বিকেল অবধি পরিস্কার নীল আকাশ। মনেই হয়নি আজ বৃষ্টি হবে। হঠাৎ কোথা থেকে এক টুকরো কালো মেঘ ধেয়ে এসে মুহূর্তে ছেয়ে যায় গোটা আকাশ। গুড়ুম গুড়ুম মেঘের গর্জন। বিদ্যুতের বাঁকা ঝিলিক। বিশাল গর্জন করে মেঘলাকাশের বুক চিরে ক্ষণে ক্ষণে উদ্ভাসিত হতে থাকে একফালি আলোর রেখা। তারপর শুরু হয় প্রবল বর্ষণ। সেই সঙ্গে উঠল ঝড়। সে একেবারে প্রলয়ঙ্করী বেগে রাজ্যের ধূলোবালি উড়িয়ে, গাছের ডালপালা ভেঙ্গে মুছড়ে ছুটে চলে দিগ্বিদিকে। জানালার কপাটগুলি খট্ খট্ শব্দে গরাদের গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে। বন্ধ করে দেবে, সে উপায় নেই। ছিটকে এসে পড়ছে বৃষ্টির জল। থামবার লক্ষণ নেই একটুও। “ধুৎত্তরি! আজকের সন্ধ্যেটাই মাটি হয়ে যাবে দেখছি! এতক্ষণে রাস্তাঘাট নিশ্চয়ই জলে কাদায় মাখামাখি হয়ে গিয়েছে!’ স্বগতোক্তি করে ওঠে মহুয়া।
ইতিপূর্বে বাড়ির পিছনের বিশাল আমগাছটা মড় মড় করে ভেঙ্গে পড়ে রান্নাঘরের চালের উপর। আঁতকে ওঠে মহুয়া, ‘সর্বণাশ! কি সাংঘাতিক ঝড় রে বাবা! এ যে একেবারে উড়িয়ে নিয়ে যাবে মনে হচ্ছে!’
কত আশা নিয়ে বিকেল থেকে অপেক্ষা করে আছে হবু স্বামী জয়ন্ত আসবে। এলেই গোধূলীর নিরিবিলিতে কপোত-কপোতি দু’জনে পাশাপাশি বসে মন বিনিময় করবে, রোমান্স করবে। আরো কত কি!
সন্ধ্যে সাতটা বাজে। মনে হচ্ছে, গভীর নিশুতি রাত। জঙ্গলি লতা-পাতার ঝাঁড়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে। চলছে মরা কাঁন্নার মতো বাতাসের একটানা গোঙানি। রীতিমতো কেমন ভৌতিকই দেখাচ্ছে।
গা শিউরে ওঠে মহুয়ার। অপ্রত্যাশিত হঠাৎ প্রকৃতির অস্থিতিশীলতায় বিমূঢ় হয়ে পড়ে। নির্জন ঘরের কোণে বিরহের উদ্বিগ্নতা আরো দৃঢ়ভাবে অনুভব করে। চঞ্চল প্রাণবন্ত পদাচারণা ক্রমশ শিথিল হয়ে আসে। বিষন্নতায় ছেয়ে যায় দেহ-মন, সারাশরীর। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে জানালার কপাটগুলি বন্ধ করে বসে পড়ে সোফায়।
জয়ন্ত বরাবরই ভোজনবিলাসী। ক্ষীর-মিঠাই ওর খুব প্রিয়। খেতে ভীষণ ভালোবাসে। প্রথম প্রথম মহুয়াদের বাড়িতে যখন আসতো, সংকোচবোধে সরাসরি মুখে কিছু বলতো না। মিঠাই খাওয়ার লোভ লালসায় জিহ্বাটা বার করে ঠোঁট চাটতো। চকচক করে শব্দ করতো। কিচেনরুমের দিকে উঁকি ঝুকি মেরে নাক ফুলিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস টেনে বলতো,-‘উম্, ইয়ামি! স্ম্যাল গুড্। দারুণ গন্ধ বেরুচ্ছে! হালুয়া টালুয়া কিছু বানিয়েছ বুঝি!’
আসলে গন্ধ টন্ধ ওসব বাজে কথা। ক্ষীর-মিঠাই খাওয়ার লোভেই সন্ধানি চোখদুটো ওর সারাক্ষণ কিচেরুমের দিকে হানা দিতো। কিন্তু এ ধরণের ছলা-কলা মহুয়া মোটেই পছন্দ করে না। প্রতিটি ব্যাপারে ও’ একেবারে সিরিয়াস, স্পষ্টবাদী। একটুতেই চটে যায়। সামান্য ছোটখাটো ব্যাপারে তুলকালামকান্ড বাঁধিয়ে দেয়। একবার তো মুখ ফসকে বলেই ফেলেছিল। আচ্ছা করে শুনিয়ে দিয়েছিল।
-‘সরাসরি বললেই তো পারো জয়! একটু না হয় কষ্টই করলাম। অযথা বাহানা করে কেন আমায় অপদস্থ করো বলো তো! ডোন্ট ডু ইট্, প্লীজ! আনকম্ফোর্টেবল ফিল করি।’
সেদিনের পর থেকে জয়ন্তর আগমন বার্তা পেলেই দু-একপদ মিষ্টান্ন তৈরী করে রাখে মহুয়া। আজও গাজরের হালুয়া, ডালপুরি, কাজুবর্ফি সব বানিয়ে বিস্তৃত ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে। ওদিকে আকাশের শোচনীয় অবস্থা, মনে হচ্ছে এুক্ষুণিই ভেঙ্গে পড়বে।
ভাবতে ভাবতে মনের মধ্যে হঠাৎ নানারকম দুঃশ্চিন্তা দুর্ভাবনা উদয় হয় মহুয়ার। নিজের মনে বিড় বিড় করে ওঠে। এমন ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যে জয়ন্তই বা আসবে কেমন করে! এমতবস্থায় ড্রাইভ করাও বিপদ। কিন্তু আসতে পারছো না ভালো কথা, একটা ফোন তো করতে পারতো! আবার পরক্ষণেই ভাবে, হয়তো অফিসের কাজই এখনও শেষ হয়নি ওর। নইলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই ফোন দিতো জয়ন্ত।
বিড় বিড় করতে করতে টি.ভি. অন্ করে বসে পড়ে সোফায়। বিষন্ন চোখে চেয়ে থাকে। তাকিয়ে আছে ঠিকই কিন্তু ওর দৃষ্টি শূন্য। বৃষ্টি পড়ছে মুসলধারে। কানদু’টো সজাগ রাখার চেষ্টা করলেও অবিশ্রান্ত বৃষ্টির শব্দে বাইরের কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না। অস্থির হয়ে ওঠে মহুয়া। রাগ হয় গৃহপরিচারিকা মালতির উপর। সেই যে ষষ্টি পূজোতে দু’দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে, আজ সাতদিন গত হয়ে গেল, এখনও লাপাত্তা। অথচ ওর ভরসায় সংসারের সমস্ত দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে মহুয়ার পিতা হরিপ্রসাদ ব্যানার্জী সস্ত্রীক র্তীথ করতে বেরিয়েছেন কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন। ফিরবেন সপ্তা তিনেক পর। একেলা নির্জন ঘরে মহুয়ার কিভাবে দিন কাটছে, রাত পোহাচ্ছে, একবারও কি ভেবে দেখেছে? ওর তো অজানা নয়, জানতে পারলে কর্তাবাবু করুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দেবেন, সে ভয়ও কি ওর নেই! শ্বশ্মাণপুরীর মতো বিশাল দালান বাড়ি। জন-শূন্যতায় একেবারে খাঁ খাঁ করছে। টপ্ টপ্ করে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা। গা ছম্ ছম্ করে উঠছে। এরূপ বিপর্যয়ে মালতি সাথে থাকলে মহুয়াকে এমন ভীত-সন্ত্রস্ত্রে কাটাতে হতো না। ও’কি দুধের বাচ্চা, যে সারাক্ষণ ওকে আলগে বসে থাকতে হবে! -‘রাবিশ, যত্তসব আদিক্ষেয়তা!’
বকতে বকতে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় মহুয়া। দ্রুত রিসিভারটা তুলে জয়ন্তর মোবাইল নাম্বারে ডায়াল করে দ্যাখে, ওর মোবাইলটা অফ। বোঝা গেল, জয়ন্ত এখনও অফিসে। তুক্ষুণি অফিসে ট্রাই করতেই ভেসে আসে মহিলা কষ্ঠস্বর। -‘হ্যালো!’
-‘হ্যালো, কে বলছেন?’
-‘আমি শর্মিষ্ঠা বলছি! আপনি কে বলছেন?’
অপ্রত্যাশিত মহিলা কণ্ঠস্বরে মেজাজটা মুহূর্তে খাট্টা হয়ে গেল মহুয়ার। গম্ভীর হয়ে বলল,-‘আপনি আমায় চিনবেন না। জয়ন্তকে একটু দিন!’
কণ্ঠে প্রচন্ড আবেগ মহিলার। আহাল্লাদে একেবারে ফেটে পড়ছে। উৎফুল্ল হয়ে বলে,-‘কে অন্তুদা? ওতো বেরিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ।’
সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল মহুয়ার। মনে মনে বিড় বিড় করে ওঠে,-অন্তু? ও’ আবার অন্তু হলো কবে থেকে! হুঁমঃ যত্তসব আদিক্ষেতা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ উচ্চস্বরে বলে ওঠে,-‘অনেকক্ষণ মানে! জয়ন্ত কতক্ষণ আগে বেরিয়েছে?’
-‘প্রা..য় ঘন্টা খানিক হবে। কেন বলুন তো! খুব জরুরী তলাসী মনে হচ্ছে। এনি ম্যাসেজ?’
ক্রোধে ফুলে ওঠে মহুয়া। গম্ভীর হয়ে বলল,-‘নো, থ্যাঙ্কস্। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।’
রিসিভারটা ধপ্ করে রেখে দাঁতকপাটি চিবিয়ে গজ্ গজ করতে থাকে।- ‘মহিলার কথা বলার ছিরি দ্যাখো, যেন ওর পিরীতির নাগর। আর জয়ন্তই বা কেমন, ওর কমনসেন্স নেই! অফিস থেকে বেরিয়েছে তিনঘন্টা আগে, একটা ফোন দেবার প্রয়োজন মনে করলো না। এতোই আর্জেন্ট। বিনা নোটিশে একেবারে উধাও। আর ওর জন্যে এখানে কেউ অপেক্ষা করে আছে, সেটাও কি ভুলে গিয়েছে ও!’
ভাটা পড়ে গেল মহুয়ার আনন্দ-উচ্ছাসে। একরাশ মেঘ জমে ওঠে ওর হৃদয় আকাশে। সুরমা পড়া হরিণাক্ষি দু’টির কোণে চিক্ চিক্ করে জমে ওঠে অশ্রুকণা। তবু নিরাস হয় না। ওর দৃঢ় বিশ্বাস, লেট হলেও জয়ন্ত আজ আসবেই! কত সাধ করে জয়ন্তর দেওয়া ঢাকাই জামদানি শাড়ি পরিধান করে, রকমারি গহনায় সুসজ্জিত সাজে নিজেকে অপরূপা করে রেখেছিল, জয়ন্তকে বিমোহিত করবে, খুশী করবে। যেন স্বর্গের দেবীই নেমে এসেছে মর্তে। শুধু প্রেম আরাধনার অপেক্ষা মাত্র।
স্বগতোক্তি করে ওঠে মহুয়া।-উফঃ, অসহ্য। মরার বৃষ্টিই আর থামে না। যেন আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি। আকাশটা আজ ফুটো হয়ে গেল না কি!
বিড় বিড় করতে করতে ঘরের এমাথা ওমাথা পায়চারি করতে থাকে। ঘন ঘন ঘড়ি দ্যাখে। হঠাৎ আর্বিভাব হয়, অজানা আশংখা। দুঃশ্চিন্তায় ঘিরে ধরে। নিশ্চয়ই কোনো বিপদ ঘটেছে জয়ন্তর। নইলে এতক্ষণ ও’ যাবে কোথায়!
ভাবতে ভাবতে নির্জন ঘরটার একটানা নিস্তব্ধতায় মহুয়া গভীর তন্ময় হয়ে ডুবে যায় স্মৃতির সাগরে। আজ ওর ভীষণভাবে মনে পড়ছে, কলেজ ফাংশনে ‘শকুন্তলা’ নাটকের নাম ভূমিকার অভিনয়ে মুগ্ধ দর্শকের তালিকায় জয়ন্তর মন জয় করে ওর হৃদয়ের প্রবেশদ্বারে অনায়াসেই পৌঁছে যায়। যেদিন প্রথম আলাপ পরিচয় হয়েছিল জয়ন্তর সাথে। যার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কোনো ধারণাই মহুয়ার ছিল না। জানা ছিল না জয়ন্তর অতীত, বর্তমান। ওর স্বভাব, চরিত্র, সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা অনবগত ছিল মহুয়া। মাত্র কয়েকটি মুহূর্তের হাসি-কলোতানের মাধ্যমে কখন যে দুজনার বন্ধুত্ব ঘটে গিয়েছিল, ঘূণাক্ষরেও টের পায়নি। নৈকট্য লাভের আশায় কারণে অকারণে প্রায় প্রতিদিনই মহুয়ার সাথে ফোনে কথা বলতো। দেখা করতো, শহরের বিভিন্ন পার্কে, শপিং-মলে। কখনো সিনেমা কিম্বা থিয়েটার হ’লে। এভাবেই বেড়ে যায় দুজনার ঘনিষ্ঠতা, অন্তরঙ্গতা। বেড়ে যায় হৃদ্যতা। শুরু হয় মন দেয়া নেয়া। যার অনিবার্য পরিনামে দুটি সবুজ সুকোমল হৃদয়ে অচীরেই জন্ম নেয় চির সত্য ও পবিত্র শব্দ ভালোবাসা। যা কখনো ভোলার নয়।
ইতিমধ্যে ঝন্ ঝন্ শব্দে বেজে ওঠে টেলিফোন। চমকে ওঠে মহুয়া। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্যাখে, রাত আটটা বাজে প্রায়। তখনও ঝুপ ঝুপ্ করে বৃষ্টি পড়ছে। -হে ভগবান, কোনো দুঃসংবাদ নয়তো! জয়ন্তর বিপদ ঘটে নি তো! ভয়ে আশংখায় বুক কেঁপে ওঠে। ধর ধর করে হাত কাঁপে, ঠোঁট কাঁপে। রিসিভারটা তুলে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,-‘হ্যালো!’
কিন্তু না, ওপাশ থেকে জয়ন্তর গলাই শোনা গেল।-‘হ্যালো মৌ, জয়ন্ত বলছি অফিস থেকে। এই শোনো, –!
কি স্বআভাবিক কণ্ঠ স্বর জয়ন্তর। যেন কিছুই ঘটেনি।
ক্রোধে ফেটে পড়ে মহুয়া। একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। জয়ন্তকে বাঁধা দিয়ে কর্কশ স্বরে বলে ওঠে,-‘তা তো বুঝতেই পারছি! কিন্তু তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে?’
-‘কেন? অফিসে ছিলাম। বাইরে বের হবার ফুরসৎ কোথায়।’
যেন সত্যিই অফিসে ছিল জয়ন্ত। কোনো আবেগ নেই, উদ্বেগ নেই, অনুশোচনা নেই। সারা দুনিয়া তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, কোনো খবরই নেই ওর। এতো অগ্রাহ্য, বেপরোয়া মনোভাব।
ক্রোধে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে গর্জে ওঠে মহুয়া,-‘মিথ্যে কথা। তুমি অফিসে ছিলে না। বিকেলেই বেরিয়ে গিয়েছিলে। বলো কোন্ রাজকায্যে গিয়েছিলে?’
গ্রাহ্যই করলো না জয়ন্ত। কোনো উত্তর দিলো না। মহুয়াকে উপেক্ষা করে স্বাভাবিক গলায় বলল,-‘শোনো বেবী, আজ আমায় দিল্লী যেতে হবে। রাত দশটায় ফ্লাইট। কাল আর্লি মর্নিংএ হেড্ অফিসে জরুরী মিটিং আছে। এুক্ষুণি বেরিয়ে যাচ্ছি আমি। টুমরো আপটার নুন-এ ব্যাক্ করে তোমায় কল্ দেবো, ও. কে!’
শুনে গা রি রি করছে মহুয়ার। ওর সন্দেহ আরো ঘনীভূত হতে থাকে। ক্ষোভে, অপমানে ও অভিমানের সমন্বয়ে উত্তেজনায় বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে হাঁপাতে থাকে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,-‘যাও যাও, কথা বানিও না। আর কতকাল মিটিং-এর দোহাই দেবে শুনি! খবর রাখি না ভেবেছ?’
শুকনো একটা ঢোক গিলে চুপ করে থাকে জয়ন্ত। মুখ দিয়ে আর বুলি বের হয় না। মহুয়া বলল,-‘জানি, জবাব দেবার মতো তোমার কাছে আজ কিছুই নেই। ছিঃ জয়, ছিঃ, ভাবতেও আমার ঘেন্না করছে। তুমি এতো নীচে নেমে যাবে, কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করিনি।’
নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পেলেও গলাবাজি গেল না জয়ন্তর। সামান্য চটে গিয়ে বলে-‘হোয়াট ডু ইউ মিন? আমায় অবিশ্বাস করছো? কি বলতে চাইছো তুমি?’
-‘চেঁচিও না। তোমার সব খবর আমি পেয়েছি। তিনঘন্টা আগে তুমি অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছ, বলো সত্যি কি না?’
খানিকটা নরম হয়ে জয়ন্ত বলল,-‘আশ্চর্য্য! এতে জবাবদিহীর কি আছে! হ্যাঁ, গিয়েছিলাম তো!’
মাথাটা বনবন করে ঘুরে ওঠে মহুয়ার। ক্রোধে ফেটে পড়ে। গলার স্বর বিৃকতি করে বলে,-‘সেটা বুঝতে কারো বাকী থাকে? বলো কোথায় গিয়েছিলে?’
বিব্রোত কণ্ঠে জয়ন্ত বলল,-‘আরে বাবা, টিকিট বুক করতে গিয়েছিলাম!’
-‘ও, তাই না কি! সেটা টেলিফোনে করা যেতো না! সঙ্গেও কেউ যাচ্ছে নিশ্চয়ই!’
-‘ইয়েস, অফ্ কোর্স! আই এম নট্ গোয়িং এ্যালোং! তুমি তো জানো!’
-‘হ্যাঁ, সেই জন্যেই তো বলছি, তোমার বসের মেয়ে, কি যেন নাম, মিলি না লিলি, ঐ ডাইনিটাও তো যাচ্ছে সঙ্গে, তাই না?’
চটে যায় জয়ন্ত। উত্তেজিত হয়ে বলে,-‘আবার ওকে ইনভল্ব করছো কেন? আর ইউ ক্রেজি? মিটিংএর সাথে ওর কি সম্পর্ক?’
-‘হ্যাঁ, সম্পর্ক আছে বলেই তো। ভাবছো টের পাইনি। চুপিচুপি হীরের নেকলেস্ গড়িয়ে দিয়েছ। নিজের হাতে পড়িয়েও দিয়েছ, কিসের জন্যে? শুধুই কি চাকুরির খাতিরে, না অন্য কিছু?’
-‘আঃ মৌ, এসব কি যা তা বকছো! তোমরা মেয়েরা বড়ই বিচিত্র। অন্যের সুখ মোটেই সহ্য করতে পারো না। আরে বাবা, বস্কেও তো একটু সন্তুষ্ট করতে হয়, না কি! শোনো লক্ষিটি, ছেলেমানুষী করো না। সময় খুবই কম। আমায় এুক্ষুণিই বের হতে হবে।’
শুনে পিত্তি জ্বলে ওঠে মহুয়ার। রাগে সর্বাঙ্গ রি রি করছে। নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। তীক্ষ্ন কণ্ঠে গর্জে ওঠে,-‘কি, ছেলেমানুষী আমি করছি, না তুমি করছো।’
মহুয়ার কথার জেরায় বিপাকে পড়ে যায় জয়ন্ত। আমতা আমতা করে বলে,-‘আ-আমি আবার কি করলাম!’
-‘কি করলাম মানে, বসের মেয়েকে নিয়ে এতখানি বাড়াবাড়ি, নামের সংক্ষিপ্ত, এসব কি ফষ্টি নষ্টি শুরু করেছ? যত্তসব আদিক্ষেতা!’
জয়ন্ত কনভিন্স করার চেষ্টা করে। মাথা ঠান্ডা রেখে স্বাভাবিক গলায় বলল,-আদিক্ষেতা বলছো কেন? আদর করে কেউ যদি আমায় অন্তু বলে সম্বোধন করে, এতে দোষের কি আছে! এটুকুই সহ্য করতে পারছ না, আমায় নিয়ে সারাজীবন সংসার করবে কিভাবে? তা’ছাড়া, সবসময় তোমায় কৈফেয়ৎ দিতে হবে, এমন তো প্রতিজ্ঞা আমি করিনি!’
বুকের ভিতরে যেন একটা শূল গেঁথে গেল মহুয়ার। কাতর কণ্ঠে অস্ফূট আর্তনাদ করে ওঠে। -‘একথা তুমি বলতে পারলে জয়! তোমার মুখে একটু আঁটকালো না। এটুকু জানবার অধিকারও কি আমার নেই? আমাদের এতদিনের সম্পর্ক, ভাব-ভালোবাসা, মেলামেশা, সবই কি মিথ্যে? বলো জয়ন্ত বলো! চুপ করে থেকো না, বলো!’
মেয়েদের ব্যাপারে জয়ন্ত বরাবারই দুর্বল। অল্পতেই মোমের মতো গলে নরম হয়ে যায়। বিশেষ করে অচেনা মহিলার সম্মুখে ওভার এক্ট একটু বেশীই করে। কিন্তু আজ পড়ে গিয়েছে মহুয়ার ফাঁদে। সহজে রেহাই পাবার নয়। তাই যথাসম্ভব নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে বলল,-‘এসব তোমার মনের ভ্রম মৌ! আমি এ্যফসেন্ট থাকলেই যতসব আজে বাজে চিন্তা তোমার মাথায় আসে। অযথা নিজেই কষ্ট পাচ্ছো। একটু ধৈর্য্য ধরো, আর কটাদিন আমায় সময় দাও! তারপর……!’
-‘তারপর কি? পাল্টা প্রশ্ন মহুয়ার। -বিয়েটা এবার সেড়ে ফেলবে, এই তো!’
-‘আচ্ছা, তোমার আজ কি হয়েছে বলো তো? সেই তখন থেকে শুধু আবোল তাবোল বকে যাচ্ছো। বললাম তো, ক’টাদিন সময় দাও! রাইট নাউ আই ডোন্ট হ্যাভ টাইম টু ডিশকাশন্ এবাউট ইওর ডিস্কাষ্টিং ম্যাটার। ও.কে? বাই!’
কথাগুলি এক নিঃশ্বাসে বলে লাইনটা কেটে দিলো জয়ন্ত। ক্রোধে চোখমুখের শিরাগুলি ফুলে ওঠে মহুয়ার। রিসিভারটা জোরে আঘাত করে রেখে দিয়ে ওর পরিধানের কাপড়টা একটানে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় মাটিতে। রেকর্ডপ্রেয়ারটা হাইভলিওমে অন্ করে স্বাগতোক্তি করতে করতে বসে পড়ে সোফায়,-‘কার জন্যে এই দীর্ঘ প্রতীক্ষা? কার জন্যে এতো সাজ-সরঞ্জাম, এতোসব আয়োজন? কিসের জন্য? মিটিং না ছাই। মিটিং মানেই হুইস্কির বোতল চোষা। কচি কচি সুন্দরী যুবতী রমণীর পিছে পিছে ঘোরা, ওদের মনোরঞ্জন করা। তোমার সব মিথ্যে। আনন্দ-হাসি-কলোতান, প্রেম-ভালোবাসা সব মিথ্যে। তুমি একজন চরিত্রহীন, ইতর, ধোকেবাজ, ধান্দাবাজ। কিন্তু পালাবে কোথায়? ফিরে তোমায় আসতেই হবে। মেয়েদের মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা, এ আমি কক্ষনো হতে দেবো না। কিছুতেই না। বারুজ্জ্যে বংশের মেয়ে আমি। কতদূর উড়তে পারো তুমি, আমিও দেখে নেবো।
উত্তপ্ত মেজাজে গজগজ করতে করতে গিয়ে ঢোকে রান্নাঘরে। একটু মুখে দিয়েও দেখল না। দূপুরে তৈরী করে রাখা ক্ষীর-মিঠাইগুলি সব ফেলে দিলো ডাষ্টবিনে। ইত্যমধ্যে হঠাৎ ঝট্ করে নিভে গেল বিজলীবাতি। চমকে ওঠে মহুয়া। চারদিক ঘন অন্ধকারে ছেয়ে যায়। একেলা নির্জন ঘরে মহুয়া দিশা হারিয়ে ফ্যালে। চোখে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। জানালার কপাটগুলি খুলে দিতেই বাইরের শীতল হাওয়া হু হু করে ঢুকতে থাকে ঘরের ভিতর। তখনও গুরি গুরি বৃষ্টি পড়ছে। বাইরে চারিদিকে জোনাকিরা উড়ছে। জন-মানব শূন্য। একটি প্রাণীও কোথাও নেই। রাস্তার কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করছে। মাঝে মধ্যে দু-একখানা গাড়ি দ্রুতবেগে পাস করে যাচ্ছে।
এমতবস্থায় বিব্রোত কণ্ঠে বকতে থাকে মহুয়া।-‘দূর ছাতা, মোমবাতিটা গেল কোথায়!’
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে মোমবাতিটা নিয়ে জ্বালিয়ে দিতেই ড্রইং রুমটা ঈষৎ আলোয় ভরে ওঠে কিন্তু ওর মনের ঘরটা অন্ধকারই রয়ে যায়। যে ঘরের কোণে মহুয়া আজ অত্যন্ত একা, নিঃসঙ্গ। আর সেই একাকীত্বের নিঃসঙ্গতায় ওকে ক্রমশ তলিয়ে নিয়ে যায় এক দুঃস্বপ্নের সাগরে। ইদানিং ওর দৃষ্টিগোচর হয়, জয়ন্তর আমূল পরিবর্তন। অনেক বদলে গিয়েছে। কাজের বাহানায় সারাদিন প্রায় বাইরেই কাটায়। আজকাল নাগালই পাওয়া যায় না ওর। তবু সন্দেহের বীজ কখনো চারা দিয়ে ওঠেনি। রোপণ করেনি। কিন্তু আজ ওর বিষাদাচ্ছন্ন হৃদয় আকাশের বুক চিরে বারবার অনুতাপ, অনুশোচনার ঝিলিক দিতে লাগল, ভালোলাগার উন্মাদনায় অন্ধের মতো জয়ন্তর প্রেম-আহ্বানে কেন সাড়া দিয়েছিল? কেনই বা ওকে ভালোবেসেছিল! একবারও মনে হলো না, জয়ন্ত আদৌ ওকে ভালোবেসেছিল কি না। পবিত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ওকে স্ত্রী রূপে কখনো গ্রহণ করবে কি না! কখনো স্ত্রীর পূর্ণ মর্যাদা দেবে কি না। আজ জেনারেল মিটিং, কাল বসের মেয়ের জন্মদিন, পার্টি, পরশু অফিস ষ্টাফদের গেটটুগেদার। একদন্ডও ফুরসৎ নেই জয়ন্তর। কিন্তু ওযে এভাবে ক্রমশ দূরে সড়ে যাচ্ছে, তা এতদিন মহুয়া ঘূণাক্ষরেও টের পায় নি। আজ বিনা নোটিশে দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে হঠাৎ রহস্যজনক ভাবে জয়ন্তর উধাও হয়ে যাওয়া, মহুয়াকে এভয়েট করা, বুঝতে কিছুই আর অবশিষ্ঠ থাকে না। সবই জয়ন্তর পূর্ব পরিকল্পিত, ষড়যন্ত্র।
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ যেন একটা বিষ্ফোরণ ঘটে গেল। মহুয়া চিৎকার করে ওঠে,-‘তুমি প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক জয়ন্ত, সবই তোমার ছলনা, ভন্ডামি। মিটিংএর দোহাই দিয়ে আমাকে এ্যাভয়েট করে তোমার পালাবার চেষ্টা। এ আমি কক্ষনো হতে দেবো না। ভুলে যেওনা, তুমি বাকদত্তা। কোনো মতেই তা প্রত্যাহার করতে পারো না। কিছুতেই না!’
আবার পরক্ষণেই ভাবে,-কিন্তু ওর ভালোবাসা। ভালোবাসার চরম মুহূর্তগুলি। আবেগে আুপ্লুত হয়ে ওর উষ্ণ বক্ষপৃষ্ঠে মহুয়াকে সজোরে প্রেমালিঙ্গনে বেঁধে নিয়ে ওর চিবুকে, শুভ্র ললাটে চুম্বন করা, সবই কি মিথ্যে? সবই কি ওর অভিনয়? এতদিন শুধু ভালোবাসার নাটক করে এসেছিল জয়ন্ত?’
হাজার প্রশ্নের ভীঁড়ে জর্জরিত হয়ে ওঠে মহুয়া। বড় নিঃসঙ্গ মনে হয় নিজেকে। ক্লান্তি আর অবসন্নতায় ছেয়ে যায় শরীর আর মন। সোজা হয়ে দাঁড়াবারও যেন শক্তি নেই। হঠাৎ মাথাটা বন্ বন্ করে ঘুরে উঠতেই হাত-পা ছড়িয়ে ধপ্ করে বসে পড়ে সোফায়। উঠে জানালার কপাটগুলি বন্ধ করে দেবে, সেই শক্তিও নেই। ততঙ্কণে বাইরের হিমেল হাওয়ায় শীততাপ নিয়ন্ত্রণে ভরে গিয়েছে সারাঘর। কোনরকমে কাপড়টা টেনে গায়ে জড়িয়ে সোফাতেই শুয়ে পড়ে।
চলবে। ..