ঢাকা থেকে নর্থবেঙ্গলযমুনা ব্রীজের নিচে- জলের তলে জল, বালিয়াড়ি, চরের কুটির, রেললাইনের পাথর, আর অপরূপ বনবীথীর সবুজ ঘন ছায়া পেরিয়ে আর কিছুটা গেলেই হাতের ডানে বামে পথচারীদের সাময়িক বিরতি বা ফ্রেশ হওয়ার জন্য বিভিন্ন হোটেল রেস্টুরেন্ট। এর মধ্যে কতকগুলি বেশ   মানসম্মতই বলা যায়। তাদের আধুনিকতা, সাজসজ্জা, নান্দনিকতা,  খাবার, পরিচ্ছন্নতা, সেবা, পথিকদের সন্তষ্ট করে

 

আমিও যাওয়া আসার পথে প্রায় সময়ই একটি রেস্টুরেন্টের সামনে নামি, কাজ টাজ সেরে আবার ছুটতে থাকিযে রেস্টুরেন্টে আমি নামি সেখানকার ওয়াশরুমের লেডিস সেকশনে কাজ করে একটি মেয়ে। অবাঙ্গালী মেয়েটির বয়স খুব কম। নাম- চাঁদনীকিন্তু এই বয়সেই সে সুস্মিতা ও চাঁদ নামে ২ সন্তানের মা । সুকুমার নামে এক যুবকের বালিকাবধূ

যারাই ওয়াশরুমে যায় সবাইকে টিস্যু দেয়া ওর কাজের  একটি অংশআমাকেও দিতে গিয়েই ওর সঙ্গে পরিচয়। দেখতে সুন্দর, হাসিখুশী, প্রানবন্ত, ছোট্ট মেয়েটিকে আমার ভাল লাগে। ওকে দেখলে কেন যেন মাতা মেরিকে মনে পরে যায়।  ওর বাচ্চা দুটোও সুন্দর বড়টা তুলো তুলো, উজ্জ্বল রঙ, লাফালে লালচে চুল বাউন্স করে এর পরে কেবল চাঁদনীর জন্যই আমি যাওয়া আসার পথে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ঐ একই রেস্টুরেন্ট বেছে নিয়েছি    

প্রতিবার আমি ওর সাথে কিছুক্ষন কথা বলি, বাচ্চা দুটির জন্য ওর হাতে কিছু দেই, বাচ্চা দুটির গাল টিপে দেই আবার খুব দ্রুতই চলে যাই। সময় কোথায়, আরো কিছুক্ষণ কথা বলার! আজকাল সময়  আরবী ঘোড়ায় সওয়ার না হয়ে স্পেসশীপের গতিতে ছুটে চলে। প্রতিবারেই ওয়াশ রুমের কাছাকাছি গেলে তখন মনে পড়ে, ও আচ্ছা – এখানে চাঁদনী আছে ওর দুটি বাচ্চা নিয়ে । মনে পড়লে আমার ভাল লাগে, মনটা প্রসন্ন হয়ে যায়তখন আগ্রহ ও কৌতুহল নিয়ে আমি ওয়াশরুমে যাইদেখা হয়, সামান্য কিছু কথা হয়, তাতেই যেন মেয়েটি একেবারে খুশিতে আটখানা হয়ে উঠে আমার মনও প্রসন্ন হয়ে ওঠে।

কদিন আগে আবারো আমি নর্থ বেঙ্গল যাবার পথে সেই রেস্টুরেন্টে যাই

  এবারে যখন গেলাম, গিয়ে দেখি একটি নিচু টুলে চাঁদনী বসে আছে, আর ওর পায়ের কাছে মেঝেতে একটি ছেঁড়া কাপড়ের (কাপড় না বলে ত্যানা বললেই ভাল হয় ) টুকড়া দিয়ে ঢাকা ওর বাচ্চাটি স্থির হয়ে  শুয়ে আছে দৃশ্যটি দেখে আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। কাছে গিয়ে মৃদুস্বরে ডাক দিলাম কিন্তু আমাকে দেখেও চাঁদনী হাসল না, কথা বলল না বা বসা থেকে উঠারও চেস্টা করলনাআমি যারপরনাই বিস্মিত হলাম, খুব অবাক হয়ে ওর কাছে বসে কথা বলতেই মেয়েটি অসম্ভব ক্লান্ত আর অবসন্ন চোখ দুটি মেলে একবার চেয়েই আবার মুখটা নিচু করল চোখমুখ একদম ভাবলেশহীন। ও আমাকে দেখে খুশি হবেনা, আনন্দে হেসে উঠবে না এমনতো কখনও হয়না।  জিজ্ঞেশ করে জানলাম ও এবং ওর কোলের ছেলে দুজনই খুব অসুস্থ্য আমি ওদেরকে একটু দেখে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল মাতা মেরি একদিন সন্তান জন্মদিতে গোয়াল ঘরে গিয়েছিলেন এবং জন্মের পর সন্তান কে কাপড়ে জড়িয়ে যাবপাত্রে (গরু, মোষের খাবারের পাত্র)  রেখেছিলেন। আর এই মেয়েটি সন্তানকে বাঁচাতে এই ওয়াশরুমে ঠাই নিয়েছে।    

ফ্রেশ হয়ে এসে ওর কাছে বসে, ওর কথাবার্তা শুনলাম। যা বোঝা গেল তা হলো আজ কদিন ধরে ওর প্রচন্ড জ্বরবমি, ও সুস্থ্য না হতেই আবার কোলের বাচ্চাটিও অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে। টাকার অভাবে ডাঃ দেখাতে পারেনি বা কোনরকম কোন ওষুধের ব্যবস্থা করতে পারেনি। হোমিওপ্যাথির একটি পুরিয়াও আনা সম্ভব হয়নি। মনে মনে একটু চিন্তা করে ওখানে উপস্থিত বিভিন্ন বয়সী লেডিসদের উদ্যেশে একটু গলা তুলে অনুরোধের সুরে বললাম এই মেয়েটি ওর বাচ্চাসহ অসুস্থ্য ,আপানারা সবাই যদি কিছু দেন …

আমি অন্য সময় ওকে যা দেই, একদম গোপনে দেই এবং চাঁদনীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে খুব দ্রুত ঐ স্থান ত্যাগ করি। আজ ইচ্ছে করেই হাতটা বাড়িয়ে সবাইকে দেখিয়েই দিলাম। যাতে দেখাদেখি সবাই কিছু দেয় চারিদিকে ঝকঝকে বেসিন, সুগন্ধি সাবান, টিস্যু, দেয়াল জুড়ে গ্লাস, ঘন ঘন স্প্রে করা এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধে ভরা জায়গাটিতে সবাই পারিপাট্য উদ্ধারে ব্যস্ত, বেড়িয়ে আসার আগ পর্যন্ত কাউকে দেখলাম না, ব্যাগের চেন খুলতেআমি চলে গেলাম

তবে এবারে আমি অন্যান্যবারের মতো চাঁদনীকে ভুলে গেলাম না। ওর ব্যাথাতু্‌র, রুগ্ন, ক্লিষ্ট মুখটি আমার মনে কাঁটার মত বিঁধে রইল

আমি গিয়েছিলাম মাত্র ৩ দিনের প্রোগ্রামে খুব টাইট শিডিউলেএবং আক্ষরিক অর্থেই আমার হাতে কোন সময় ছিলনা। তারপরও আমি ফেরার আগের দিন সন্ধ্যায় সামান্য একটু ফুরসত পেয়েই ছুটে গেলাম- মার্কেটে। আসন্ন ঈদের দিনটিকে মাথায় রেখে চাঁদনী আর ওর পরিবারকে আমি আমার সাধ্যমত এবং মনের মত করে সাজালাম আমার সাধ্য, আনন্দ, তৃপ্তি, আর সন্তুষ্টি দিয়ে ভরে উঠতে লাগল চাঁদনীর জন্য নির্ধারিত শুন্য ব্যাগ। যা যা ওর কাজে লাগবে, যা দেখলে বিস্ময়ে ওর চোখ ছানাবড়া হবে সব কিছু আমি এক এক করে কিনলাম। ওর জন্য কিনতে আমার খুব ভালো লাগলো। এতদিন এতকাল কত দাম দিয়ে দেশে বিদেশে কত শপিং করেছি আজকের মতো এতো তৃপ্তি মনে হয়না কোনদিন পেয়েছি। অতঃপর ফেরার পথে নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্টে নেমে  ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল- যদি মেয়েটির দেখা না পাই, আজ যদি সে না আসে, হয়ত শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে আছে কিংবা সেদিন ওর বাচ্চাটি অত অসুস্থ্য ছিল, যদি বাচ্চাটির কিছু… আমি আর ভাবতে পারলামনা। ওয়াশরুমের ভেতরে ওকে খুঁজলাম নেই, মাঝের কড়িডোরে নেই, কোথায় চাঁদনী ? আমি তবে এতকিছু কিনলাম কার জন্য? ব্যাকুল হয়ে খুঁজছি…  মনে মনে খুব  চাইলাম, চাঁদনীর দেখা যেন পাই নীরবে প্রার্থনা করলাম প্লিজ চাঁদনী যেন আসে, আমি চাঁদনীকে দেখতে চাই।

অবশেষে আমার সকল আশংকা উড়িয়ে দিয়ে সামনেই হাস্যোজ্জল – চাঁদনীমেয়েটি কী চমৎকার করে হেসে দিল আমায় দেখে, যেন ওর মুখে হাজার পাওয়ারের এক শুভ্র আলো জ্বলে উঠল

আমি ওকে ডেকে ব্যাগের সবকিছু এক এক করে বুঝিয়ে বলতে লাগলাম –  সবকিছু দেখতে দেখতে মেয়েটির মুখে বেণীআসহকলা মুহুর্মুহু খেলা করতে লাগল আমি ওকে এক একটি আইটেম বুঝিয়ে দেই আর ওর মুখে ফুটে ওঠা অনুভূতির রঙ দেখতে থাকি। ওর সন্তুষ্টি, ওর তৃপ্তি, ওর বিস্ময়, ওর অবুঝ সবুজ আবেগ আমি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে থাকিআমি আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে খুব সহজেই বুঝে যাই এত জিনিসপত্র এক সাথে দুরের কথা ও ওর সারা জীবনেও দেখেনি।  

সবশেষে উজ্জ্বল রঙয়ের একটি শাড়ি হাতে নিয়ে সলজ্জ হাসিতে আমায় জিজ্ঞেশ করে —

-মেমসাব শাড়িটি এক্ষুনি পড়ব?   

আমিও হেসে বললাম- আচ্ছা পড়। যদিও তাকে আমি ঈদের দিনে পরার কথা বলেছিলাম

মুহুর্তেই অবাঙ্গালী ঢঙ্গে নতুন শাড়িটি পরে, আনন্দে কি করবে, বুঝতে পারেনা। আকর্ণ হাসিতে ভরা ওর মুখটি দেখে আমার মনে হচ্ছিল, আহারে কত অল্পেই কী বিশাল আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়।  

হঠাত মেয়েটি এসে আমার পায়ে হাত দিয়ে- বিড়বিড় করে বলে- মেমসাব তুমি ভাল থাকো…   

ওর নিজস্ব টানে ,অবাঙ্গালী উচ্চারণে ওর কথা আমার বরাবরই মিষ্টি লাগেকিন্তু ওর পায়ে হাত দেয়াটা একদম ভাল লাগল না বরং ওর সতেজতা, উচ্ছলতা আমার কাছে আকর্ষনীয় লাগে। এত অভাবের মাঝেও মেয়েটির মধ্যে ভিক্ষুক ভিক্ষুক ভাবটা নেই বলেই ওকে আমি পছন্দ করি। ওর সবতস্ফুর্ততাটাই আমাকে টানে।   

আঁতকে উঠে দ্রুত পিছিয়ে গেলাম। বললাম-

-তুমিও ভাল থাক

আনন্দে খাবি খেতে খেতে কথা বলায় অপটু, ভাষা না জানা মেয়েটি বিড়বিড় করে, সজল চোখে  ঐ একটি কথাই বলতে থাকে- মেমসাব তুমি খুব ভা্লো থাকো, মেমসাব তুমি বহুত ভালো থাকো, মেমসাব…

আমি চলে আসা পর্যন্ত এই একটি বাক্যই সে অনেক বার বলেছে। আমিও অন্তর দিয়ে ওর বাক্যটি হৃদয়ে ধারন করেছি।

কিন্তু ওর টলটলে চোখদুটিতে খেলা করে- জীবন্ত একাধিক চকিত অভিব্যক্তিআনন্দ, অপার বিস্ময়, কৃতজ্ঞতা, আর সব ছাপিয়ে এক অদ্ভুত-অদ্ভুত ভালোবাসাআমি ওর চোখের অন্যসব অভিব্যক্তি বাদ দিয়ে কেবল ভালোবাসাটাই দেখতে চাইলাম এবং দেখলাম ওর ভালোবাসাটাই আমি নিলাম আর ওর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার গাড়িতে উঠে, সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলামগাড়ি ছুটে চলছে। কখন পৌছাব নিজ আবাসে তাই ভাবছি, হঠাত মাথার ভেতরে কে যেন কথা বলে উঠল-

-একজনের দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে খুন মহান হয়ে উঠলে তাইনা? আমি চমকে উঠলাম!

-তা হবে কেন, আমি তো মেয়েটিকে ভালোবাসি, বাচ্চা দুটোকে স্নেহ করি।

-আচ্ছা আচ্ছা বেশ… টাকা আছে বলেই না ভালোবাসার প্রকাশ দেখিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারছ…

-তাতো বটেই, টাকা না থাকলে কিভাবে আমি তাকে ভালোবেসে এই উপহার সামগ্রী দিতে পারতাম!

খিলখিল হাসির শব্দ। হাসতে হাসতেই আবার উচ্চারিত হলো-  

-তাহলে জীবনে টাকার দরকার আছে, স্বীকার কর? টাকা ছাড়া ভালোবাসাও দেখানো সম্ভব হয়না, ঠিক না? আসল কথা হলো, তোমার নিজের ইচ্ছে,  তোমার ভালোলাগা তুমি পুরন করলে, এখানে চাঁদনী কোন ফ্যাক্টর নয়, ফ্যাক্টর হলো নিজের ভালোলাগা,  স্বইচ্ছে পুরণ…    

আমি থমকে যাই, বিরক্ত হই, অসহ্য লাগে প্যানপ্যানানি। গাড়ির এপাশ থেকে ওপাশে সরে গিয়ে আরাম করে আধশোয়া হয়ে বিরক্তিকর উল্টাপাল্টা ডায়লগের হাত থেকে বাঁচার জন্য হেডফোন কানে লাগাই। যা কিছুই করিনা কেন- এই এক যন্ত্রনা কি করলাম, কেন করলাম একটা ডান- বাম বিশ্লেষণ, অসহ্য লাগে।  হেডফোনে গান শোনার বেশ মজা আছে, আমরা নরমালি যেভাবে গান শুনি হেডফোনের শোনাটা যেন অন্যরকম লাগে। মনে হয় সরাসরি মস্তিষ্কে বাজছে গানটি। গানে নিমগ্ন হয়ে আছি, গানের সাথে সাথে  শ্রাবনী সেনের চেহারাও মানশপটে ভেসে উঠছে চোখ বন্ধ করে এই মিছরি কণ্ঠি গায়িকার কন্ঠসুধা উপভোগ করছি… আবার কখন গান মিলিয়ে গিয়ে-    

আমার বন্ধ চোখের সামনে ভেসে উঠে – ঈদের দিনের সকালে চাঁদনীর নিকানো উঠানের ছোট্ট সংসারনতুন শাড়ি পড়ে সে শাখা-পলা হাত নেড়ে নেড়ে বার বার শোনানো গল্প, আবার শোনাচ্ছে স্বামীকে বলছে — জানো!  সেদিন যে মেমসাব এসেছিল…আশেপাশেই চাঁদ ও সুস্মিতা খেলে বেড়াচ্ছে। বহুদিন ধরে সাবান শ্যাম্পু তেল চিরুনীর সাথে সম্পর্কহীন চুলগুলি আজ তেল দিয়ে পরিপাটি করে আঁচড়ানো। পেট ভরা, ক্ষিধে নেই তাই কান্নাও নেই। পরনে ঝলমলে নতুন জামায় নাকের সিকনি গড়ালেও মুখে অনাবিল হাসি।  

চাঁদনী আমার জন্য প্রার্থনা করেছে অকপটে- আমারও ওর মঙ্গল কামনা করা উচিত। কিন্তু ভাবছি আমি ওর জন্য কি প্রার্থনা করি! “তোমার সন্তান থাকুক দুধে ভাতে”, “সুখ সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক তোমার গৃহকোণ” এসব কেবলই হিপোক্রেসির নামান্তর। তাই আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম- চাঁদনী, অমলিন থাকুক তোমার মুখের হাসি আর “পৃথিবীর যাবতীয় সুখ দুর্বোধ্য থাকুক তোমার বোধের ধারাপাতে”।    

দরিদ্রসীমার অনেক নিচে বাস করা, জীবন সম্পর্কে কিছুই না জানা মেয়েটি কোনদিন জানবেনা,  হয়তো সত্যি সত্যি নিজের একটুখানি ভালোলাগার প্রতি সামান্য মনোযোগ দিতে গিয়ে বা নিজের ইচ্ছে পুরন করতে গিয়ে এক অজানা অচেনা মেমসাব ওর –

অমল ধবল মনের শাদা পাতায় এক উজ্জ্বল স্থায়ী “আনন্দ বিন্দু” হয়ে রয়ে গেল

গল্পকার কলম হাতে যখন এক একটি চরিত্র আঁকেন চরিত্রের ভাগ্য নিয়ন্তা হন সেই গল্পকার, এটি গল্প হলে এমন একটা সমাপ্তি হয়ত হতেও পারত। কিন্তু অপার অনন্ত নক্ষত্র বীথিতে বসে কেউ কি কলম হাতে এঁকে যাচ্ছেন একের এক চরিত্র! চরিত্রের গায়ে জড়াচ্ছেন চট থেকে আরম্ভ করে রাজকীয় কারুকাজের পোষাক।   

না, সেদিন আমি আর চাঁদনীর দেখা পাইনি। সেখানকার সিকিউরিটি, বয় এমনকি কর্তব্যরত ম্যানেজার এর সাথে দেখা করেও ওর কোন হদিস পাইনি। বেশ কিছুটা পরে ম্যানেজার ভদ্রতা করে বলেন- ‘ম্যাডাম, এরা ভাসমান মানুষ এদের আপনি কোথায় পাবেন! আপনি কেন ওকে খুঁজছেন, ওকি কিছু চুরি টুরি করেছে ? দেখুন এরা এমনই এখানে দুদিন সেখানে দুদিন থাকে,  চুরি টুরি করে পালিয়ে যায়, বাদ দিন’…  

ভারী ভারী ব্যাগ, আর ভারী হয়ে আসা পা ফেলে ফেলে যখন আমি গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি তখন একজন বৃদ্ধ মানুষ এগিয়ে এলেন, ফিসফিস করে বললেন আমি একটু কথা বলতে চাই। শ্বশ্রূমন্ডিত মানুষটাকে জিজ্ঞেশ করলাম ‘কি বলতে চান’ ?  

-‘আম্মা, একটু ওদিকে চলেন। আমি এখানে মালীর কাজ করি। আমি তখন থেকে দেখছি আপনি ঐ মেয়েটার খোঁজ করছেন। ওকে আপনি পাবেননা মা’   

মালিকেরা সবসময় বলে এসেছে যে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে কাজে আসা যাবেনা। চাঁদনী বলত-  

-‘জী হুজুর বাচ্চা আনবনা’, কিন্তু বাচ্চারা এসেই পড়ত। ঐদিন মালিক স্যার ওকে বলেন যে তোমাকে আর কোনদিন কাজে  আসতে হবেনা। চাঁদনী হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করলে ম্যানেজার ধমক দিয়ে ওকে থামায় এবং চলে যেতে বলে দিশেহারা মেয়েটা ম্যানেজার, ছোট ম্যানেজার, বয়, বেয়ারা সকলের পা ধরে কান্নাকাটি করে তারপর একসময় শান্ত হয়ে বাথরুমে চলে যায় গিয়ে দেখে বাচ্চাটি নিথর হয়ে গেছে।  

সারারাত চলে যাবার পর ঘটনা জানাজানি হয় পরে টয়লেটের দরজা ভেঙ্গে মেয়েটাকে উদ্ধার করা হয়। ওর চারপাশে কয়েকটা খালি হারপিকের বোতল ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ভোর হবার আগেই লোকজন মিলে সমস্ত কিছু ক্লিন করে ফেলে, বাতাসও ক্লিন করা হয় আম্মা। নিচুজাতের ছোট মানুষ এদেরকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া যায়। ওর স্বামীকে ডেকে কিছু টাকা আর বডি দুটি দিয়ে এখান থেকে বহুদূরে চলে যাবার হুকুম দেয়া হয়। পরে আবার একটা পিকাপ ভ্যানে করে কোথায় যেন রেখে আসা হয়, কেউ জানেনা। এখন ওদেরকে আর কেউ চেনেনা জানেনা, এখানে ওদের নাম নেয়াও মানা…ওরা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে’…

বলতে বলতে বৃদ্ধ চোখ মোছে…   

১ মন্তব্য

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন