আমি জানি, বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে, পৃথিবী ২১৫ জন শিশুর নির্মম পরিনতির কথা জানতে পেরেছে। দ্রুতগতিময় আজকের এই জীবনে একই বিষয় নিয়ে বেশি কথা বলার বা শোনার ধৈর্য্য এখনকার মানুষের নেই। আমি নিজেও কয়েকদিনের মন খারাপকে পাশ কাটিয়ে নিজের কাজে ডুব দিতে চেয়েছি। অসম্ভব স্বার্থপর মানুষের মত চেয়েছি যেন আশেপাশের এই খবর আমার দৈনন্দিন জীবনের কাজ, পড়াশুনা, সামাজিকতায় বাঁধা না তৈরী করে। কিন্তু যতবার চোখ বন্ধ করছি ততবার মনে হচ্ছে বাবা মা থেকে ছিনিয়ে আনা সেই শিশুগুলোর অসহায় চেহারা। কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি শেষ সময়ের সেই নিষ্পাপ মুখগুলোর আকুতি।নির্ঘুম কাটছে রাতের পর রাত।
এই শিশুগুলোর কোনও নাম পরিচয়েরও হদিশ নেই কারও কাছে। ভ্যাটিক্যান সিটির গডফাদারা কানাডার এই আবাসিক স্কুল সম্পর্কিত তথ্য জনসম্মুখে নিয়ে আসার আবেদনকে নাকোচ করে দিয়েছে।যেখানে ক্যাথলিক চার্চ ৭০% আদিবাসী আবাসিক স্কুল পরিচালনার দায়িত্বে ছিল। অন্যদিক চার্চ অব ইংল্যান্ডের হেড ব্রিটিশ সিংহাসনের অধিকারী রাজা এবং রানী সকলেই এই স্কুলগুলোর পেছনে দায়ী। শুধু তাঁরাই নয়, বরং ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত কানাডার সরকার ত্রিশ হাজার কিলোগ্রামের উপরে তথ্য এবং কাগজপত্রকেও নষ্ট করেছে। পুরাতন খবর এবং নথিপত্র থেকে জানা যায় মাত্র ৫১ জন শিশু মারা যায় ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ক্যামলুপ আবাসিক স্কুলে, কিন্তু সদ্য আবিস্কৃত এই গনকবর থেকে উদ্ধারকৃত ২১৫ টি শিশুকঙ্কাল চিৎকার করে এই কথাই জানায়, যে আমরা সাধারন জনগন কত ভুলের মাঝে বসবাস করি, আর আমাদের সরল চোখকে ফাঁকি দিয়ে পৃথিবীর মাঝেই নরক তৈরী করছে সুবিধাবাদী রাজনীতি ও ধর্মব্যবসায়ীরা।
পাঠক হয়ত বলবেন, এ তো বহু আগের কথা- ইতিহাস। এটা কিন্তু ইতিহাস নয়, এটা বর্তমান কারন ঐ স্কুলের থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে আসা বহু প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রী এখনও বলে যাচ্ছেন তাঁদের অভিজ্ঞতা। আমরা কেবল তা শুনতে পাচ্ছি না। অথবা আমাদের কান পর্যন্ত তাদের কথা আসতে দেওয়া হচ্ছে না। শেষ স্কুলটি বন্ধ হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। বলতে পারেন, ১৯৯৬ সালে আপনারা কে কি করছিলেন?
গত কিছুদিন ধরেই এ নিয়ে পড়াশুনা করছি, পড়ছি তাদের দুঃসহ অভিজ্ঞতা। শিশুরা কবর খুঁড়ছে তাদের ভাইবোনদের জন্য, মাত্র দুই ঘন্টা পড়াশুনার পরেই করতে হয়েছে কায়িক শ্রম। না খেয়ে মারা অপুষ্টির শিকার হয়ে মারা গেছে বহু শিশু। পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে দিনের পর দিন। নির্যাতিত হবার পরে শিশু জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে বহু কিশোরী। তাদের সন্তানদেরও হত্যা করা হয়েছে নামকরনের আগেই। তখন কানাডায় কোনও যুদ্ধ চলছিল না, ছিল না কোনও দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাব। চার্চ, সরকার এবং আরসিএমপির সহযোগিতায় আইন করে তাদের ছিনিয়ে আনা হয়েছিল তাদের বাবা মায়ের কাছ থেকে। সেই পাষন্ড পরিচালকেরা হয়ত ভুলেই গিয়েছিলেন এই শিশুরা কেবল এক একটি নম্বর নয়, বরং তারা কারও আদরের সন্তান, ভাই, বোন কিংবা নাতি। শিশুদের মৃত্যুর খবরটা পর্যন্ত তাদের কাছে পৌঁছেনি। বহু শিশু হারিয়ে যাওয়া সোনামানিক হিসেবে রয়ে গেছে প্রিয়জনদের অন্তরে।
কেনেডিনরা সমস্ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট বাচ্চাদের জুতো দিয়ে সন্মান প্রদর্শন করছে এই বাচ্চা ও তাদের আত্মীয় স্বজনদের প্রতি। প্রতিবার এমনই কিছু জুতো দেখি আর আমার বুকটা ভেঙে যায়। কেবলই মনে হয়, বাবুগুলির কাছে যাই।একটু পাশে বসি। আদর করে গাল টিপে দিই। সোনামনি বলে বুকে জড়িয়ে ধরি।কানের কাছে ফিস ফিস করে বলি, ভয় পেও না- আমি আছি- আমরা আছি- বিধাতা আছেন।