( তিন )

পরিস্কার আকাশ। অন্ধকার রাত। গ্রহ নক্ষত্রগুলি সব ঝলমল করছে। একটুও মেঘ নেই কোথাও। মনেই হচ্ছে না সন্ধ্যে থেকে ঝড়-বৃষ্টি বয়ে গিয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমের মধ্য আকাশের গায়ে উদ্ভাসিত চাঁদের আলোতে ছেয়ে গিয়েছে চারদিক। রাস্তার যানবাহনগুলি সব যথারীতি চলাচল করছে, শোনা যাচ্ছে। মন-মানসিকতাও খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে মহুয়ার। ভিতরে ভিতরে মন-প্রাণ অস্ফূট খুশীতে ভরে ওঠে। রেকর্ড-প্লেয়ারটা অন্ করে নিখিলেশের এ্যাটাচিটা হাতে নিয়ে উচ্ছাসিত মনে দোলাতে দোলাতে গিয়ে ঢোকে কিচেনরুমে। তখন কানে তালা লাগিয়ে তীব্র আওয়াজে মধুর ঝংকারে ভেসে আসে রবীন্দ্রসঙ্গীত। ‘আমার এ পথ / তোমার পথের থেকে অনেক দূরে / গেছে বেঁকে গেছে বেঁকে / আমার এ পথ।’

থমকে দাঁড়ায় নিখিলেশ। মহুয়াকে উদ্দেশ্য করে একগাল হেসে বলল,-‘বাহঃ, চমৎকার! রবী ঠাকুরের প্রতিটি গানই মনকে ছুঁয়ে যায়।’
বলে সুরে সুর মিলিয়ে গুন গুন করে গেয়ে ওঠে। শুনতে পেয়ে কিচেনরুম থেকে মহুয়া বলল,-‘বাঃ, আপনি সঙ্গীত চর্চাও করেন বুঝি!’

কথাট ঠিক নিখিলেশের কানে পৌঁছালো না। টি-টেবিলে একটা সিনে ম্যাগাজিন পড়েছিল। সেটা হাতে নিয়ে উল্টাতেই মহুয়া এসে বলে,-‘কিছু বললেন?’

-‘বলছিলাম, রবী ঠাকুরের প্রতিটি গান হৃদয়কে স্পর্শ করে। গানটি শুনে আজ মনে হচ্ছে, সত্যিই অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। ভাবছি, এবার এখানেই থেকে যাবো!’

সবিস্ময়ে মহুয়া বলল,-‘এ্যাঁ, এখানে মানে!’

-‘ভারতবর্ষে!’ দৃঢ় জবাব নিখিলেশের। মহুয়ার দিকে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টি হেনে বলে,-‘আপনি কি ভেবে ছিলেন?’

-‘না, না, আমি বলছিলাম, আপনি কোলকাতায় ডাক্তারি করবেন। ভালোই তো। চাইল্ড্ স্পেশালিষ্ট বলে কথা। নিউ প্যারেন্টস্দের জন্যে এটা একটা গুড্ নিউজ। কি বলেন, তাই না!’

-‘হ্যাঁ, এই-ই তো! আর কি!’

বাঁকা চোখে তাকায় মহুয়া। প্রতিবাদের সুরে বলে,-‘বারে, আর কিছুই নয়?’

ফিক্ করে হেসে ফেলল নিখিলেশ। হাসিটা বজায় রেখে বলল,-‘আর কি? আপনিই বলুন!’

-‘কেন, প্রতিদিন শুভ্রাদির হাতের মজার মজার শোয়াদিষ্ঠ রান্না খাবেন। সেটা কিছু না!’

-‘সেটা তো কম্পালসারি বলতে হয়। দেবর বলে কথা। এতো বছর পর এলাম, ভালো মন্দ একটু খাওয়াতেই পারে!’
হঠাৎ খপ্ করে নিখিলেশের হাত ধরে ওকে সোফায় বসিয়ে দেয় মহুয়া। ভ্রু-যুগল উত্তোলণ করে অভিভাবকের মতো আদেশ দিয়ে বলে,-‘এবার একটু রিল্যাক্স হয়ে বসুন দেখি! গান শুনুন। চায়ের জলটা ফুটতে ফুটতে এতক্ষণ শুকিয়ে গেল বোধহয়। আমি এক্ষুণি চা-জল-খাবার নিয়ে আসছি।’ বলে দ্রুত ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে গেল।

ড্রইং-রুমের বাইরে চারিধারে আয়না বাঁধানো। নিজের চেহারা আয়নায় নজরে পড়তেই আঁতকে ওঠে মহুয়া,-‘ও গড্, কি অর্ড লাগছে দেখতে। চোখমুখ, সর্বাঙ্গ এলোমেলো যে! ইস্, নিলুদা কি ভাবছে কে জানে। নিশ্চয়ই শুভ্রাদিকে গিয়ে সব বলবে। দূর, বললে বলুক গে। আমার খবর কে রাখে!’
বিড় বিড় করতে করতে পড়নের কাপড়টা ড্রেুস দিয়ে ঠিকঠাক করে পড়ে গিয়ে ঢোকে কিচেনরুমে। ঢুকেই মনে পড়ে,-ওঃ সীট্, খাবারগুলি তো সব ডাষ্টবিনে ফেলে দিয়েছে। নিখিলেশকে কি দেবে এখন!

বড্ড আফশোস হয় মহুয়ার। এতোগুলি খাবার। কেন যে ডাষ্টবিনে ফেলে দিলো, থাকলে নিখিলেশকে দিতে পারতো। মজা করে খেতো। কে জানতো, হুট্ করে নিখিলেশ আজই এসে হাজির হবে। স্বপ্নেও তো ভাবতে পারেনি।

দেওয়ালে টাঙ্গানো বড় বড় ঋষি মুণিদের ছবিগুলি ঘুরে ঘুরে দেখছিল নিখিলেশ। কখন যে মহুয়া এসে ঘরে ঢুকেছে, টের পায়নি। সঙ্গে নিয়ে এসেছে লেবুর শরবত আর কিছু মুখরোচক খাবার। হঠাৎ চুড়ির ঠুনঠুন  শব্দে চমকে ওঠে নিখিলেশ।
মহুয়া বলল,-‘ছবিগুলি খুব রিসেন্ট বাঁধানো হয়েছে। হরিদ্বার থেকে আনা। ধরুন, গলাটা একটু ভিজিয়ে এগুলি খেয়ে নিন। এরপর গরম গরম চা নিয়ে আসবো।’ বলতে বলতে শরবতের গ্লাসটা তুলে দেয় নিখিলেশের হাতে। নিখিলেশ তক্ষুণি এক চুমুকে ঢক্ ঢক্ করে পান করে বুকের মাঝখানে হাত বুলায়। লম্বা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,-‘আহঃ, এতক্ষণে প্রাণটা জুড়োলো। কি তেষ্টাই না পেয়েছিল!’

-‘এ্যাঁ, আপনার তেষ্টা পেয়েছিল, তা এতক্ষণ বলেন নি কেন?’ খুব উৎকন্ঠিত হয়ে বলল মহুয়া।

গ্লাসের গায়ে আঙ্গুলে টোকা দিতে দিতে নিখিলেশ বলল,-‘কখন বলবো বলুন। সে সময় আর দিলেন কোথায়। যা নাটক দেখালেন!’

ফোঁস করে ওঠে মহুয়া। ভ্রু-যুগল কুঁচকিয়ে বলে,-‘কি, এতক্ষণ আমি নাটক দেখাচ্ছিলাম? আমায় নটঙ্কির মতো লাগছে? বলা নেই, কওয়া নেই, হুট্ করে এসে পড়লেন। একবার ভেবে দেখুন তো, আমার অবস্থায় পড়লে আপনি কি করতেন? কিই বা আর করতেন, হতেন মহিলা, তবেই বুঝতে পারতেন।’

ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিখিলেশ বলল,-‘বাব্বা, চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। আমায় অবাক করে দিলেন।’

-‘কেন, এতে অবাক হবার কি আছে! আমি কি জানতাম, এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে আপনি এসে পড়বেন। আর তা’ছাড়া…!

কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল মহুয়া। ওর চোখমুখের হাবভাব দেখে ঠোঁটের কোণে কৌতুকের হাসি ফুটে ওঠে নিখিলেশের। গম্ভীর হয়ে গেল মহুয়া। ম্লান হেসে বলল,-‘আপনার হাসি পাচ্ছে! পাবেই তো! নিয়ত যখন খারাপ হয়,তখন পিঁপড়েও খোঁচা মারে। আই মীন, দুর্বলকেই বেশী কষ্ট দেয় মানুষ। রঙ্গ ব্যঙ্গ করে। উপহাস করে। তামাশা করে। এতে মজা পায় সবাই।

মহুয়ার এধরণের অসন্তোষমূলক কথাবার্তায় মুখখানা মুহূর্তে বিবর্ণ হয়ে গেল নিখিলেশের। নিজেকেই অপরাধী মনে হয়। গিল্টি ফিল করে। চকিতে একটা বিষন্ন হাসি ফুটিয়ে বলে,-‘না না মিস্ ব্যানার্জী, তা নয়। আপনি এতো সিরিয়াসভাবে নিচ্ছেন কেন? আপনি খামাখা ভুল বুঝছেন। আই এ্যাম্ যাষ্ট যোকিং। এই সামান্য ব্যাপরে আপনি এতো চটে যাবেন, আমি তো ভাবতেই পারি নি!’

মনে মনে অসন্তুষ্ট হয় মহুয়া। আলমিরার ড্রয়ারটা খুলে কিছু খোঁজার ভান করে বলে,-‘এটা কিন্তু মোটেই ভালো নয় নিখিলেশ বাবু। এ ধরণের যোক্ আমি একদম পছন্দ করি না।’

-‘যাব্ বাবা, দিলেন তো ফ্যাসাদে ফেলে। বৌদি তা’হলে ঠিকই বলেছিল।’

চোখ পাকিয়ে তাকায় মহুয়া। গম্ভীর হয়ে বলল,-‘কি-কি বলেছে শুভ্রাদি?’

আমতা আমতা করে নিখিলেশ বলল,-‘আপনি যা ভাবছেন, সেরকম মারাত্মক কিছু নয়। বৌদি একদিন কথায় কথায় বলছিল যে, ফাঁদে পড়লে আর রক্ষে নেই!’

চটে যায় মহুয়া। চোখমুখ ফুলিয়ে অসন্তোষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ খই ফোটার মতো ঠোঁটের ডগা দিয়ে ওর বুলি ছুটতে থাকে।-‘রক্ষে নেই মানে! কার রক্ষে নেই? আমার, না আপনার? থাকুন না ক’টা দিন, শুভ্রাদি নিজেই টের পাবে। ওর বিয়ের পরই তো আপনি দেশান্তর হলেন, ওই বা আর জানবে কি করে!’

নিখিলেশ নিরুত্তর। মহুয়ার আপদমস্তক নজর বুলিয়ে মনে মনে বলে,-কি সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা। এ যে একেবারে নাস্তানাবুদ করেই ছাড়বে দেখছি। কিন্তু সে অপেক্ষা আর রাখে না। ইতিপূর্বে মহুয়ার জেরায় পড়ে যায়।

-‘কি, কিছু বলছেন না যে! এবার উত্তর দিন।’

ফিক্ করে হেসে ফেলল নিখিলেশ। প্লেট থেকে ক’টা কাজুবাদাম নিয়ে টপাটপ মুখে পুরতে পুরতে বলল,-‘ও.কে ম্সি ব্যানার্জী, আজ উঠি। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।’

নিঃশব্দে হেসে ফেলল মহুয়া। বলল,-‘রাগ করেছেন!’

ততক্ষণে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় নিখিলেশ। মহুয়া বলল,-‘এ কি, আপনি সত্যি সত্যিই চলে যাচ্ছেন?’

নমস্কার জানিয়ে নিখিলেশ বলল,-‘না মিস্ ব্যানার্জী, আজ চলি। আরেক দিন আসবো!’ বলে এ্যাটাচিটা হাতে তুলে নেয়।
মহুয়া তৎক্ষণাৎ দ্রুত এগিয়ে আসে। এ্যাটাচিটা নিখিলেশের হাত থেকে টেনে নিয়ে বলে,-‘আচ্ছা, আপনি কি শুরু করেছেন বলুন তো! সেই তখন থেকে খালি মিস্ ব্যানার্জী, মিস্ ব্যানার্জী করছেন। আমার নাম নেই বুঝি। কোনো কথা শুনছি না। এতকাল পর এসেছেন, না খেয়ে কিছুতেই যেতে দিচ্ছিনা! আবার কবে আসবেন তার ঠিক আছে! আজ কোনো কথা শুনবো না। খেয়ে যেতেই হবে ব্যস!’

মাথা নেড়ে নিখিলেশ বলল,-‘বেশ, তাই-ই হবে। কিন্তু একটা সর্তে, সারাক্ষণ ঐ নিখিলেশ বাবু, নিখিলেশ বাবু করা চলবে না। আমায় নিখিল বলেই ডাকবেন।’

স্বলজ্জে হাসল মহুয়া। বলল,-‘বারে, তা বলে আপনাকে নাম ধরে ডাকবো না কি? আপনি হাসছেন কেন? চালাকি হচ্ছে না! ওসব শুনছি না। বলে দ্রুত পায়ে দরজার গোড়ায় গিয়ে দাঁড়ায়।

বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যায় নিখিলেশ। অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মহুয়ার মুখের দিকে। মনে মনে বলে,-আশ্চর্য্য, এতো অল্প সময়ে এতখানি আন্তরিকতা! এতো ঘনিষ্ঠতা! ভাবাই যায় না। অথচ মনের অগোচরে কখন যে
বন্ধুত্ব হলো, কখন হৃদ্যতা গড়ে উঠলো, নিখিলেশ নিজেও টের পেলো না। কিন্তু আজ বেকায়দায় মহুয়ার পাল্লায় পড়ে গিয়েছে। ও’ একেবারে নাছোড়বান্দা। না খাইয়ে যেতে দেবে না। ওর এ্যটিচুট দেখে নিঃসন্দেহে বোঝা যায়, বড্ড জেদী, একরোখা মেয়ে। এখনও ছেলেমানুষিই যায়নি। একটুতেই চটে যায়।
ভাবতে ভাবতে নিখিলেশ আবার বসে পড়ে সোফায়। মনে মনে হাসলও। খানিকটা কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলো,-‘বেশ, তা নয় মানলাম, কিন্তু ম্যাডাম্ আমাকে খাওয়াবেন কি শুনি!’

-‘কেন? যা খেতে চাইবেন। আপনি যা খেতে ভালোবাসেন!’

-‘আর ইউ সিওর?’

মাথা নেড়ে মহুয়া বলল,-‘ইয়েস স্যার! একদম হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর! আই এ্যাম নট্ যোকিং লাইক ইউ!’

-‘তা’হলে তো খেয়ে যেতেই হয়। আগে জানলে প্রিপেয়ার হয়ে আসতাম!’

-‘প্রিপেয়ার হয়ে আসতাম মানে! ফর হোয়াট?’

-মানে, আপনার এখানেই থেকে যাবার ব্যবস্থা করতাম!

অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে মহুয়া। গলার স্বর খানিকটা বিকৃতি করে বলে,-‘ঠাট্টা হচ্ছে! মশাই, এখানে নয়, রেষ্টুরেন্টে। আপনাকে রেষ্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাওয়াবো। আমি তো জানতাম না আপনি আসবেন। জানলে নিশ্চয়ই রান্না বান্না করে রাখতাম। আপনি বসুন, আমি এক্ষুণিই রেডি হয়ে আসছি।’

অগত্যা, করণীয় কিছু নেই। বাধ্যতামূলক নিকিলেশকে মেনে নিতেই হলো। মহুয়ার মন রক্ষার্থে বলল,-‘ও.কে ম্যাডাম্, হাড়িয়াপ। ততক্ষণে বাইরে বেরিয়ে দেখি, একটা ক্যাপ পাওয়া যায় কি না।’

(চলবেঃ)

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন