে রুপার কোল জুড়ে এলো বড় ছেলে। রুপার নামের প্রথম অক্ষেরের সাথে মিল রেখে ছেলের নাম রাখা হলো “রিফাত”। বছর তিনেক পরে রিফাতের বোনের জন্ম হলো। নিজাম বায়না ধরে , এবার মেয়ের নাম বাবার সাথে মিলিয়ে নাম রাখতে হবে “নাজমা”। রুপার সেকি আপত্তি। ওর কথা, নাজমা অনেক পুরানো ক্ষেত কিছিমের নাম। যাহোক, জয় হয় নিজাম উদ্দিনের। রুপার আপত্তি-র মুখেও মেয়ের নাম রাখা হলো নাজমা। মেয়েদের নামের শেষ অক্ষরে মা শব্দ থাকলে নিজাম উদ্দিনের বেশ ভালোই লাগে। মেয়েকে ডাকলেই মা-এর কথা মনে করে দেয়। রুপা অবশ্য ছেটে ফেলে মেয়েকে নাজু বলে ডাকে। নিজাম উদ্দিনের এতে কোনো আপত্তি নেই। এ পৃথিবী যে কেবল তার ইচ্ছাতেই চলবে এটা ভাবা ঠিক না । মা দের ইচ্ছাকেও অনেক সময় প্রাধান্য দিতে হয় ।ভালোই চলছিল দিনগুলি। কোথাথেকে কি যেন হলো এক ঝটকায় সব ওলোটপালোট হয়ে গেলো। প্রথম যে ঘটনাটো ঘটলো তা হলো, একদিন সকালবেলায় পাশ ফিরে দেখে বিছানায় রুপা নেই। বাংলা সিনেমার মতো একটি চিরকুটে লেখা, ” আমি চললাম. বাচ্চাদের দেখে রেখো”। নিজাম উদ্দিনের পায়ের তোলা থেকে দ্রুত সব মাটি সরে যেতে থাকে। কানের কাছে মনে হতে থাকে সহস্র ঝিঁঝিঁ পোকা মিহি সুরে ডাকছে। রুপা যে একরামের হাত ধরে চলে গেছে, নিজাম উদ্দিন শত ভাগ নিশ্চিত। একদিকে বৌ চলে যাওয়ায় প্রবাসে দেশি কমিউনিটিতে মুখ দেখানোর লজ্জা, বন্ধু সমাজে অপমান, আরেকদিকে ছেলে, মেয়ে সংসার সবকিছু সামাল দেয়া, আতঙ্ক , ভয়ে শিহরিত হয়ে একেবারে কুঁকড়ে যায় নিজাম উদ্দিন। রাগে অথবা অভিমানে স্ত্রীকে খোঁজার ব্যাপারে আর পুলিশি ঝামেলায় জড়ায়নি। বৌ চলে যাবার পড়ে, বহু বছর ধরে সিজোফ্রেনিয়া-নামক মানসিক রোগাগ্রন্ত নিজাম উদ্দিনের নিয়মিত মানসিক রোগের ওষুধও খাওয়া হয়ে ওঠেনি অনেক দিন। আর তাই, সেজোফ্রেনিয়া-র উপসর্গ দিন দিন বেড়ে যেতে থাকে। প্রবাস জীবনের রকমারি সমস্যা , সেই সঙ্গে মাত্রাতরিক্ত এলকোহল আসক্ত স্ত্রী হীন নিজাম উদ্দিনকে খিটমিটে করে তোলে। ছেলে-মেয়ের সঙ্গে কথা কাটা-কাটি লেগেই থাকে। একদিন,কলেজ পড়ুয়া ছেলে মুখে মুখে তর্ক করায় বেশ রেগে যায় নিজাম উদ্দিন। কি কোথায় ছেলে রিফাত খুবই বাজে ভাষায় বাবাকে গালি দিয়েছিলো। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে দিকবিদিক হারায়ে এলোপাথাড়ি ভাবে ছেলেকে মারধর করতে থাকে নিজাম উদ্দিন। পাশের এপার্টমেন্ট থেকে কেউ একজন পুলিশে হয়তো ফোন করে ছিল। ফেঁসে যায় নিজাম উদ্দিন। পরে মেন্টাল হেলথ আইনের মারপ্যাঁচে জেলে যেতে হয়নি ঠিকই কিন্তু একটি কারেক্টশন সেন্টারে প্রায় বছর খানিক থাকতে হয়েছিল। পরে শুনেছে ছেলেটা পড়াশুনা শেষকরে আমেরিকায় চলে গেছে। পরিবারের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখে না । নিজাম উদ্দিন জানে মেয়েটি স্কারবোরো এলাকায় একটি বাসার বেজমেন্ট ভাড়া নিয়ে থাকে। পার্ট টাইম চাকরি ও সরকারি লোন নিয়ে কোনোরকমে টেনেটুনে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটির সাথে শেষ দেখা হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে সাবওয়ে ট্রেনে। বাবার হাত ধরে মেয়ের সে কি কান্না।আসে পাশে লোকজন হা করে বাবা-মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি জেদ ধরেছিলো বাবাকে নিয়ে যাবে ওর বেসমেন্টের বাড়া করা রুমে। বাবাকে স্বপ্নও দেখিয়েছিলো, লেখাপড়া শেষ করে একটি আলাদা বাড়া বাসায় বাবাকে নিয়ে থাকবে। কিন্তু, নিজাম উদ্দিন মন শক্ত করে মেয়ের হাত ছেড়ে নিয়ে ট্রেন থেকে বেরিয়ে পরে । সেই থেকে মেয়ের সাথে আর দেখা হয়নি । ছেলে-মেয়ে কারো সাথে প্রায় বছর পাঁচেক হলো কোনো যোগাযোগ নেই নিজাম উদ্দিনের। আজ এই সকালবেলা রুপার কথা ভাবতে যেয়ে নিজাম উদ্দিনের ছেলেমেয়েদের কথাও মনে পড়ে যায়। কে জানে ছেলেটি হয়তো বিয়ে করে সংসার পেতেছে। মেয়েটি হয়তো লেখা পড়া শেষকরে চাকুরীর চেষ্টা করছে। এসব ভাবতে ভাবতে কিছুটা আনমনে হয়ে যায় নিজাম উদ্দিন। তবে কি সংসারের মোহো তাকে আবার পেয়ে বসেছে? মুহূর্তেই, নিজেকে সামলে নেয় নিজাম উদ্দিন । সংসারের প্রতি তীব্র ঘৃণা, ক্রোধ, অভিমান নিজাম উদ্দিনকে লোকালোয় থেকে অনেক অনেক দূরে ঠেলে দেয়।তবে তার কাছে সংসারে সুখের ভান করে পরে থাকার চেযে ওভারব্রিজের কাছে সং সেজে ভিক্ষাবৃতি নিজাম উদ্দিনের কাজে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়।
(ছবি:-সৌজন্যে Zoomer)
জাকারিয়া ভাই , আপনার লেখার মধ্যে প্রবাসীদের জীবনের একটা কঠিন সত্য লুকিয়ে আছে।
একটি বাস্তবধর্মী লেখার জন্য ধন্যবাদ। ভালো লাগলো আপনার গল্পটা।
Thanks