আমরা থাকতাম আজিমপুরে একই বিল্ডিংয়ে । আমরা পাঁচ তলায় আর মিলিরা ছয় তলায়। আমার থেকে ও দুই বছরের জুনিয়ার ছিল। কিন্তু প্রতিদিন বিকেলে আমাদের ছাদে দেখা হত। ও আসতো ওর বড় ভাইয়ের আট মাসের বাচ্চাকে কোলে করে। আর আমি যেতাম আমার বড় ভাইয়ের ছেলেকে সাথে করে। খোলা আকাশে নিজেদের খুব মুক্ত মনে হত। সারাদিনের গল্প হত আমাদের। কলেজে বা রাস্তায় রোমাঞ্চকর কোন ঘটনা ঘটলে বা বাসায় কোন সমস্যা হলে তা শেয়ার করার জন্য মিলি বা আমি ছুটে যেতাম একজন আরেকজনের বাসায়। এক কথায় সম্পর্কটা ছিল বন্ধু আর বোনের মত। মাঝে মাঝে ওর ভাবীও আসতেন ছাদে। উনি শান্ত টাইপের মানুষ ছিলেন । কথার চাইতে মিষ্টি করে হাসতেন বেশি।মিলির ভাই আমেরিকা থাকে। তাদের বিয়েটা হয়েছে ফোনে। বিয়ের পর ওরা বউ তুলে এনেছে বরকে ছাড়া। মিলির ভাবী ওদের গ্রামেরই মেয়ে। কিন্তু ওর ভাই পছন্দ করেছে ছবি দেখে। বিয়ের ছয় মাস পর দেশে এসে প্রথম ভাবীকে দেখে । দুইমাস থেকে আবার চলে যায় আমেরিকায়। এভাবে আসা যাওয়ার মধ্যে কেটে যায় ছয়টা বছর। ভাবীর কোল আলো করে আসে ফুটফুটে এক ছেলে । মিলিরা সবাই চেষ্টা করে ওর ভাবীকে ভাল রাখতে। আর ভাইয়ের ছেলেটা তো ওদের সবার চোখের মনি।
এক শুক্রবার সকালে মিলি এলো আমাদের বাসায়। এসে বলল “আপা আমাদের বাসায় একটু আসবেন ? গতকাল রাত থেকে ভাবী কেমন যেন উলটা পাল্টা আচরন করছে। আমাদের কাউকে সহ্য করতে পারছে না। সারা রাত ঘুমায়নি । আপনি কি উনার সঙ্গে একটু কথা বলবেন? আম্মা খুব ভয় পাচ্ছে। “ আমি ওর কথা শুনে গেলাম ওদের বাসায়। ঢুকেই দেখি ভাবী তার বাচ্চাকে কোলে করে বসে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম “ কেমন আছেন ভাবী ?” সে বলতে থাকলো “ এদের জন্য কি ভাল থাকার উপায় আছে ? আমার বাচ্চাটাকে সবাই ফেলে রাখে। খাওয়ায় না। ওরা আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলবে। আমি আর রাতে ঘুমাবো না।“ আমি যতই বোঝানোর চেষ্টা করছি “ সবাই আপনার বাচ্চাকে কত আদর করে। সারাক্ষন কোলে করে রাখে।“ উনি ততই রেগে যাচ্ছেন আর একই কথা বলছেন। প্রায় আধা ঘণ্টা একই কথা শুনে আমার মনে হলো উনি স্বাভাবিক কথা বলছেন না। আমি বললাম “ মিলি আমার ভাবীকে ডাকি উনি কি বলেন দেখি ।“ আমার বড় ভাবী ডাক্তার । সেও দেখে বলল তোমরা উনাকে তাড়াতাড়ি একজন সাইক্রেটিস্ট দেখাও । ওরা ভাবীকে ডাক্তার দেখিয়ে এসে বলল “ ডাক্তার সব শুনে বলেছেন বিয়ের পর থেকে প্রচণ্ড মানসিক চাপে থাকার জন্য তার মধ্যে ডিপ্রেশন কাজ করছে। একটা মেয়ের বিয়ের রাতে নতুন একটা পরিবেশে একা বাসর কাটানো কতটা কস্টের আর কঠিন কাজ এটা যে ভুক্তভুগি সে ছাড়া আর কেউই অনুধাবন করতে পারবে না। আর রোগী চাপা স্বভাবের বলে কাউকে কিছু বলেনি । সব মিলিয়ে আজ এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে । সে কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উনার হাসব্যান্ডকে দেশে আসতে হবে। তাছাড়া সিজফ্রেনিয়া থেকে রোগীকে মুক্ত করা সম্ভব না।“ মিলিদের ম্যাসেজ পেয়ে মিলির ভাই তিন দিনের মাথায় দেশে ফিরে আসলেন । দেশে এসে ভাবির চিকিৎসার পাশাপাশি দেশে কিছু করার চেষ্টা করতে লাগলেন। তার কয়েক মাস পর কোন এক সন্ধ্যায় মিলিদের বাসায় আমি যাই। আমাকে দেখে ভাবী খুব লাজুক হাসি হেসে বলেন “ তুমি কিছু মনে করনি তো! আমি তখন কি বলেছি ঠিক মনে করতে পারি না। কিন্তু অন্যদের কাছ থেকে শুনেছি । আমি খুব আজেবাজে কথা বলেছি ।এখন খুব খারাপ লাগছে ।“ আমি ঠাট্টা করে বললাম,” এরকম উল্টাপাল্টা না বললে কি ভাইয়া ফিরে আসতো?” উনি হাসতে হাসতে বললেন তুমি বস। আমি মুড়ি মাখিয়ে নিয়ে আসি। চা আর মুড়ি খেতে খেতে তোমার সঙ্গে গল্প করি।