একদিন সন্ধ্যায় শাহারিয়ার অন্য দিনের তুলনায় একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে। মুখের দিকে চেয়ে অনুমান করলাম অন্য সময়ের থেকে সে একটু বেশীই বিচলিত।কারণটা জিজ্ঞেস করতেই মনে হলো চুপসে গেল। আমার মুখের দিকে একবারও তাকালনা। চুপচাপ রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে। অনেকবার তাকে খেতে ডাকলাম, মিছেই ডাকাডাকি করে খাবার ঢেকে রেখে রুমে গিয়ে দেখি তার দু’চোখ ভিজে দরদর কর পানি পড়ছে। এবার আমিও চিন্তায় পড়লাম। জীবনে যে মানুষটিকে বিপদে আপদে ধৈর্য ধরার কথা বলতে শুনেছি সে কিনা আজ কাঁদছে! তার চোখের পানি আর কখনো দেখেছি বলে মনে পড়েনা। একটু আগেও যে বিকেলটা স্বচ্ছ পরিস্কার দেখাচ্ছিল তা যেন মুহূর্তেই ঘোলা হতে শুরু করেছে। শাহারিয়ার আমার বর। আগাগোড়া একজন ধর্মীয় অনুশাসনের মানুষ, বিশেষ কারণ না থাকলে সহজে নামায কামাই করে না। উপজেলা শহরে তার চালের আড়ৎ, মুদি দোকান আর নতুন যোগ হয়েছে রড সিমেন্টের ব্যবসা।
যখন প্রথম শাহারিয়ারের বউ হয়ে আসি তখন দিন আনতে দিন খাই অবস্থা ছিল। এখন মাসে এমনকি বছরেও অভাবের টের পাই না। ছেলে মেয়ে নিয়ে দারুণ সংসার আমার। বেশ সূখে আছি। সংসারের চার পাশের মানুষের আমার প্রতি বাড়তি আকর্ষণ আছে। য়সাওয়ালার বউরা সাধারণত সমাজের অন্য মহিলাদের কাছে বিশেষ মর্যাদায় থাকে আমার ক্ষেত্রে একটু বেশিই বরং কম কিছু নয়।অনেক চেষ্টয়া জানতে পারলাম শাহারিয়ার দ্বিতীয় বিয়ে করতে চায়। কথাটা শোনার পর মনে হলো মাথায় কে যেন বর্জাঘাত করেছে। স্বপ্নের মতো তার ভালোবাসার দিনগুলির কথা মনে পড়তে লাগল। অভাব অনাটনে মোটা কাপড় এনে বলত অপেক্ষা করো আমি খুব চেষ্টা করছি। ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে গেলে অনেক সুন্দর কাপড় দেবো তোমায়। কাপড়টা হাতে নিলে আমাকে বুকের সাথে চেপে ধরে কপালের চুলগুলো সরিয়ে যখন চোখে চোখ রেখে কথা বলত তখন মনে হত আমার থেকে বড় ভাগ্যবতী জগতে আর নেই। মুহূর্তে সেসব দিনগুলো আমার কাছে ফিকে আর ধূসর মনে হলো। অসংখ্যবার তার ভালোবাসার উষ্ণতায় জীবনের ফিকে হওয়া রং উজ্জ্বল আলোর মতো চকচকা হয়েছে। তার আর আমার জীবনের মাঝখানে কখনো কাউকে ভাবার মতো অবসর পাইনি। কখনো কোনদিন কল্পনাও করতে পারিনি তার আর আমার মাঝে তৃতীয় কোন মানুষ থাকতে পারে।কোন মুখে আমার কাছে দ্বিতীয় বিয়ে করার অনুমতি চাইল বুঝিনা। যাকে বিয়ে করতে চায় সে সদ্য-বিধবা এবং দুই সন্তানের মা। খুব কষ্টে শিষ্টে দিন পার।অবস্থা এতোটাই শোচনীয় যে দুপুর হলে বাচ্চাদের জন্য কোথা থেকে খাবার আসবে সেটা জানা নেই বিধবা মায়ের। নিরুপায় হয়ে বেঁচে থাকার আশ্রয় খুঁজছে হন্যে হয়ে বিধবা মহিলাটি। সেটা হতেই পারে কিন্তু যখন শাহারিয়ারের ভেজা পল্লবে চিকচিকে জলের বিন্দু দেখলাম তখন বুঝতে বাকী নেই জল অনেকদূর গড়িয়েছে। না হলে বিধবার দুঃখ কষ্ট ভেবে অশ্রুপাত কারার মানুষ শাহারিয়ার না বিষয়টি ভালো করেই আমি জানি। শাহারয়িারের কাছে জানতে চাইলাম, কেন সে এতটা উতলা দ্বিতীয় বিয়ের জন্য।
নিশ্চয়ই মহিলাকে সাহায্য করার আরও অনেক উপায় আছে। চাইলে তাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করা যেতে পারে, বিয়ে করার কী প্রয়োজন! আর সমাজে কত মানুষ কত রকমের অসুবিধায় দিন পার করছে এজন্য কান্নার কি হলো? আমিতো তোমাকে এর আগে কখনো কাঁদতে দেখিনি! বিষয়টা আসলে কতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে আমাকে খুলে বলো। সে চুপ রইল, মুখ ফিরিয়ে দেয়ালের সাদা আস্তরণের দিকে নির্বাক চেয়ে রইল। পাশে আমি তাকে কত কমের উপহাসমূলক কথা বলতে লাগলাম সে কোনো শব্দ করলনা। অন্য সময় সে অপ্রত্যাশিত কথা শুনলে রাগে আগুনের মতো জ্বলে ওঠত কিন্তু আজ আমার কথায় তাকে নীরব দেখে ভিতরে ভিতরে জ্বলে পুড়ে ছাই হচ্ছি। শেষে রাগে তাকে রেখে অন্যঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ভাবতে থাকি। আমার স্বামীকে আরেকজন নারীর সাথে ভাগাভাগি করতে হবে। তার ভালোবাসা,হাসি, রসিকতা এগুলো আমি ছাড়াও আরেকজন নারী উপভোগ করবে? সে আমাকে ছাড়াও আরেকজন নারীকে স্পর্শ করবে, আর তাকে ভালোবাসার কথা শোনাবে! এটা অসম্ভব, মেনে নেওয়া যায় না। চরম ক্ষোভ, দুঃখ, আর অপমানের জ্বালায় আমি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। আমি ওর জন্যে কী না হইনি? একজন স্ত্রী, প্রেমিকা, ডাক্তার, সেবিকা, গৃহিণী। আমি ওর বাচ্চার মা! চরম দুর্দিনে ওর পাশে থেকে অভাবের সাথে নিত্য সংগ্রাম করেও কত খুশি ছিলাম আমি, সেগুলো কি করে ভুলে যায়! যে কখনো কোনো মেয়েমানুষের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনা সে কিনা আজ এক মহিলার জন্য না খেয়ে পড়ে পড়ে নীরবে কাঁদছে! কীভাবে পারলো আমাকে এতোটা অপমান করতে? মনে হচ্ছিলো আমি হয়তো বেশি ভালো না বা বেশি সুন্দরী না কিংবা অল্পবয়সী না। অথবা ভেঙ্গে গেছে যৌবনের মৌবন। শরীরের ভাজে এখন আর হয়ত উষ্ণতা খুঁজে পায় না। কিংবা শুধু আমি যেন ওর জন্য যথেষ্ট ই না!এজন্যই দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলছে হয়ত।ভবেছিলাম এ জীবনটা অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে, যেন কোনদিনও শেষ হবে না।যেন কখনও কিচ্ছু বদলে যাবে না, বদলাতে পারে না। অনন্তকালের শয্যাসঙ্গী হয়ে আমার মাঝেই সূখ হাতড়ে বেড়াবে শাহারিয়ার। পৃথিবীর অন্য কেউ এই অধিকার কেড়ে নেওয়ারও সাধ্য রাখেনা। মুহূর্তে তার ভালো মানুষির মুখোসটা আমার কাছে স্পষ্ট হতে লাগল। তার চিল্লায় যাওয়া, ধর্মে কর্মে মনোযোগ, আমাদের জন্য সর্বদা ব্যাকুলতা আমার কাছে নিতান্ত তুচ্ছ মনে হতে লাগল। আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। শাহারিয়ার আর রুম থেকে বের হলোনা। আমি বাচ্চাদের নিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেলাম।
প্রায় পনের দিন পার হবার পর একদিন সকালে শাহারিয়ার আমার বাপের বাড়ি উপস্থিত। বড় ভাই প্রচন্ড পরিমান রেগে আছেন। যেখানে আমার জীবনের সাথে এত বড় একটা ঘটনা জড়িত সেখানে সমস্যাটা ভাই-ভাবীকে না জানিয়ে পারিনি।বাচ্চারা বাবাকে দেখে খুব খুশি। পনের দিনের দূরত্বে আমার মনটাও কেমন বিরহের করুণ সূরে ভিজে উঠল। শাহারিয়ারের মুখের দিকে তাকাতেই কোথায় যেন রাগ মিলিয়ে গেল। আমি তার সামনে গেলামনা কিন্তু আড়ালে তার শুকনো মুখটা দেখে মায়ায় বুকটা হূ হূ করে উঠল। ভিতরে কি পরিমান কষ্ট লাগছিল তারপরেও তার সামনে গিয়ে জানতে চাইলাম,- কেমন আছো। দেখলাম মুখটা বির্বণ আর ফ্যাকাশে। আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে।চোখদুটো ঘোলাটে আর দু’ফোটা জল চোখের পাতায় ছলছল করছে। প্রথমে মনে হলো হাতটা ধরে বলি অনেক হয়েছে, আর কাঁদতে হবেনা। চলো আমারা আবার আগের মতো সুন্দর করে সংসার করি। মুর্হূতে মনে হলো ভেজা পল্লবে যে বিরহের রাগিনী দেখলাম সেটা হয়ত আমার জন্য না, ওই মহিলার জন্য। তখন আবার তার সামনে থেকে চলে যেতে চাইলাম। আমি উঠতেই সে আমার হাতটা ধরে বলল, -আমি ও চিন্তা বাদ দিয়েছি। চলো বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ি ফিরে যাই। আমিও খুশি হয়ে কাপড় গুছিয়ে না খেয়েই রওয়ানা দিলাম। আনন্দের ঝড় এমন করে মনের ভিতর দোল খাচ্ছিল আমি না খাই অন্তত আমার স্বামীকে শ্বশুড় বাড়ী থেকে উপোস নিয়ে যাওয়া ঠিক হবেনা মনেই ছিলনা। বাচ্চারাও বাড়ি যেতে চায়। ওদের স্কুল , খেলাধূলা সবকিছু থেকে দূরে থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে পড়ছিল। শেষে না খেয়েই আমারা চলে আসলাম। বাড়িতে এসে শাহারিয়ারের মাঝে বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ করলাম। সে আবার আগের মতো ব্যবহার করছে। চেহারায় এখন আর বিষন্নতার ছায়া নেই । প্রতিদিন বাড়ি ফেরার পথে আমার জন্য বাচ্চাদের জন্য কমবেশী কিছু নিয়ে আসে। সংসারে আবার সূখের জোয়ার বইতে লাগল। আমিও শাহারিয়ারের মানসিক পরিবর্তনে খুশি হয়ে ওই মহিলার কথা ভুলেই গেলাম। আমি জানিনা সেই মহিলা ও তার বাচ্চাগুলোর শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিলো। বহূদিন ধরে শাহারিয়ারের সাথে এ ব্যপারে কোনো আলোচনা হয়নি কেননা, পাছে খুশিই হয়েছিলাম এই ভেবে, আমার স্বামীর মাথা থেকে দ্বিতীয় বিয়ের ভূত তাড়াতে পেরেছি। এরপর শাহারিয়ার আর কখনোই দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রসঙ্গ উচ্চারণ করে নি, যার কারণে আমিও খুব খুশি। নিজের স্বামীকে ধরে রাখতে পেরেছি সেই আনন্দে আত্মহারা! কিন্তু তখনও জানতাম না আমার প্রিয়জনের সাথের প্রিয় মুহূর্তগুলো দ্রুত ফুঁরিয়ে যাচ্ছে। একদিন রাতের খাবার শেষ করে দুজন ঘুমাতে যাব হঠাৎ ও বলল, ঘাড়ের পেছনের রগটা খুব টান পড়ছে। শরীরটা কেমন অবসন্ন লাগছে। আমি রসিকতা করে বললাম, দ্রুত কাজ গুছিয়ে তোমার কাছে আসছি, দেখবা সবকিছু ঠিক করে দেবো। কিন্তু রসিকতা শেষ হবার আগেই ওর বমি হলো। অবস্থা দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম,বাচ্চারা পাশে কাঁদতে লাগল। শাহারিয়ার বাচ্চাদের বুকের কাছে টেনে এনে মাথায় হাত বুলিয়ে কি যেন বলতে চাইল স্পষ্ট বুঝতে পারিনি। এত রাতে কোথায় কার কাছে গিয়ে সাহায্য চাইব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বড় ছেলেকে প্রতিবেশীর কাছে পাঠালাম। আবার বমি করে শাহারিয়ার আমার কোলে মাথাটা এলিয়ে দিল। আমি চেঁচিয়ে প্রতিবেশীদের ডাকতে থাকি। চোখের সামনে তখন অন্ধকার দেখছি। মুহূৃর্তেই ওকে হারাবার ভয় আমার কলিজা মোচড় দিয়ে ওঠে। কিচ্ছু করতে পারিনি আমি, সে রাতেই শাহারিয়ার আমাদের বিদায় জানিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেল।
আচমকা প্রিয়জনের মৃত্যুতে আমি পুরো হতবিহ্বল হয়ে পরি। যে মানুষটার সাথে আমি আমার পুরোটা দাম্পত্য জীবন কাটিয়েছি, তাকে এক মুহূর্তের মাঝে আমার থেকে, বাচ্চাদের থেকে সৃষ্টিকর্তা ছিনিয়ে নিল। এরপর দিনে তার কথা স্মরণ করে নীরব অশ্রুপাত করেছি। রাতে ফুফিয়ে কেঁদে কেঁদে বালিস ভিজিয়েছি। কত কত স্মৃতি আমার মনের মাঝে উঁকি দিয়ে খের পাতা ভিজিয়ে দিত তা আমি-ই মাত্র জানি। হয়তো বা এক মহাকাল অনন্ত যুগ কাঁদব ওর জন্য কিন্তু নিয়তি আমাদের সব ভুলিয়ে দেয়। সে সময় কোনকিছু দেখাশোনা করে রাখার মতো অবস্থা আমার ছিল না। ব্যবসা সম্পর্কে নূন্যতম ধারণাও নেই। কর্মচারীর দেয়া মাস শেষের টাকা দিয়ে সংসার চালাই। ব্যবসার হিসেব নেওয়ার প্রয়োজনও মনে করিনি। অযতে অবহেলাতে একে একে সব হারাতে শুরু করলাম। প্রথমে আমাদের ব্যবসা, এরপর বাড়ি হারালাম।ওর যে এত ঋণ ছিল জানতাম না। সিমেন্টের মালিক ভাউচার দেখিয়ে বলল, গত ছয়মাস ধরে মাল এনেছে আর বিক্রি করেছে। অনেক টাকা বাকী পড়ে আছে। আমার মনে হলো,ব্যবসার অবস্থা এতটাও খারাপ কখনো শুনিনি যাতে ডিলারের এতটাকা বাকী পড়তে পারে। মুহূর্তে সেই মহিলার কথা মনে পড়ল। তাহলে কি সেই মহিলাকে অর্থ সাহায্য দিয়ে ব্যবসার এই অবস্থা করেছে! সব ঋন পরিশোধ করতে গিয়ে একেবারেই পথে বসলাম। বাচ্চাদুটো নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো ভেবে কূল কিণারা করতে পারিনা। শেষে বাচ্চাদুটো নিয়ে আমার ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম।
হঠাৎ আমাদের উপস্থিতি ওদের ভালো লাগেনি সেটা বুঝতে পারছি বেশ। আমাদের অলস দিনযাপণে ভাবীও দিনে দিনে অতীষ্ট হয়ে উঠছিলেন। খুব ইচ্ছে হতো ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। সে সময় আমার দরকার ছিল একটি চাকরি, কিন্তু যেখানে স্বামীর ব্যবসা সম্পর্কেই আমার ধারণা নেই সেখানে বাইরের জগতের আমি কি-ইবা জানি। পড়াশোনা যা আছে সেটাকে কখনো ব্যবহার করে দেখিনি। ছিল না কারো সাথে বিশেষ চেনাজানা। আমার ভূবন জুড়ে সর্বদা একটা মানুষই বসবাস করত। আর তাকে ছাড়া জগতের আর কিছু আমার বোধে ছিলনা। বাচ্চাদের নিয়ে ঢাকায় গিয়ে কিছু করব এমনও সাহস পাচ্ছিনা। ওদের লেখাপড়াও প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।মানুষের দয়ায় এভাবে কতোদিন মাথা গুঁজে পড়ে থাকা যায়? নিজেদের জন্য একটা আলাদা বাসার প্রয়োজন খুব বেশি করে অনুভব করলাম। সারাক্ষণ জুড়ে একটা হাহাকার বুকের মধ্যে বিরাজ করে। শাহারিয়ার বেঁচে থাকতে কতো সূখের দিন ছিল আমাদের। ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করার প্রয়োজনই ছিল না, তাই নিজেকে কোন বিষয়ে পারদর্শী করে তোলাও জরুরি মনে হয় নি। সে চলে যাওয়ার পর জীবন যে এতোটা কঠিন হয়ে গেছে আমি প্রতিটা দিন তাকে অভাব অনুভব করি। হৃদয়ের প্রতিটা অংশ দিয়ে ওকে খুঁজে ফিরি। কী করে মানুষেরজীবন এতো ভয়ানকভাবে পাল্টে যায় ভেবেই পাইনা। চিন্তা আর উৎকণ্ঠায় দিন পার করছি।
হঠাৎ একদিন আমার ভাই আমাকে ডেকে তার পরিচিত এক বড় ভাইয়ের কথা জানালেন। তিনি নাকি বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছেন।ভালো মানুষ, চমৎকার আচার ব্যবহার আর বড় চাকুরে। কবে, কোনদিন ভাইয়ের সাথে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন জানিনা। নিজের জীবনের এতবড় সংকটে বাড়িতে কে আসে কে যায় সেটা খেয়াল কারার সময় পাইনি। তিনি চান আমি তার দ্বিতীয় স্ত্রী হই।একটা নিরাপদ আশ্রয় আমারও চাই কিন্তু বাচ্চাদুটোকে আমি অকূল পাথারে ঠেলে দিতে পারিনা। বুঝতে পারলাম, একজন মায়ের কাছে জীবনের নিরাপত্তা আর নিশ্চয়তার চেয়ে বাচ্চাদের নিয়ে কষ্টেশিষ্টে জীবন যাপন অনেক মধূর। ওরাও কিছুটা বুঝতে শিখেছে। এরকম ঘটনা শুনে চুপ হয়ে ওরা আমার কাছাকাছি থাকে। মনে হল,আমাকে হারানোর অজানা আশংকা ওদের কচি বুকে শেলের মতো বিধছে কিন্তু উপায় কিছু বের করতে পারছিনা। শেষে বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার ভিতর যে হাহাকার চলছে সেটা জানিয়ে ভাইয়ের কাছে বিয়ের ব্যপারে আমার অমত জানিয়ে দিলাম। জানতে পরলাম বাচ্চাদের মেনে নিয়েই ভদ্রলোক আমাকে বিয়ে করতে চান। ভাইকে জানালাম, আমি তার সাথে সামনা সামনি কথা বলতে চাই। মনে হল ভাই কিছুটা বিরক্তই হলেন। অভিভাবক হিসেবে তার মতমতকে বিশ্বাস করে সরাসরি বিয়েতে মত দিলে ভাই মনে হয় খুশিই হতেন। অনিশ্চয়তার মধ্যে আমি থাকতে চাইলামনা।
শেষে ভদ্রলোকের সাথে একদিন দেখা করলাম এবং তাকে জীবনের পরম সত্যগুলো জানালাম। বাচ্চাদের ব্যপারে তারকাছে স্পষ্ট মতামাত জানতে চাইলাম। বুঝতে পারলাম, আমি জীবনের সংকটগুলোকে যে আবেগ দিয়ে তার কাছে উপস্থাপন করছি তিনি সেটাকে সেভাবে গুরুত্বের সাথে আমালে নিচ্ছেননা বরং আমার শাড়ী-ব্লাউজের পাড়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কি যেন অনুভব করছেন। যখন কিছুটা বিরক্ত হয়ে উঠে যাচ্ছিলাম তিনি আস্বস্ত করলেন বাচ্চাদের ভাড় তিনি সাচ্ছন্দ্যে নিতে চান। আমিও বিয়েতে রাজি বলে চলে আসলাম। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস। একজন নারী হিসেবে একজন অভিভাবক চাই আমার। চাই নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা ইত্যাদি। যৌবনের চাহিদাকে না হয় মাটিচাপা দিয়ে মৃত ঘোষনা করলাম কিন্তু জীবনের প্রয়োজনকে অস্বীকার করি কিভাবে! ভদ্রলোকের স্ত্রী বেশ কয়েকটি রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। ভালো করেই বুঝতে পারছি আমার তাকে জীবনের নিরাপত্তা আর নিশ্চয়তার জন্য প্রয়োজন হলেও আমাকে তার যৌবনের চাহিদার প্রয়াসেই প্রয়োজন। এখন প্রকৃতির মায়াজালে আমি বন্দি এবং পরম অসহায়। আজ নিজের অস্তিত্বের সংকটে এক যৌবন পিঁপাসু মানুষের রাতের দেহ তৎপরতার উন্মাদনার আকাংখা আমাকে বহূদিন আগের সেই বিধবা মহিলার কথা মনে করিয়ে দেয়। যাকে আমার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে চেয়েছিল।